অগ্নিঝুঁকিতে রাজশাহী! বহুতল ভবনগুলোও অনিরাপদ, ঝুঁকিপূর্ণ নগরীর পাঁচ মার্কেট

আপডেট: মার্চ ৩১, ২০২৪, ১২:১০ পূর্বাহ্ণ


নিজস্ব প্রতিবেদক:রাজশাহী নগরীতে একের পর এক গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। একই সাথে গড়ে উঠছে বিপনীবিতান ও মার্কেট। এসব ভবন ও মার্কেটগুলোতে নেই অগ্নিনিরাপত্তা। অগ্নিঝুঁকিতে রাজশাহীর সব ভবন ও মার্কেট। রাজশাহী ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের তথ্যমতে, ৯৯ শতাংশ ভবন ও মার্কেট অনিরাপদ। যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ধারণা, যে কোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে রাজশাহীতে বড় কোনো অগ্নি দুর্ঘটনায়। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে।

রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন বহুতল ভবন ও মার্কেটে পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপণ সরঞ্জামাদি নেই। জরুরি নির্গমণ পথ, অগ্নি নির্বাপক, ধোঁয়া শনাক্তকারী যন্ত্র এবং জলের স্প্রিংকলার সিস্টেমের মতো প্রাথমিক অগ্নিনিরাপত্তা উপাদানগুলোরও ঘাটতি রয়েছে। সাহেববাজারের এলাকার একটির মিষ্টির দোকানে দেখা য়ায়, কারিগররা গ্যাসের সিলিন্ডার চুলার কাছে নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় খাবার প্রস্তুত করছে। তাদের কাছেও নেই অগ্নি নির্বাপণ কোনো সরঞ্জামাদি। তার পাশে থাকা আরেকটি মিষ্টির দোকানেও একই অবস্থা।

আরডিএ মার্কেটের মেইন গেটের কাছে রাস্তার পাশে একজন ব্যবসায়ী গ্যাসের চুলায় খাবার প্রস্তুত করতে ব্যস্ত। তিনি যে চুলায় আগুন জ্বালিয়ে খাবার প্রস্তুত করছেন তার সাথেই রাখা গ্যাসের সিলিন্ডার। একই চিত্র দেখা মিললো সাহেববাজার বড় জামে মসজিদের সামনে। রাস্তায় গ্যাসের চুলায় খাবার প্রস্তুত করছেন এক কারিগর। আর চুলার দু’পাশে রয়েছে দুটি গ্যাসের সিলিন্ডার। নগরীর একটি মার্কেটের দেওয়াল ঘেঁষে ফুটপাতে চলাচলের রাস্তায় অরক্ষিত অবস্থায় রাখা ১০/১২টি গ্যাস ভর্তি গ্যাসের সিলিন্ডার। অদূরে বড় মসজিদের পেছনে আরেকটি নাম করা খাবারের হোটেল। সেখানে পাশাপাশি সারিবদ্ধভাবে রাখা চুলায় জ্বলছে আগুন। সামান্য জায়গায় একসঙ্গে রয়েছে প্রায় ১০/১২টির মত গ্যাস সিলিন্ডার।

এমন চিত্র দেখা পুরো রাজশাহী নগরীজুড়ে। প্রায় প্রতিটি চায়ের দোকান, হোটেল-রেস্টুরেন্ট এবং বাড়িতে ব্যবহৃত হচ্ছে গ্যাসের সিলিন্ডার আর চুলার। গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার আর চাহিদা যেমন বেড়েছে ঠিক তেমনি বেড়েছে গ্যাস সিলিন্ডার কেনাবেচাও। ফলে রাজশাহীর বিভিন্ন স্থানে অলিগলিতেও এখন গ্যাস সিলিন্ডার কেনা-বেচা করা হচ্ছে। তবে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার কিংবা কেনা-বেচায় নিশ্চিত করা হচ্ছে না সঠিক ও পর্যাপ্ত নির্দেশনা এবং নিরাপত্তা।

অগ্নিনিরাপত্তার চরম ঝুঁকি নিয়ে চলছে রাজশাহী নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি মার্কেট। মার্কেটগুলোর চারটিই সরকারি সংস্থার মালিকানাধীন। আর একটি গড়ে উঠেছে ব্যক্তিমালিকানার দোকানপাট নিয়ে। ফায়ার সার্ভিস এসব মার্কেটকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে প্রায়ই ব্যানার টাঙিয়ে দেয়। কিন্তু রাতারাতি সেসব ব্যানার উধাও হয়ে যায়।

অগ্নিঝুঁকিতে মার্কেট পাঁচটি হলো রাজশাহী নগরীর সাহেববাজারের আরডিএ মার্কেট, রাজশাহী নিউমার্কেট, হড়গ্রাম নিউমার্কেট, সোনাদীঘি এলাকার সমবায় মার্কেট এবং নগরীর সাহেববাজার কাপড়পট্টি। এর মধ্যে আরডিএ মার্কেট হলো রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) মালিকানাধীন। সমবায় মার্কেটটি সমবায় বিভাগের। রাজশাহী নিউমার্কেট ও হড়গ্রাম নিউমার্কেট রাজশাহী সিটি করপোরেশনের। কাপড়পট্টি গড়ে উঠেছে সাধারণ ব্যবসায়ীদের দোকানপাট নিয়ে।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, এই ৫ মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে তা নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হবে। আশপাশে পানির উৎস না থাকার কারণে মার্কেট-গুলো ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মার্কেট-গুলোর মাঝে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে আরডিএ মার্কেট। ঘিঞ্জি এই মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা-ঘটলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকার উপায়ও নেই।

আরডিএ মার্কেটে মার্কেটে ১ হাজার ৯৫২টি দোকান রয়েছে। মার্কেটটিতে মুদিদোকান, খাবারের হোটেল, কাপড়, কসমেটিকস থেকে ক্রোকারিজ ও ইলেকট্রনিকসের দোকানও রয়েছে। গত ৮ জানুয়ারি রাতে মার্কেটের প্রধান ফটকসংলগ্ন বাইরের অংশে একটি মুদিদোকানের দোতলার গুদামে আগুন লাগে।

অগ্নিঝুঁকিতে চরম ঝুঁকি থাকায় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কয়েক বছর আগেই আরডিএ মার্কেট ভেঙে ফেলতে সুপারিশ করে। তবে মার্কেটটি এখনও ভাঙা হয়নি। এই মার্কেটে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ কেনাকাটা করেন। ইদের সময় মার্কেটের ভেতরে পা ফেলার জায়গা থাকে না।

সর্বশেষ গত বছরের ১৭ এপ্রিল ওই পাঁচটি মার্কেটকে অগ্নিনিরাপত্তায় ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ব্যানার টাঙায় ফায়ার সার্ভিস। ব্যানারে লেখা ছিল, ‘অগ্নিনিরাপত্তার দিক থেকে এই মার্কেট খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক হওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হলো।’

আরডিএ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ মামুদ হাসান এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চান না। দিতে চান না কোনো বক্তব্য।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের রাজশাহী বিভাগের উপপরিচালক ওহিদুল ইসলাম বলেন, এসব মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ। এ বিষয়ে বারবার চিঠি দিলেও মার্কেট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আরডিএ মার্কেটের আশপাশে পুকুর নেই। ফলে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে পানির অভাবে আগুন নিভাতে-প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে।

দুই নিউমার্কেটের অগ্নিঝুঁকিতে ঝুঁকির বিষয়ে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর ইসলাম তুষার বলেন, ‘হড়গ্রাম নিউমার্কেটে এ ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। তবে আমার কাছে রাজশাহী নিউমার্কেটকে খুব বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয় না।’

রাজশাহী ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সিনিয়র স্টেশন ম্যানেজার আবু সামা বলেন, অগ্নি নির্বাপণের ক্ষেত্রে ফায়ার হাইড্রেন্ট অনেক বেশি কার্যকরী ও গুরুত্বপূর্ণ। এটা থাকলে অগ্নি নির্বাপণ কাজে অনেক বেশি সহায়ক হয়। আমাদের পানির প্রাপ্যতা ও পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করে। তবে অগ্নি নির্বাপণে কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পরেও ফায়ার হাইড্রেন্ট রাজশাহীতে দু’ একটা বাদে প্রায় সব বহুতল ভবনে নাই।

রাজশাহীর আরডিএ মার্কেটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে থাকা অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইসার) এর মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে। আরও কিছু অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইসার) ঝুলানো অবস্থায় পাওয়া যায় যার মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৩ সালে। যদিও গত ১৬ মার্চ আরডিএ মার্কেটে কিছু অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইসার) স্থাপন করা হয়েছে। তবে স্থাপন করা হলেও সেটার যথাযথ ব্যবহার জানেন না মার্কেটে থাকা দোকানদার ও কর্মচারীরা। আরডিএ মার্কেটের কিছু দোকানদার ও কর্মচারী অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইসার) ব্যবহার করা জানেন ও তাদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ করা আছে বলে দাবি করলেও তাদেরকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে সঠিক উত্তর দিতে পারেন নি তারা।

জানা গেছে, রাজশাহী আগে ছিল পুকুরের নগরী। রাজশাহীতে ছিল ৯৫২ টি পুকুর। যা কালের বির্বতনে বিলীন হয়ে গেছে। প্রভাবশালীরা পুকুর জলাশয়গুলো ভরাট করেছে। সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে। জলধার কমে যাওয়ার প্রভাবে অগ্নি নির্বাপণের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে আর দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়িয়েছে।

উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক বরেন্দ্র অঞ্চলের সমন্বয়কারী গবেষক শহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের প্রাকৃতিক জলাধারগুলো অগ্নি নির্বাপণে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতো। প্রাকৃতিক জলধারগুলো নষ্ট করে ফেলার ফলে অগ্নি নিরাপত্তা কমে গেছে এবং অগ্নি দুর্ঘটনার ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজশাহী প্রান্তিক বস্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ে রাজশাহীতে বসবাসকারীরা অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স রাজশাহী বিভাগের উপপরিচালক মো. ওহিদুল ইসলাম বলেন, বহুতল ভবন নতুন তৈরি হচ্ছে বা বিদ্যমান আছে এগুলোতে ফায়ার সেফটি প্ল্যান অনুমোদন দেওয়া হয়। রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) থেকে একটা অনুমোদন করে। অনুমোদন করার পরে এটা আর কেউ দেখে না। তখন ওরা ওদের নিজের খেয়াল খুশিমতো ভবন তৈরি করে। অগ্নি নির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা নাই। রাজশাহীতে ৯৯ শতাংশ ভবনই অনিরাপদ বলা যায়।

রাজশাহী বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শামীম আহম্মেদ বলেন, আমাদের মার্কেট (কাপড়পট্টি) ঝুঁকিপূর্ণ না। তারা (ফায়ার সার্ভিস) ইচ্ছা করে লিখে দিয়ে গেছে। এক বছর হলো কিছু হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, আমাদের দোকানে পানির ব্যবস্থা আছে। সব ব্যবস্থা আছে আমাদের।

এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) চেয়ারম্যান জিয়াউল হককে মোবাইলে কল করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। ফলে এ বিষয়ে তারা কোনো বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ