অনন্য দৃষ্টান্ত: ১ টাকা ভিজিটে চিকিৎসা দিচ্ছেন তিন ডাক্তার বোন ‘কটু কথায় কেঁদেছি, হাল ছেড়ে দেয় নি’

আপডেট: জানুয়ারি ১৮, ২০২৫, ৯:৫৫ অপরাহ্ণ

মাহাবুল ইসলাম


জন্মেছেন রাজশাহী নগরীর একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে। বাবার স্বপ্ন ছিলো তার সন্তানেরা মানুষের সেবায় নিজেদের বিলিয়ে দিবেন। সে স্বপ্ন পূরণেই গত দুই বছর ধরে নগরীর সাহেববাজার এলাকায় নিজ বাসার নিচে চেম্বার তৈরি করে দুস্থ-অসহায় রোগীদের মাত্র ১ টাকা ভিজিটে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তিন ডাক্তার বোন। যা শুধু রাজশাহীতে নয়; পুরো বাংলাদেশেই অনন্য!

২০২৩ সালে মাত্র এক টাকা ভিজিট নিয়ে রোগী দেখা শুরু হয়। রোগী দেখবেন এমবিবিএস চিকিৎসক সুমাইয়া বিনতে মোজাম্মেল। চিকিৎসক মেয়ের জন্য এ প্রচারপত্র বানিয়ে এনেছিলেন শিক্ষক বাবা মীর মোজাম্মেল আলী। আর এই প্রচারপত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে তা ভাইরাল হয়। এরপর অসহায় দুস্থ রোগীরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেও সমালোচনার ঝড় উঠেছিলো নেটিজনমহলে। ডা. সুমাইয়া বিনতে মোজ্জাম্মেলকে নিয়ে শুরু হয় ‘ক্রিটিসিজম’।

সমালোচনাকারীরা মন্তব্য করেছিলো, ‘এটা ব্যবসার ফন্দি। দু’দিন শেষেই বন্ধ হয়ে যাবে’। এমন নানা ব্যাঙ্গাত্মক কথা খোদ নিজের কয়েকজন শিক্ষকদের থেকেও শুনেছিলেন ডা. সুমাইয়া। তবে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তিন ডাক্তার বোন পালাক্রমে দুস্থ ও অসহায় রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

রাজশাহীর চিকিৎসক সুমাইয়া বিনতে মোজাম্মেল বলেন, এক টাকায় রোগী দেখার উদ্যোগটা আমার বাবার। তার ইচ্ছেতেই আমি এটা শুরু করি। তখন এটা এতোটা ভাইরাল হবে ভাবি নি। আমার বাবা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মানুষের সেবায় আমাদের নিয়োজিত রাখার চেষ্টা করেছেন। আমাদের তিন বোনকে এভাবেই গড়ে তুলেছেন বাবা। কিন্তু সবচেয়ে বেশি খারাপ লেগেছে, যখন নেতিবাচক বিভিন্ন কথা শুনতে হয়েছে। এমনও দিন গেছে, রাতে কেঁদেছি।

‘কটু কথায় কেঁদেছি, কিন্তু হাল ছেড়ে দেয় নি’- এমন মন্তব্য করে ডা. সুমাইয়া বলেন, আমি ২০২০ সালে ইসলামি ব্যাংক মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করি। ২০২৩ সালে এই উদ্যোগটা শুরু করি। কিন্তু আমি রোগী দেখতে পারবো কি না? এমন প্রশ্নও অনেকে তুলেছেন। যা খুবই দুঃখজনক। অথচ আমি এখানে প্রাইমারি ট্রিটমেন্টটা দেয়। জটিল কোন সমস্যা হলে সে অনুযায়ী ডাক্তারদের কাছে রেফার্ড করে দিই।
তিনি বলেন, আসলে ভালো কাজে সমালোচনা থাকেই। সেটাকে এখন আর গায়ে মাখাই না। আমি ইসলামি ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এখন নিয়মিতই চেম্বার করছি। সাধারণ মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছি, তা কোন কিছুর বিনিময়ে কেনা সম্ভব না।

সুমাইয়া বলেন, আমরা তিন বোনই ডাক্তার। এরমধ্যে ডা. আয়েশা সিদ্দিকা জেনারেল ফিজিশিয়ান। উনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিবিএস করেছেন অনেক আগে। আরেকজন ডা. ফারজানা মোজাম্মেল। উনি ডেনটিস্ট। আমরা তিন বোন একেক দিন একেক বোন সময় দিয়ে থাকি। আর আমার বাবা একদম বিনা মূল্যে রোগী দেখতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি একটা প্রতিকী মূল্য রাখতে চেয়েছি।

বিনা মূল্যে রোগী না দেখার কারণ হিসেবে সুমাইয়া জানান, তার উদ্যোগে কয়েকজন মিলে করোনার সময় থেকে ‘দ্য ফাইভ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংগঠন পরিচালনা করছেন। সংগঠনের উদ্যোক্তা সদস্যদের নিজেদের আর্থিক সহায়তায় মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা নিয়ে কাজ করছে এ সংগঠন। তবে অনুদান না পাওয়ায় সবটাই তাদের নিজেদের ব্যয় বহন করতে হচ্ছে। এজন্য বর্তমানে তারা শুধু চিকিৎসা নিয়ে কাজ করছেন। শুধু যে বিনামূল্যে রোগী দেখছেন এমনটাই না। আর্থিক অসঙ্গতি আছে এমন মানুষদের সাধ্যমতো বিনামূল্যে ওষুধ সেবাও দিচ্ছেন।

তার শিক্ষক বাবা মীর মোজাম্মেল আলী বলেন, আল্লাহ আমাদের চলার মতো সম্পদ দিয়েছেন। আমার তিনটা মেয়ে। মেয়েদেরকে সুশিক্ষিত হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করে গেছি। তারা যখন আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে তখন গর্বে বুকটা উঁচু হয়ে ওঠে। আমি মানুষের জন্য কাজ করে গেছি। আদর্শ মানুষ তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছি। আমার মেয়েরাও কর্মজীবনে যাই করুক না কেন, তারা যেন অসহায় মানুষের জন্য কাজ করে, তাদের পাশে দাঁড়ায় এটাই আমার চাওয়া।