অনন্য মানবিক গুণসম্পন্ন কিশোর মুজিব এবং জাতির পিতা

আপডেট: মার্চ ১৭, ২০২৩, ১২:২৪ পূর্বাহ্ণ

ড. সুলতান মাহমুদ রানা:


কিশোরবেলা থেকেই মুজিব ছিলেন একজন মানবিক মানুষ। তিনি কখনই অনিয়মকে প্রশ্রয় দিতেন না। কিশোর বয়সে সহপাঠী আবদুল মালেককে স্থানীয় হিন্দুরা ধরে নিয়ে মারধর করে। তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে এর প্রতিবাদ করেন। অন্য বন্ধুদের নিয়ে মালেককে আটক অবস্থা থেকে মুক্ত করেন। এ ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়। পুলিশ আসে তাঁকে গ্রেপ্তার করতে। কাছের জনেরা এমনকি পুলিশ কর্মকর্তাও তাঁকে আড়ালে লুকিয়ে থাকার পরামর্শ দেন। তিনি সব অবজ্ঞা করেন। মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার হন। সাজানো মামলা আর মিথ্যে ঘটনা দিয়ে শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর জেলজীবন। পরবর্তীকালে অসংখ্যবার তাঁকে কারাবরণ করতে হয়েছে। তাঁর জীবনের মূল্যবান সময়গুলো কেটেছে কারাগারের অন্ধ কুঠরিতে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। এর মধ্যে স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ আমলে সাত দিন কারা ভোগ করেন। বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাভোগ করেন পাকিস্তান সরকারের আমলে।

অনুপম মানবিক হৃদয়ের অধিকারী এই কিশোরই পরবর্তীকালে হয়ে ওঠেন ইতিহাসের মহানায়ক। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, বাঙালির জাতির পিতা। শেখ মুজিবের পরিচয়Ñ তিনি বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রামের নেতা। তিনি বাঙালির সবচেয়ে আপনজনÑ তিনি বঙ্গবন্ধু। বাংলা ও বাঙালির নিখাদ বন্ধু; বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষের জন্য লড়াই করে জীবনের প্রায় ১৪ বছর কাটিয়েছেন নির্জন কারাগারে। বাংলার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে, শোষণ-বঞ্চনা-নির্যাতনমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে জাতির পিতার জানবাজি রেখে লড়াই সংগ্রাম করেছেন।

এক শতাব্দী আগের শৈশব আর এখনকার শৈশব তো এক নয়। এখনকার পরিবারগুলো ছোট ছোট। আগে ছিল বিশাল বড় যৌথ পরিবার। বঙ্গবন্ধুও বড় হয়েছেন বড় একটা পরিবারে। বিশাল বড় সেই পরিবারই হলো শেখ পরিবার। শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন ওই পরিবারের বড় ছেলে (নাতি-পুতিদের মধ্যে)। এক শতাব্দী আগে হলে কী হবে, বঙ্গবন্ধুর দাদার আমল থেকেই ওই পরিবারে পড়াশোনার প্রচলন ছিল। দাদা-নানা, দাদার বড় ভাই, বড় চাচা, বাবা- সবাই ছিলেন শিক্ষিত ও বিচক্ষণ। চতুর্থ শ্রেণিতেই মাকে ছেড়ে বঙ্গবন্ধু চলে আসেন শহরে। ভর্তি হন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে। সঙ্গে থাকতেন বাবা। এমনিতেও বাবার ভক্ত ছিলেন তিনি। বাবার গলা ধরে ঘুমাতেন।

১৯৩৪ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সেই অসুস্থ হন। দুর্বল হয়ে পড়ে হৃৎপিন্ড। চিকিৎসা করতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায়। দীর্ঘ দুই বছর চলল চিকিৎসা। তিনি লিখেছেন, ‘লেখাপড়া নেই, খেলাধুলা নেই, শুধু একটা মাত্র কাজ, বিকেলে সভায় যাওয়া। তখন স্বদেশি আন্দোলনের যুগ। মাদারীপুরের পূর্ণ দাস তখন ইংরেজের আতঙ্ক। স্বদেশি আন্দোলন তখন মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের ঘরে ঘরে।’ বঙ্গবন্ধুর বয়স তখন ১৬। নিয়মিত সভায় যেতেন বলে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন চেনা মুখ। ইংরেজদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন খুব। জনমানুষের অধিকার নিয়ে লড়ার বীজটা তাঁর বপন হয় ওই সময়গুলোতেই।

বাড়ি বাড়ি গিয়ে এক মুঠ করে চাল সংগ্রহ করে দরিদ্র শিক্ষার্থীদেও শিক্ষা-উপকরণ কিনে দেয়া হতো। মুষ্টি চাল ও সমিতির কারণে কিশোর বয়সেই এলাকার মধ্যমণি হয়ে ওঠেন শেখ মুজিবুর রহমান। সভা-সমিতিতে তাই ডাক পড়ত ঘন ঘন।

কৈশোরে এবং তরুণ বয়সে বঙ্গবন্ধুর মানবিক দিকগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। তিনি অক্লান্ত শ্রম দিয়ে নিঃস্বার্থভাবে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। মানুষের প্রতি এমন ভালোবাসা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লালন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। জনগণই ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের অন্তপ্রাণ। মানুষের দুঃখে তাঁর মন কাঁদতো। কখনো পদ-পদবি বা ক্ষমতার লোভ বঙ্গবন্ধুকে তাঁর লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। চারিত্রিক দৃঢ়তা, সততা, মানবিকতা এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসা বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বঙ্গবন্ধুর একটি ব্যক্তিগত নোটবুকে লেখা তাঁর একটি উক্তিই স্পষ্ট করে দেয় মানুষের প্রতি তাঁর অফুরন্ত ভালোবাসা ও মানবতা। তিনি লিখেছিলেন, “একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সাথে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।”

তিনি বাল্যকালে নিজের পড়ার বইও মাঝে মাঝে গরিব বন্ধুদের দিয়ে দিতেন। গরিব ছেলেদের ছিন্নকাপড় দেখলে নিজের পরনের পোশাক পর্যন্ত দিয়ে দিতেন। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর জীবনের দুটি ঘটনা উল্লেখ করা প্রয়োজন। ১. শেখ মুজিবুর রহমান তখন কিশোর। পড়াশোনার জন্য থাকেন গোপালগঞ্জ শহরে। তিনি গ্রামে গেলেন কয়েক দিনের ছুটিতে। সে বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ভালো ফসল হয়নি। গ্রামে দুর্ভিক্ষাবস্থা। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতে বাধ্য হয়। তিনি দরিদ্র মানুষের দুঃখ-কষ্ট পুরো গ্রাম ঘুরে দেখলেন, যা কিশোর মুজিবের কোমল হৃদয়কে আলোড়িত করল। বাড়ি ফিরে পিতার অনুপস্থিতিতেই গোলা থেকে ধান-চাল নিয়ে তিনি গরিব মানুষের মাঝে বিতরণ করলেন। পিতা বাড়ি এসে সব শুনলেন, দেখলেন। মুজিব এসে অকপটে বললেন, অভাবগ্রস্ত মানুষের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে তিনি নিজেদের গোলার বাড়তি ধান তাদের মধ্যে বিতরণ করেছেন, তাদের বাঁচার ব্যবস্থা করেছেন। এ থেকে কিশোর বয়সেই মুজিবের সংবেদনশীল হৃদয় ও মানবিক মূল্যবোধের পরিচয় পাওয়া যায়।

২. অন্য এক দিনের একটি ঘটনা বঙ্গবন্ধুর পিতাকে হতহ্বিল করেছিল। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়ার সময় তিনি স্কুলের শিক্ষক বসুরঞ্জন সেনগুপ্তের বাসায় প্রাইভেট পড়তেন। একদিন সকালে তাঁর বাড়ি থেকে পড়া শেষ করে আসার পথে খালি গায়ে থাকা এক বালককে দেখলেন। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে ছেলেটি বলল, তার গায়ে পরার মতো কিছু নেই। সঙ্গে সঙ্গে মুজিব নিজের গায়ের গেঞ্জি খুলে ওই ছেলেকে দিয়ে দেন। বাড়ি ফিরে আসেন চাদর গায়ে। বালকের কষ্ট সেদিন মুজিব সহ্য করতে পারেননি। বাল্যকালে পারিবারিক আবহের কারণেই শেখ মুজিব মানবপ্রেমী হয়ে ওঠেন।
তিনি চেয়েছিলেন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যÑ এ মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল তাঁর রাজনীতির মূলমন্ত্র। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এদেশের জনগণকে চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অধিকার থেকে বঞ্চিত করত, যা বঙ্গবন্ধুকে ভীষণ পীড়া দিত। জীবনের সুখ, স্বস্তি, আরাম-আয়েশ ত্যাগ করতে পেরেছেন মানুষের প্রতি ভালোবাসার জন্য।

জনসাধারণের সাথে তিনি কখনো মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেননি। তাঁর প্রতি সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। মানবিক গুণাবলির পাশাপাশি তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সাহসিকতার জন্য এদেশের আপামর জনসাধারণ তাঁকে সহজে আপন করে নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি কর্মে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সহনশীলতার পরিচয় বহন করে। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে মাত্র সাড়ে তিন বছরেই অসংখ্য জনকল্যাণধর্মী কাজ তিনি সম্পন্ন করেছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে চরম দারিদ্র্য এবং অর্থ ঘাটতি নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে পুনর্বাসন, খাদ্যসংকট ও দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা, সমাজ ও প্রশাসনকে আবার সচল করাসহ অসংখ্য চ্যালেঞ্জিং কাজ বঙ্গবন্ধু দূরদর্শী ও মানবিক নেতৃত্বের মাধ্যমে অতি অল্প সময়ে সম্পন্ন করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামোগুলো মেরামত করে পুনরায় চালু করাসহ দেশ পরিচালনার এমন কোনো ক্ষেত্র ছিল না, যেখানে বঙ্গবন্ধুর মানবিক হাতের ছোঁয়া লাগেনি। স্বাধীনতা অর্জনের পর যখন দেশের পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক মুক্তি প্রায় নিশ্চিত করেছিলেন তখনই এই মহান ব্যক্তিকে বুলেটের আঘাতে তাঁর প্রিয় জনগণের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

sultanmahmud.rana@gmail.com