বৃহস্পতিবার, ১ জুন, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
আইয়ুব আলী:
একজন প্রশিক্ষক তার শ্রেণিকে প্রাণবন্ত রাখতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। তার মধ্যে একটি হল, যেকোন ধারণা প্রশিক্ষণার্থী কিভাবে জানে, বুঝে বা ওই বিষয়ে কতটুকু উপলব্ধি করে, প্রথমেই তা ক্লাসে প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে জানতে চান। শেষে প্রশিক্ষক সেই বিষয়ের উপর একটা তাত্ত্বিক আলোচনা করেন। পরে সবার কাছে সেই বিষয়ের ধরণা স্পষ্ট করে দেন। কোন বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ কাউকে সেই বিষয়ে দক্ষ করে তোলে। সজীব আজকাল নিজেকে দিয়েই তা খুব ভালো উপলব্ধি করছে। সরকারি চাকরি না হলেও মনে তৃপ্তি নিয়ে এনজিও-র ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে চাকরি করছে মনের আনন্দে। সজিবকে এখন কাজের গতি আনতে এবং নিখুঁত ভাবে কাজ করতে প্রায়ই প্রশিক্ষণ নিতে হয়। গতমাসে সে একটা প্রশিক্ষণ শেষ করেছে। তাতে প্রশিক্ষক সজীবের কাছে জানতে চায় ‘সমস্যা’ কি? সজীব মনে মনে ভাবে কোন সমস্যার কথা বলবো! সমস্যা নাই কোথায়? সাহস করে বলে, সকালে আমার স্ত্রী রাইস কুকারে ভাত রান্না উঠিয়ে দেওয়ার পর বিদ্যুৎ চলে গেলে ভাত সঠিক সময়ে রান্না শেষ হয় না। এটাই সমস্যা। প্রশিক্ষক উত্তর দিলেন গুড, খুব ভাল, ধন্যবাদ আপনাকে। একই প্রশ্ন অন্য জনকে করলেন। বলছে, সকালে মোটরসাইকেল স্টার্ট দেয়ার সময় যদি মোটরসাইকেল স্টার্ট না নেয়, তাহলে স্টার্ট না নেয়াটা সমস্যা। অনেকে বলছে বিভিন্ন চাপে রাতে ঠিকমত ঘুম না হওয়াটা সমস্যা। এই রকম বিভিন্ন জনের বিভিন্ন সমস্যার কথা শুনে সবাইকে সমস্যা সম্পর্কে প্রত্যেকের উত্তর সঠিক বলে ট্রেইনার সম্মতি দিয়েছেন। শেষে ট্রেইনার তাত্বিক ভাবে বুঝিয়ে দিলেন। সমস্যা সেইটাই, কোন বিষয়ে আমাদের যে পরিমান প্রত্যাশা থাকে সেই প্রত্যাশা থেকে আমাদের প্রাপ্তিটুকু বাদ দেওয়ার পর আমরা সেই বিষয়ে কত পরিমান উদ্বিগ্ন হই সেই উদ্বিগ্নতাই হচ্ছে সমস্যা। গাণিতিক ভাষায় (প্রত্যাশা-প্রাপ্তি) – উদ্বিগ্নতা = সমস্যা। সজীব তার জীবনে চলার পথে হাজারও সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু কখনও সমস্যা কি সেটাই তার জানা হয়নি। সজীব সমস্যার এই তাত্বিক ছকে যখন চারিদিকে তাকাচ্ছে তখন সবই তার কাছে সমস্যা মনে হচ্ছে। গেল ফেব্রুয়ারি, খুব ভোরে সজীবের ফোন অপ্রত্যাশিত বেজে উঠলো। তার ঘুমের চরম বেঘাত ঘটলো।
ফোনটা হাতে নেওয়ার আগেই কোন অবিবেচক এত সকালে কল করছে বলে খুব বিরক্ত হল। কারণ সে প্রত্যাশা করেনি এই ভোরে তার ফোন বেজে উঠবে। সজীবের কাছে প্রথমে ঘুম ভেঙে যাওয়াটা সমস্যা মনে হল। যখন ফোনের অপর প্রান্ত থেকে জানানো হলো তার স্ত্রী খুব অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তখন আর ঘুম ভাঙা তার কাছে সমস্যা মনে হলো না। সজীবের মনের অবস্থা পাখির মতো উড়ে খুব তাড়াতাড়ি মেডিকেলে পৌঁছানো। এত সকালে বাস ঠিকঠাক পাওয়া যাবে না। আবার পাওয়া গেলেও বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে বস্তায় তুলা ভরার মত ঠেসে ঠেসে যাত্রী ওঠাবে। সময় বেশি অপচয় হবে। সবকিছু ভেবে সজীব মোটরসাইকেল নিয়ে রওনা দিল। ফাল্গুন মাস পড়লেও আবহাওয়া পরিবর্তন হয়েছে। সকালে কুয়াশার চাদর ঢেকে রেখেছে প্রকৃতিকে। মোটরসাইকেলের হেডলাইট জ্বালিয়েও দশ হাত সামনে কিছু দেখা যায় না। সজীবের মন পাগলা ঘোড়ার মত ছুটে চলেছে। ঘোড়া যেমন পায়ের নিচে পানি, কাদা, উচু নিচু যাহা হোক না কেন সব জায়গায় সমান গতিতে দৌড়াতে পারে। ঠিক সেইমত সজীবের মনের গতি খুব চরমে। বাস্তবে মোটরসাইকেল ১৫-২০ কি.মি. গতির বেশি চালাতে পারছেন না। বাস্তবে দশ পনের কিমি গতিতে চালানো যায় না। কুয়াশায় গতি বাড়াতে বাধা দিলেও সজীবের মোটরসাইকেল চালাতে সব থেকে বেশি কষ্ট হচ্ছে এবড়োথেবড়ো রাস্তার জন্য। রাস্তা দেখে তার কাছে মনে হচ্ছে শুয়োরের দল উদলে উদলে কচু ঘেচু খেয়েছে। মোটরসাইকেলের হ্যান্ডেল শক্ত হাতে ধরে চালানোর সময় তার বুকের সমস্ত যন্ত্রপাতি নড়ে ওঠছে।
রাস্তার অবস্থা হয়েছে মরা গরু শকুনে খুবলে খাওয়ার মত। মাঝে মাঝে রাস্তার ব্রিজগুলো দেখলে মনে হচ্ছে মাছ ধরা পলাইয়ের মুখের মত। রাস্তা প্রশস্ত হয়ে কিন্তু ব্রিজ প্রশস্ত করা হয়নি। খুব সুন্দর সরু করে মিলিয়ে দেয়া হয়েছে। অনেক কষ্টে হাসপাতালে পৌছার পর সজীব খুব উদগ্রীব সহজে মেডিকেলে ঢুকে তার স্ত্রী’র কাছে যাবে। মেডিকেলের গেটে জনসমাবেসের মত মানুষের চাপ। জন সমাবেশের মতই মাইকের তীব্র আওয়াজ কানের ভেতর ঢুকছে। আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় মেডিকেল। সারাদেশ থেকে হাজারও রোগী পিঁপড়ের সারির মত এই হাসপাতালেই আসেন। মাইকে অনবরত বলা হচ্ছে, গেটপাস ছাড়া কেউ ভেতরে প্রবেশ করবেন না। গেটে পৌছার পর সজীব গেটপাস ছাড়া মেডিকেলে ঢুকতে পারছেন না। তার মন দুধ দোহনের সময় বেধে রাখা বাছুরের মত ছটফট করছে। দুইশত টাকার বিনিময়ে দুইটা গেটপাস দেয়া হয়েছে। এখন সেই গেটপাস লাগবে। স্ত্রীর কাছে আছে তার শ্বাশুড়ি। বয়স্ক ব্যক্তি ভালো করে হাটতে পারে না। খুব কষ্টে গাইনী ওয়ার্ড থেকে এক কিলোমিটারের বেশি রাস্তা হেটে গেটে আসলেন। তাও সজীবের কোন মতেই গেট পার হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। গেটপাস একটা একজন ব্যক্তি ভিতরে আছেন। সেই গেটপাস দিয়ে আরেকজনকে ভিতরে নেয়া যাবে না।
কোন কৌশলে ভিতরে ঢুকে ভিড় ঠেলে ওয়ার্ডে পৌছার পর জানা গেল এই মুহূর্তে দুটি ওষুধ কিনে আনতে হবে। এবার গেটপাস হাতে নিয়ে সজীবের দৌড়। দুই কিলোমিটারের মত রাস্তা দৌড়ে মেডিকেলের মোড় থেকে ওষুধ কিনে নিয়ে দৌড় দৌড়। একটু পরে আবারও ওষুধ নিতে দৌড় মোড়ে। ফিরে আসার আগেই ফোন করে শ্বাশুড়ি জানাচ্ছেন, তাড়াতাড়ি আস রোগিকে বেড থেকে মেঝেতে নামিয়ে দিচ্ছে। আমি আসতে আসতে রোগিকে জোর করে মেঝেতে নামিয়ে দেয়া হল। কোন মতে একটা ভাড়ার বেড নেয়া হল। এবার পুরো সপ্তাহের ভাড়া অগ্রিম পরিশোধের জন্য যেতে হবে সেই এক কিলোমিটার হেটে ভর্তি কাউন্টারে। নিচ তলার ওয়ার্ড হওয়ার কারণে ড্রেনের গন্ধে স্ত্রীর বড় বোন সব সময় নাকে ওড়না পেচিয়ে রাখলেন। রাতে আর তিনি থাকতে পারলেন না। তার বোনকে রেখে বাড়ি চলে গেলেন। ওই ওয়ার্ডের গন্ধে তিনি এক গ্লাস পানি পান করতে পারেননি। ল্যাট্রিনের পরিবেশ ভাষায় বর্ণনা করার মত না। রাতে সজীবের ওয়ার্ডে থাকা হল না। ওয়ার্ডের পাশেই সজীব রাত কাটিয়ে দিবে। সে একটা পাটি কিনে আনলো। কিন্তু নীচ তলার বারান্দায় উটকোগন্ধ আর উপর তলা থেকে ময়লার ছিটা গায়ে পড়ছে। বাধ্য হয়ে দোতালার
বারান্দায় গেল। এরই মধ্যে সজীবের স্ত্রী টয়লেটে যাওয়ার জন্য সজীবকে ফোন করবেন কিন্তু তার ফোনে চার্জ নেই। ফোন বন্ধ হয়ে গেছে। ফোনে চার্জ দেয়ার মত কোন জায়গা সজীব খুঁজে পেল না। মশার কামড়ে সারারাত প্রায় নির্ঘুম কাটিয়ে সকালে ওয়ার্ডে ঢুকে জানতে পারলেন সজীবের শ্বাশুড়ি কাজে না আসায় পাশের বেডের একজনের সহযোগিতা নিয়ে তার স্ত্রী টয়লেটে গেছেন। আশেপাশের বারান্দায় খুঁজেও সজীবকে তার শ্বাশুড়ি পাননি। সকালে গিয়ে শুনার পর মন ভিশন খারাপ। এরই মধ্যে আয়া বা ক্লিনার এসে বলছেন, আপনাদেরগামলার ময়লা এই পাত্রে ঢেলে যান। গামলা খালি হাতে ধরার মত ছিল না। সজীব বললেন, আপনি একটু ঢেলে নেন। ওরে বাপরে আয়ার কি মেজাজ! সজীব শুধু বললো, আপনার দায়িত্ব কি? এই কথা শুনে তাদের আর গামলা দিলেন না। কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল সকালের নাস্তা নেওয়ার জন্য ডাকছেন। সেখানে গিয়ে সজীব লক্ষ্য করলেন, একজন নার্স তালিকা থেকে নাম কাটছেন আর ওই আয়া নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করছেন। বাহ্ তখন সজীব বুঝতে পারলেন, কোন ব্যক্তি যদি তার দায়িত্বের চেয়ে বড় দায়িত্ব পালন করেন তখন নিজের দায়িত্ব ভুলে যান। বিধায় নোংরা কিছু পরিস্কার করতে তার মনে কষ্ট। এখানেই শেষ নয়। কারো ক্যাথেডার লাগানোর প্রয়োজন হলে ডাক পড়ছে সেই আয়াদের! এখন বুঝেন আমাদের সমস্যা কোথায়? দুপরে ছুটি দিবে। পেইং বেডের টাকা ফেরত নিতে সেই ইমার্জেন্সিতে যেতে হবে। সাথে গেলেন আয়া। সেখানে টাকা ফেরত দেয়া হয় না। যেতে হবে একাউন্টস রুমে। আয়া সাথে তার রেজিস্ট্রার নিয়ে এসেছেন। টাকা ফেরত পেয়ে ফিরার সময় বলছেন, আমি তো আপনাকে চিনিয়ে আনলাম। আমরা টাকা পেয়েই থাকি। টাকা দেন। সজীব বলে, পরে ট্রলিতে করে বাহিরে যাওযার পর দিব। ট্রলি নিয়ে বাহিরে যাওয়ার পর এক’শ টাকা দিলে সে আর নিবেন না। তার দাবি দু’শ টাকা। বক্শিশের টাকার বেশি না দেওয়ায় তার মুখে শুনতে হল অশ্রাব্য বাণী! আর এর মধ্যে কার সাথে যে কার ধাক্কা লাগছে বুঝার উপায় নেই।