বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস

আপডেট: মার্চ ১৭, ২০২৪, ১২:১০ পূর্বাহ্ণ
আব্দুল হামিদ খান:আজ ১৭ই মার্চ। বাংলার স্বাধীনতার মহান নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ, বাংলা ১৩২৭ সালের ২০ চৈত্র মঙ্গলবার রাত ৮টায় বঙ্গবন্ধু সাবেক ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষ শেখ আউয়াল বাগদাদ থেকে বাংলায় ইসলাম ধর্ম প্রচারে আসেন। তার পুত্র শেখ জহির উদ্দিন, তার পুত্র শেখ জান মাহমুদ। জান মাহমুদের পুত্র শেখ বোরহান উদ্দিন বসতি স্থাপন করেন টুঙ্গিপাড়ায়। বোরহান উদ্দিনের পুত্র শেখ একরামুল্লা, তার পুত্র শেখ মো. জাকির। জাকিরের পুত্র আব্দুল হামিদ, আব্দুল হামিদের পুত্র শেখ লুৎফর রহমান। শেখ লুৎফর রহমানের গর্বিত পুত্র শেখ মুজিবুর রহমান। অর্থাৎ শেখ মুজিব ধর্মপ্রচারক আউলিয়া আওয়াল বাগদাদীর নবম অধস্তন পুরুষ।
শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। মাদারীপুর দেওয়ানি আদালতে শেরেস্তা পদে থাকাকালীন ১৯৩১ সালে শেখ মুজিবকে মাদারীপুর এনে স্থানীয় ইসলামিয়া হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন। এখানে পড়াশুনা করার সময় তিনি কঠিন বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন। এ রোগ থেকে একটু আরোগ্য লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি চোখের গ্লুকোমা রোগে আক্রান্ত হন। চোখের চিকিৎসার জন্য বাবা শেখ লুৎফর রহমান পুত্র শেখ মুজিবকে নিয়ে কলকাতায় যান এবং তৎকালীন কলকাতার বিখ্যাত চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. টি আহমেদকে চোখ দেখালে তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেখ মুজিবুরের চোখে অপারেশন করে চশমা পরার উপদেশ দেন।
কলকাতা থেকে ফিরে শেখ মুজিবকে তার বাবা গোপালগঞ্জ খ্রিষ্টান মিশনারি স্কুলে ভর্তি করে দেন। ছেলেবেলা থেকেই শেখ মুজিব নেতৃত্বদানের এক অসাধারণ ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। ছাত্র নেতৃত্ব সম্পর্কে তার এক চমকপ্রদ ঘটনা আছে। মুজিব তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এলেন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল পরিদর্শনে। সঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও স্থানীয় এসডিও। স্কুল পরিদর্শন শেষে তারা হেঁটে ডাকবাংলায় ফিরছিলেন। খুব সরু কাঁচা মাটির রাস্তা। হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী দেখলেন জনাকয়েক ছাত্র তাদের চলার পথ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। আচকান পরিহিত বিশাল দেহী প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা ফজলুল হক গম্ভীর কণ্ঠে ছাত্রদের জিজ্ঞেস করলেন।
তোমরা কী চাও? কালো চশমা পরিহিত এক ছাত্র দৃপ্তকণ্ঠে জবাব দিল আমাদের হোস্টেলের ছাদ দিয়ে বর্ষাকালে পানি পড়ে। এতে আমাদের বিছানাপত্র আর বই পুস্তক ভিজে নষ্ট হয়ে যায়। তাই ছাদ মেরামতের ব্যবস্থা না করলে রাস্তা ছাড়বো না। প্রধানমন্ত্রী বললেন, কত টাকা লাগবে? জন্মদিন ছেলেটি নির্ভয়ে উত্তর দিল প্রায় বারোশত টাকা প্রয়োজন। কিশোর ছাত্রটির সৎ সাহস ও স্পষ্টবাদিতায় প্রধানমন্ত্রী মুগ্ধ হলেন। তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়েই তাঁর স্বেচ্ছাধীন তহবিল থেকে ১২শো টাকা মঞ্জুর করে অবিলম্বে ছাদ মেরামত করার জন্য পেছনে দাঁড়ানো এসডিও সাহেবকে নির্দেশ দিলেন। এরপর ছাত্রটিকে কাছে ডেকে নাম জিজ্ঞেস করে কাঁধে হাত রেখে বললেন, আজ থেকে তুমি আমার নাতি। সেদিনের সেই কিশোর ছাত্রটিই পরবর্তীকালে হয়ে ওঠেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গোপালগঞ্জ থেকে মেট্রিক পাস করে শেখ মুজিব কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। এ সময় তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।
শেখ মুজিব ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেন। তার প্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন সুভাস চন্দ্র বসু, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম। তাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই ছাত্রজীবনে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি সুভাস চন্দ্র বসুর হলওয়েল মুভমেন্টে অংশ নিয়েছিলেন। কলকাতায় তিনি উপমহাদেশের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের সংস্পর্শে আসেন। কলকাতা ছিল তার রাজনীতির শিক্ষাকেন্দ্র।
বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিব নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসুর কাছে থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন দেশপ্রেমে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেছিলেন দলের সাংগঠনিক দক্ষতা ও নির্বাচনী কলাকৌশলসহ নেতৃত্বের সব গুণাবলি। তাই তো সোহরাওয়ার্দীকে তিনি রাজনৈতিক গুরু মানতেন। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন দিবস ১৭ মার্চকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। জাতিসংঘের শিশু অধিকারের ভিত্তিতে আমরা জন্মদিন জাতীয় শিশু দিবস পালন করি। কোনো জাতির ভবিষ্যত নির্ভর করে শিশুদের ওপর। শিশুদের সঠিকভাবে গড়ে তোলার জন্য তথা শিশুদের মৌলিক চাহিদা পূরণ  করে তাদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই পালন করা হয় শিশু দিবস।
শিশুদের অধিকার হলো জন্ম ও স্বাস্থ্যের অধিকার, সুশিক্ষার অধিকার, খাদ্যের অধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার। বাংলাদেশে মাতৃত্বজনিত মৃত্যুর হার কমে এসেছে কিন্তু শিশু মৃত্যুর হার এখনও উদ্বেগজনক। এখনও ৫০ ভাগ শিশু অপুষ্টিতে ভোগে, তারা সঠিকভাবে স্বাস্থ্যসেবা পায় না। এসব শিশুদের সুষম খাদ্য প্রদান করতে হবে। তাদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে। পঞ্চম শ্রেণির সমাপ্তির পূর্বেই শিশুদের বিরাট একটি অংশ ঝরে পড়ে। জন্মদিন এ ঝরে পড়া রোধ করতে হবে। শিশুরা প্রতিনিয়তই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আর এ নির্যাতনে অভিনব সব পন্থা আবিস্কার হচ্ছে। শিশু নির্যাতনে জিরোটলারেন্স দেখাতে হবে আইন শৃংখলা বাহিনীকে। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে আমাদের অঙ্গীকার হোক শিশুদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার। দেশে শিশু অধিকার পদে পদে লঙ্ঘিত হচ্ছে। প্রায় ২০ ভাগ শিশু শ্রমিক হিসেবে কাজ করে।
শিশুশ্রম বন্ধ করে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে হবে। শিশুদের নিরাপত্তার জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে শিশু আইন প্রণয়ন করেছেন। ১৯৯৭ সালের শিশু অধিকার নীতির আলোকে জাতীয় শিশু নীতি বাস্তবায়ন করে আগামী দিনের নাগরিকদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করাই হবে আমাদের আগামী দিনের জন্মদিন লক্ষ। শিশুদের জীবন ভালোভাবে সাজাতে হলে তাদের জীবনে সফলতার জন্য পৃথিবী টাকে সুন্দর করে গড়তে  হলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শিক্ষার। এক্ষেত্রে প্রয়োজন শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় সুযোগ। একটি শিশু পৃথিবীতে জন্ম নেয়ার পর তার জীবসত্ত্বার সৃষ্টি হয়। যখন সেই শিশুটা শিক্ষিত হয়, তখন তার মানবসত্তা গঠিত হয়। আমরা যদি একটি শিশুকে একটি দোতলা ঘরের সঙ্গে তুলনা করি।
তাহলে জীবসত্তা সেই ঘরের নীচতলা আর মানবসত্তা হবে সেই ঘরের ওপরের তলা। তাই জীবসত্তাকে মানবসত্তায় পরিণত করতে হলে বা ঘরের নীচতলা থেকে ওপরের তলা যেতে হলে শিশুকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। শিশুদের জীবন গঠন এবং জীবনের সর্বাঙ্গীন সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীকে আলোকিত করতে শিক্ষার প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিশুর মানসিক উৎকর্ষ সাধন এবং নতুন শতাব্দীর উপযোগী সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। বয়স ও ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী শিশুদের জন্যে প্রয়োজন গঠনমূলক পাঠ্যসূচি। প্রয়োজন সুশিক্ষিত ও প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষকের আদর-স্নেহ সহযোগে পাঠদানের পাশাপাশি সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন শিক্ষা পরিবেশ উপহার দেয়া।
শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিনোদনের পর্যাপ্ত সুযোগ থাকা চাই। চাই খেলাধূলার জন্য উন্মুক্ত পরিবেশ। প্রখ্যাত জার্মান শিক্ষাবিদ ফোয়েবল তাই খেলার ছলে পাঠদানের প্রথা হিসেবে উদ্ভাবন করেন কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু বর্তমানে সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো যেভাবে কিন্ডারগার্টেন গড়ে উঠেছে তাতে শিক্ষাবিদ ফোয়েবলের কোনোি নিয়মনীতিই মানা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মহলকে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট।