শুক্রবার, ২৮ মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৪ চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
সোনার দেশ ডেস্ক :
এ যেন দাবার চালে শত্রুকে মাত দেওয়ার চেষ্টা। সেই রাস্তায় দুরন্ত গতিতে ছুটছে চিন! স্থল-জল-বায়ু— সব ধরনের সৈন্যশক্তিতেই আমেরিকাকে ছাপিয়ে যেতে একের পর এক পদক্ষেপ করছে বেজিং। তারই নবতম সংযোজন হল ‘সুপার পেন্টাগন’ নির্মাণ।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশাল জমির উপর রয়েছে পঞ্চভুজাকৃতি একটি ভবন। প্রতিরক্ষা সদর দফতর হিসাবে এটিকে ব্যবহার করে আমেরিকার সরকার। ভবনটি পঞ্চভুজাকৃতি হওয়ায় এর নাম পেন্টাগন।
ইউরেশিয়ান টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্প্রতি পেন্টাগনের ধাঁচেই যুদ্ধকালীন সামরিক কম্যান্ড সেন্টার তৈরিতে হাত দিয়েছেন ড্রাগনভূমির প্রেসিডেন্ট তথা চেয়ারম্যান শি জিনপিং। নির্মাণকাজ শেষ হলে এটি বিশ্বের বৃহত্তম সামরিক কম্যান্ড সেন্টার হবে বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে।
আমেরিকার গোয়েন্দা সূত্রে খবর, চিনা সামরিক কম্যান্ড সেন্টারটি পেন্টাগনের চেয়ে আকারে অন্তত ১০ গুণ বড় হতে চলেছে। পশ্চিম বেজিঙে এটি নির্মাণের পরিকল্পনা করেছেন প্রেসিডেন্ট শি। চিনা কমিউনিস্ট পার্টির সামরিক এবং অসামরিক নেতা-নেত্রীদের জন্য সেখান পরমাণু হামলা প্রতিরোধকারী বাঙ্কার থাকবে বলে জানা গিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা রিপোর্টে এটাও বলা হয়েছে, যুদ্ধের সময়ে কম্যান্ড সেন্টার হিসাবে ওই বিশাল ভবনটিকে ব্যবহার করবে চিনের পিপল্স লিবারেশন আর্মি বা পিএলএ। ইতিমধ্যেই কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা ওই ‘সুপার পেন্টাগন’-এর ছবি প্রকাশ্যে এনেছে ওয়াশিংটন।
কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিগুলি বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, রাজধানী বেজিং থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে সুবিশাল ভবনটি তৈরি করছে চেয়ারম্যান শি-র প্রশাসন। প্রায় ১,৫০০ একর জমির উপর গড়ে উঠছে ওই সামরিক কম্যান্ড সেন্টার। ছবিতে নির্মীয়মাণ ভবনটির মধ্যে বাঙ্কার তৈরির জন্য খোঁড়া বেশ কয়েকটি গভীর গর্ত স্পষ্ট ভাবে দেখা গিয়েছে।
পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলির দাবি, গত বছরের মাঝামাঝি থেকে ওই প্রকল্পটির কাজ শুরু করে চিনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। এর পোশাকি নাম ‘বেজিঙের সেনা শহর’ (বেজিংস্ মিলিটারি সিটি) রাখা হয়েছে। সম্পূর্ণ ভবনটি নির্মাণে প্রেসিডেন্ট জিনপিং কত টাকা খরচ করছেন, তা অবশ্য জানা যায়নি।
আমেরিকার গোয়েন্দাদের দাবি, ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার তৈরির জন্য পাঁচ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে চলছে প্রকল্পের কাজ। এর জন্য অন্তত ১০০টি ক্রেন জাতীয় যন্ত্রকে কাজে লাগিয়েছেন ড্রাগনভূমির ইঞ্জিনিয়ারেরা। এ ছাড়া অন্যান্য উন্নত যন্ত্রও ব্যবহার করা হচ্ছে।
২০২৭ সালে শতবর্ষে পা দেবে চিনা লালফৌজ। ঠিক তার আগে বেজিঙের এই ‘সুপার পেন্টাগন’ নির্মাণকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের কথায়, এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের দুনিয়াব্যাপী ‘সুপার পাওয়ার’ তকমা ভাঙতে চাইছেন চেয়ারম্যান শি।
প্রসঙ্গত, ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার উড়িয়ে দেওয়ার মারণাস্ত্র রয়েছে আমেরিকার সেনাবাহিনীর হাতে। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, সেটা মাথায় রেখেই সামরিক কম্যান্ড সেন্টারে বিশেষ ধরনের বাঙ্কার নির্মাণে হাতে দিয়েছে পিএলএ। এর সাহায্যে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে পারবে তারা।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, প্রথমত যুদ্ধের সময়ে পিএলএর পদস্থ সেনাকর্তা এবং চিনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ সামরিক কম্যান্ড সেন্টারের ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে বসে যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের ফৌজ বাঙ্কারগুলি ওড়াতে এলে সেখানে নিরাপত্তা পাবেন তাঁরা।
সম্প্রতি ফিন্যানশিয়াল টাইম্সের কাছে মুখ খোলেন আমেরিকার এক সাবেক গোয়েন্দা কর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তির দাবি, ‘‘২০২৭ সাল নাগাদ তাইওয়ান আক্রমণ করবে চিন। সেই কথা মাথায় রেখে অত্যন্ত হিসাব করে প্রতিটা পদক্ষেপ নিচ্ছেন চেয়ারম্যান শি।’’
যুক্তরাষ্ট্রের ওই প্রাক্তন গোয়েন্দা কর্তা আরও জানিয়েছেন, ‘‘বেজিং যদি কোনও কিছুকে ভয় পেয়ে থাকে, তবে সেটা হল আমেরিকার পরমাণু অস্ত্র। ড্রাগনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব মনে করে তাইওয়ানকে বাঁচাতে তাঁদের উপর আণবিক হামলা চালাবে ওয়াশিংটন। এর থেকে বাঁচতে ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারগুলি তৈরি করছে চিনা পিএলএ।’’
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ‘চিন ২০৪৯: একটি ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণ’ শীর্ষক গবেষণাপত্র প্রকাশ করে ‘রাশিয়ান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিল’ বা আরআইএসি। সেখানে বলা হয়েছে, আগামী দু’দশকের মধ্যে বিপুল সংখ্যায় বিমানবাহী রণতরী, ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র এবং উভচর হামলাকারী যানে সেজে উঠবে পিএলএ।
২০৪৯ সালে শতবর্ষে পা দেবে গণপ্রজাতন্ত্রী চিন। এই সময়ের মধ্যে বেজিং ‘বিশ্বমানের সামরিক বাহিনী’ তৈরি করতে সক্ষম হবে বলে জানিয়েছে মস্কো। বর্তমানে ‘হাইপারসনিক’ (শব্দের পাঁচ গুণের থেকে বেশি গতি সম্পন্ন) ক্ষেপণাস্ত্র এবং সামরিক প্রয়োজনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই) প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন ড্রাগনভূমির প্রতিরক্ষা গবেষকেরা।
এর পাশাপাশি পারমাণবিক হাতিয়ারের সংখ্যাও ক্রমাগত বৃদ্ধি করে চলেছে চিন। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের দাবি, ২০৩৫ সালের মধ্যে ১,৫০০ আণবিক ‘ওয়ারহেড’ তৈরি করে ফেলবে বেজিং।
‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর প্রকাশ করা সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ড্রাগন ফৌজের হাতে ছিল আনুমানিক ৫০০ পারমাণবিক অস্ত্র। ওয়াশিংটন ও মস্কোর হাতে থাকা এই ব্রহ্মাস্ত্রের সংখ্যা যথাক্রমে ৩,৭০৮ এবং ৪,৩৮০।
এর পাশাপাশি, পরমাণু শক্তিচালিত এবং আণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ডুবোজাহাজের বহর ক্রমাগত বৃদ্ধি করছে চিন। অতি গোপনে ড্রোনবাহী রণতরী নির্মাণের দিকে নজর দিয়েছে বেজিং। এ ছাড়াও বায়ুসেনাকে আমেরিকার সমকক্ষ করে তোলার ইচ্ছা রয়েছে ড্রাগনের।
গত শতাব্দীতে ‘শীত যুদ্ধ’ চলাকালীন পশ্চিম পাহাড়ের কোলে সামরিক সদর দফতর তৈরি করে চিনের তৎকালীন সরকার। এত দিন সেখান থেকেই চলত পিএলএর যাবতীয় কাজকর্ম। কিন্তু, বাহিনী কলেবরে বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন সামরিক কম্যান্ড সেন্টারের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বলে জানা গিয়েছে।
গত বছরের ১৮ ডিসেম্বরে চিনের সৈন্যশক্তি সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট আমেরিকার প্রতিরক্ষা সদর দফতরে জমা পড়ে। সেখানেও বেজিং যে সামরিক দিক থেকে ‘সুপার পাওয়ার’-এর তকমা পেতে চাইছে, তা স্পষ্ট করা হয়েছে। তবে ড্রাগন ফৌজের অভ্যন্তরে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ছে বলেও রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে।
চিনের সুবিশাল সামরিক কম্যান্ড সেন্টার নির্মাণের খবরে নয়াদিল্লির কপালেও পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। কারণ মাঝে মধ্যেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় (লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা এলএসি) আগ্রাসী মনোভাব দেখিয়ে থাকে বেজিং। ফলে গোটা বিষয়ের দিকে কড়া নজর রাখছেন এ দেশের গোয়েন্দাকর্তারাও।
তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার অনলাইন