অন্যরকম শিউলি

আপডেট: অক্টোবর ১৪, ২০১৬, ১১:৫০ অপরাহ্ণ

আলমগীর আখন্দ
এই শিউলি, তুমি এত সুন্দর করে সেজেগুজে শাড়ি পরে কোথায় যাচ্ছ?
বর্ষবরণে।
মনে হচ্ছে, বিয়ের পিঁড়িতে তোমার ডাক পড়েছে।
ভাই, তোর দুষ্টামি এখনও গেল না।
যাই হোক, সাথে কে কে যাচ্ছে তোমার?
কেউ না। আমি কি পথ-ঘাট চিনি না?
না, তা আর-কি বলছিলাম না।
তো কী বলতে চাস?
আজকার ছেলেগুলো একদম ভালো না। তাই একটু স্মরণ করালাম।
কেন, ছেলেরা আবার কী করেছে?
তুমি কি পত্রিকা পড় না কিংবা টেলিভিশনে সংবাদ শুনো না?
মাঝেমধ্যে একটু একটু।
যাও, চোখ কান খোলা রেখে যাও।
ওকে।

২.
সন্ধ্যায় সবাই মিলে বেরিয়ে পড়লাম অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে। হাঁটছি খুবই কৌতূহল নিয়ে। ঠিক সেই মুহূর্তে, সামনে মাথা তুলে দেখতে পেলাম একটি মেয়ে মাথা নিচু করে মুখ ঢেকে বাঁকা চোখে দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। মেয়েটিকে দেখেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠলো।
আমার সমুখে আসতে না আসতে তার পথ আগলে দাঁড়ালাম।
আরে শিউলি তুমি?
কী হয়েছে তোমার?
কোন উত্তর এলো না। প্রশ্ন করলাম আবার, আরে তোমার কাপড় ছেঁড়া কেন?
তার বুকে দিকেই তাকাতেই কলিজাটা ছ্যাঁত করে উঠলো। তার কাপড় থেকে বেরিয়ে আসছে কাঁচা রক্তের ঘ্রাণ। কাপড় সরে দেখতে পেলাম গলার নিচে বড় বড় নখের মতো দাগ। সেখান থেকে রক্ত মৃদু মৃদু ঝরছে। ঘটনাটা কারো বুঝতে আর বাকি রইল না।
কোন জানোয়ারে এমন করেছে তোমার?
এতক্ষণে একটি কথাই বেরিয়ে আসলো মুখ থেকেÑ এত বড় সর্বনাশ হয়ে গেল নিলয় ভাই। এ সমাজে বাঁচার অধিকার নেই আমার। বলেই দৌড় দিলো সমুখে।

৩.
অনেক খোঁজাখুঁজি পরেও ওই বখাটের আর খোঁজ পাইনি সে রাতে। পেলে হয়ত জানে মেরে ফেলতাম।
ফিরে আসতে না আসতে পাড়ায় পাড়ায় হৈ চৈ পড়ে গেছে। পথে পথে শুনা যাচ্ছে, পাড়ার জামে মসজিদের ঈমাম সাহেবের মেয়ে শিউলি নাকি দিনদুপুরে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। তার সমস্ত শরীর রক্তগঙ্গায় ভাসিয়েছে। সে নাকি উঠতেই পারছে না। এমন আরো অনেক অদ্ভুত কথাই আসছে কানে।
বাকরুদ্ধ হয়ে শুনা ছাড়া কিছুই বলার ছিল না আমাদের। তার দেহের ক্ষত-বিক্ষত দাগ আর তো ঢেকে রাখতে পারি না। তারপরও ভিতরটা কেন জানি বিশ্বাস করতে পারছে না। অনেক প্রশ্ন মাথায় নিয়েই তাদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম।

৪.
বাড়ির সকল সদস্যই লজ্জায় মুখ ঢেকে মুখে কাপড় গুঁজে কাঁদছে। আমাদের দেখে শিউলির মা এগিয়ে এসে জুড়িয়ে ধরে বলতে লাগলÑ একি হল আমার মেয়ের জীবনে।
আপনারা ভেঙে পড়বেন না। শিউলির কাছে সব শুনতে হবে।
শিউলি তখনও কিছুই খুলে বলতে পারছে না। সে বোবা হয়ে সব কা-কারখানা শুয়ে শুয়ে দেখছে আর অঝরে কাঁদছে। চোখ থেকে পানি গড়ে গড়ে পরছে মাটিতে। পাড়া-পড়শিরা সব ভীষণ টেনশনে পরে গেল। তারা বলাবলি করতে লাগলÑ মেয়েটার ভবিষ্যত কি হবে? আর এক পক্ষ কানাকানি করতে শুরু করলÑ যেমন চালাক মেয়ে তেমনি পেয়েছে চিরকলংকের সাজা। কেউ কেউ খারাপ দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করল। অনেকেই মৌলবিকে এবং তার পরিবারের মুখের থু থু ছুঁড়ে দিল। এভাবেই সবাই খারাপ ভাবতে লাগল।

৫.
বাড়ির উঠানে দিকে তাকিয়ে দেখি, এক দল ভদ্রলোক উচ্চস্বরে কী যেন বলাবলি করতে করতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। কেউ একজন বলে উঠলÑ এটা কি নসিব ঈমাম সাহেবের বাসা?
জ্বি।
উনি কোথায়? আর সবাই চুপচাপ কেন?
ওই তো মাথা নিচু করে বসে আছেন।
এই যে ঈমাম সাহেব, আপনাকে ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে যে?
এই তো একটু।
আপনার মেয়ে কোথায়?
আবারও ঈমাম সাহেবের বুকের ভিতরটায় কম্পন শতগুণে বেড়ে গেল। বিষণœ কষ্টে বললেন, কেন?
ডাকেন না আপনার মেয়েরে। সুলক্ষ্মী মেয়েটারে দুনয়নভরে দেখি।
তাদের এই কথা শুনে সবাই পাথর হয়ে গেল। আঙুল তুলে বললেন, ওই তো ওইখানে শুয়ে আছে। মেয়েটা মনে হয় আমার বোবাই হয়ে গেল।
কী বলছেন সাহেব?
আমরা তো ওর কাছেই এসেছি।
কী বলছেন আপনারা এসব? ও আপনাদের কী ক্ষতি করেছে?
ক্ষতি করবে কেন সাহেব। ও বড় উপকার করেছে।
সবাই চমকে গেল। কৌতূহলী হয়ে উঠল সবাই। এক সাথে জিজ্ঞেস করল, কিভাবে?
আপনার মেয়ে একটা শিশুর প্রাণ বাঁচিয়েছেন।
মানে?
কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না।
আপনারা জানেন, আজ পহেলা বৈশাখ। এই দিন উপলক্ষে নানা কর্মসূচি পালন করেছে বাজারের স্কুল। সন্ধ্যায় সংস্কৃতি অনুষ্ঠান শেষে সবাই যখন বাসায় ফেরার জন্যে তাড়াহুড়ো করছিলেন তখন রাস্তায় প্রচ- ভীড় ছিল। ওই সময় একটা ছোট ছেলে মার হাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মাকে খোঁজার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পরে রাস্তায় শিশুটি। ঠিক ওই মুহূর্তে অনেকগুলো চলন্ত গাড়ি ছিল রাস্তায়। একটু সামনে ফাঁক থাকায় গাড়ি ছাড়ল ড্রাইভার। মাকে দেখতে পেয়ে হুট করে দৌঁড় দিল ছেলেটি। ছেলেটির পাশেই ছিল আপনার মেয়ে। ছেলেটি গাড়িতে চাপা পড়ার উপক্রম হতেই আপনার মেয়ের নজরে পড়ে। সে ছুটে ছেলেটিকে বুকে নিয়ে রাস্তার বাম পাশে চলে যাওয়ায় একটা দ্রুতগামী ভ্যান গাড়ি এসে আঘাত করে বুকে। শিশুটি ছিঁটকে পড়ে রাস্তায়। পাকা পিচে পরে শিশুর মাথা ফেটে রক্ত স্রোত বয়ে যায় রাস্তায়।
আপনার মেয়ের বুকে পিঠেও স্পুকের আঘাত হানে অনেক।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, আপনার মেয়ে নাকি বলছে, আমি ওকে রক্ষা করতে পারলাম না! এই বলেই আপনার মেয়ে ঘটনাস্থান থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। তবে আমরা খোঁজ নিয়ে এসেছি ছেলেটির জ্ঞান ফিরে এসেছে।
সবাই একটু হেসে অবাক হয়ে গেল।
তাহলে এর এমন অবস্থা হল কী করে?
স্বচক্ষে ভয়ংকর দুর্ঘটনা দেখে সে ভড়কে গেছে। তাই হয়ত এমন হয়েছে। টেনশনের কিছুই নেই। একটু ঘুম পাড়লেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে ইনশাল্লাহ। আর ক্ষতস্থানের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা কর।
সবাই মুখেই হাসির ঝলক। ঈমাম সাহেব হাসি মুখে বললেন, ডাক্তারকে খবর দিয়েছি। এখনেই আসবেন।
তাহলে ভাইসব, আপনারা কারা?
আমরা মিডিয়ার লোক। ভাই, আপনাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। আপনারাই আমার এবং আমার পরিবারের সম্মান ও সুনাম বাঁচালেন…6...