আত্মশুদ্ধরি মাস রমজান

আপডেট: মার্চ ২৬, ২০২৩, ১২:১২ পূর্বাহ্ণ

ড. মাওলানা ইমতিয়াজ আহমদ:


আত্মশুদ্ধির মাস রমজান। আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের মাস রমজান। আল্লাহ তায়ালা এই রমজান মাসে দীর্ঘ এক মাস রোজা ফরজ করেছেন। রোজা ফরজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।- (সূরা বাকারা-১৮৩)

এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রোজা বা সিয়াম সাধনা ফরজ করার উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন। এতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, সিয়াম সাধনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া অর্জন। তাকওয়া মানে আল্লাহভীতি। রমজান মাসে রোজার মাধ্যমে তাকওয়ার অনুশীলন হয়। যাতে করে এই তাকওয়ার শিক্ষা নিয়ে সারা বছর তাকওয়ার ওপর চলা যায়। রমজানে তাকওয়ার অনুশীলনের রূপরেখা হচ্ছে- তীব্র গরমে প্রচ- পিপাসা। একলা ঘরে সামনে ঠা-া পানি। কেউ নেই। তবুও ওই পানি পান করেন না রোজাদার ব্যক্তি। কেননা কেউ না দেখুক, আল্লাহতো দেখছেন। এটাই আল্লাহভীতি। রোজা অবস্থায় তিনটি হালাল বস্তু নিষিদ্ধ হয়ে যায়। সাময়িক কিছু সময়ের জন্য আল্লাহর ভয়ে আমরা হালাল বস্তু থেকে দূরে সরে থাকি, তাহলে সারা জীবনের জন্য হারাম বস্তু থেকে আমাদের কেমন দূরে থাকা উচিত?

সাহাবী উবাই বিন কাব রা.কে হযরত উমর রা. তাকওয়ার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি সরাসরি উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি কি এমন পথে কখনো হেঁটেছেন যার দুই পার্শ্বে কাঁটাযুক্ত গাছ আছে? উত্তরে হযরত উমর ফারুক রা. বলেন, হ্যাঁ, হেঁটেছি। উবাই বিন কাব রা. জানতে চাইলেন, কীভাবে হেঁটেছেন? উমর ফারুক রা. বললেন, এমন ভাবে হেঁটেছি, যাতে শরীরে কোনো কাঁটা না ফুটে। উবাই বিন কাব রা. বললেন, এটার নামই তাকওয়া। অর্থাৎ জীবন চলার পথের দুই ধারে অসংখ্য পাপের কাঁটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এ পথ চলার সময় এমন সাবধানে হাঁটতে হবে, যাতে করে কোনো পাপের কাঁটা শরীর স্পর্শ না করে। এভাবে পাপ থেকে গা বাঁচিয়ে চলার নামই তাকওয়া। আমাদের চিন্তা করা উচিত, আমাদের জীবনে এই তাকওয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে কি?

বড় বড় গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার পাশাপাশি ছোট ছোট ও সাধারণ গোনাহ থেকেও বেঁচে থাকার নাম তাকওয়া ও খোদাভীতি। জীবন চলার পথে দুর্গম কণ্টকাকীর্ণ পথযাত্রীর মতো অতি সাবধানে পদক্ষেপ ফেলতে হবে। ছোট গোনাহকে ছোট ও সাধারণ মনে করে অবহেলা করা যাবে না। বরং সেগুলো থেকেও সযতেœ দূরে থাকতে হবে। কারণ, ছোট ছোট শিলাখন্ড মিলেই তো সুবিশাল পর্বতের রূপ ধারণ করে। তাকওয়া বা খোদাভীতির মোদ্দাকথা হল, অন্তঃকরণে সর্বাবস্থায় আল্লাহর ভয় জাগরুক রাখা। শরীয়তের বিধিনিষেধ পরিপূর্ণরূপে মেনে চলা। আল্লাহর সন্তুষ্টির সামনে নিজেকে পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করা। পরকালের জন্য পূর্ণাঙ্গরূপে প্রস্তুতি গ্রহণ করা।

যিনি তাকওয়া অর্জন করেন, তাকে মুত্তাকী বলা হয়। মুত্তাকীর পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন- ‘যারা অদৃশ্য বিষয়ে বিশ্বাস করেন, নামাজ কায়েম করেন, আমি যা রিজিক দিয়েছি তা হতে খরচ করেন, আপনার প্রতি এবং পূর্বে যা নাজিল হয়েতে তাতে বিশ্বাস করেন এবং আখেরাতে দৃঢ়বিশ্বাস স্থাপন করেন।’-সূরা বাকারা। মুত্তাকীদের সম্বন্ধে আল্লাহ তায়ালা বলেন- এরাই তাদের রবের হেদায়েতের ওপর প্রতিষ্ঠিত, এরাই সফলকাম।-সূরা বাকারা, ৩-৪। অপর স্থানে মুত্তাকীদের পুরস্কার হিসেবে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা দিয়েছেন- নিশ্চয় মুত্তাকীদের জন্য তাদের রবের কাছে রয়েছে নেয়ামতপূর্ণ জান্নাত।-সূরা কলম, ৩৪। সেই মুত্তাকী হওয়ার মাস রমজান।

তীব্র গরমে প্রচন্ড পিপাসায় ঘরের মাঝে হাতের কাছে ঠান্ডা পানি থাকাসত্ত্বেও রোজা অবস্থায় তা স্পর্শ করি না, আল্লাহর ভয়ে। কেউ না দেখলেও তিনি তো দেখছেন। এ ভয়টা যদি জীবনের সর্বত্র সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারি তাহলে আমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারব। জগতের যত পাপ আছে, যত অন্যায়, অনাচার ও দুর্নীতি আছে সবক্ষেত্রেই যদি এভাবে আল্লাহকে ভয় করি যে, কেউ না দেখলেও তিনি দেখছেন- তাহলে আমাদের দ্বারা আর কোনো অন্যায় দুর্নীতি হবে না। রমজান থেকে যদি প্রকৃত তাকওয়ার শিক্ষা নিয়ে ব্যবহারিক জীবনের সর্বত্র প্রয়োগ করতে পারি, তাহলে ‘দুদক’ নামের কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো প্রয়োজনই থাকবে না। যারা রোজার সকল নিয়মকানুন মেনে রোজা রাখছি, তারাই আবার দুর্নীতি-অন্যায় অনাচার করছি। এর মূল কারণ রোজার মূল উদ্দেশ্য তাকওয়ার শিক্ষা আমরা গ্রহণ করছি না। রোজা পালনে ইখলাসের বিষয়টাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে রমজান মাসে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে রোজা পালন করবে, তার অতীতের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। হাদীসে বর্ণিত ইহতিসাবের অর্থ ইখলাসের সাথে রোজা পালন করতে হবে। আমরা কি সেটা পালন করছি? আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাকওয়া অর্জন করার তাওফীক দান করুন। যাতে করে আমরা তাকওয়ার ভিত্তিতে সকল প্রকার অন্যায়-অনাচার ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করতে পারি।
লেখক: পেশ ইমাম, বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট জামে মসজিদ, রাজশাহী