আত্মহত্যা বায়োলজিক্যাল না সামাজিক সমস্যা

আপডেট: এপ্রিল ২৯, ২০২৩, ১২:২৯ পূর্বাহ্ণ

প্রিন্সিপাল মজিবুর রহমান:


আমার বাল্যবন্ধু, আব্দুল জব্বার। ছোট বেলা থেকেই আমরা একসঙ্গে বড় হয়েছি, স্কুলে গেছি, খেলাধুলা করেছি। আজকে সে নেই। স্বাভাবিক মৃত্যু, আত্মহত্যা নয়। বলবেন, আত্মহত্যা নয়তো তাকে নিয়ে এখানে টানা-হিচড়া কেন? এজন্য যে, ছোট বেলা থেকেই সে অনেক দুঃখ-কষ্টে বড় হয়েছে, দূর আত্ময়ের কাছে। একজন শিশুর বাবা, মা, ভাই-বোন, দাদা-দাদি না থাকলে যা হয়, তার তাই হয়েছে। সে উচ্ছৃখলতা শিখেছে, অস্বভাবী হয়ে উঠেছে। আচরণগত শিক্ষা বা সৎ পরামর্শ সে কিছুই পায়নি, লেখা পড়াতেও বেশিদূর এগোতে পারেনি, ছিটকে পড়েছে। এটি তার ভাগ্য না কী অন্য কিছু? ভাগ্যই যদি হয়- তবে সে ভাগ্যের জন্য দায়ী কে? বিষয়টি আমাকে আজও ভাবায়। বন্ধু আব্দুল জব্বার সম্পর্কে এতোকিছু বলা এজন্য যে, তার বাবা অনেক আগেই প্রয়াত হয়েছেন শুনেছি, দেখিনি। দেখেছি শিশু আব্দুল জব্বারকে রেখে প্রথমে তার ভাই এবং পরে তার মা আত্মহত্যা করেছেন। একটু একটু করে মনে পড়ে বন্ধুর মায়ের লাশ গলায় দড়ি পেচানো, ঝুলছিল। করুণ কাহিনি, করুণ পরিণতি একটি ছোট্ট শিশুর জন্য। আমার বাবার মুখে শুনেছি, জমিজমা, ঘরবাড়ি নিয়ে তাদের বিরোধ ছিল। অনেক অত্যাচারিত ছিল, অনেক চাপের মুখে ছিল। তাই তারা এ কাজটি করে থাকতে পারে। কিন্তু ঘটনাটি তো গ্রামেই ঘটল, সমাজেই ঘটল। সমাজের লোকদের কি কিছুই করার ছিলনা? শিশু জব্বারের জীবন নষ্ট হয়ে গেল কেন, সমাজ কি উত্তর দিবে?
ইদানিং সমাজে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশে বছরে গড়ে ১০ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করছে। পৃথিবীতে এর পরিমাণ বছরে ৯ লাখেরও বেশি। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের আত্মহত্যার ৭২ শতাংশই কম বয়সী এবং শিক্ষার্থী। কিন্তু কেনই বা কমবয়সী ছেলে-মেয়েরা এই চরমপন্থা বেছে নিচ্ছে? এতো আত্মহত্যা বেড়ে যাচ্ছে! তাই আত্মহত্যার আর্থসামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক কারণ অনুসন্ধানের সময় এসেছে। মূলতঃ হতাশা থেকেই মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। এক্ষেত্রে পরিবারের অবহেলা, সম্পর্কের টানাপোড়েন, একাকিত্ব, প্রেমে ব্যর্থতা, বিষণœতা, স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থতা, মান-অভিমান, ক্ষোভ, অপমান, আত্মকেন্দ্রিকতা, সুবিধাবাদিতা, যান্ত্রিকতা, অভাব-অনটন প্রভৃতি কারণে বিচ্ছিন্নতাবোধ অনুভব করে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। ফলে এসকল সামাজিক কারণেই দেশে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে।
৪ আগস্ট ২০২২ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশ, এক উচ্চ শিক্ষিতা নারী আত্মহত্যার পূর্বে সুইসাইড নোটে লিখে গেছেন, ‘আমার মৃত্যুর রহস্য উদঘাটিত হলেও ব্যস্ত দুনিয়ার সবাই আবার ব্যস্ত হয়ে যাবে। অর্থাৎ সমাজের প্রতি তার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
সম্প্রতি একটি শহরে আত্মহত্যার পূর্বে একজন কমবয়সী গৃহবধু লিখে গেছেন, ‘আমার মৃত্যুর জন্য আমার স্বামী দায়ী নয়। তবে দায়ী কে ? সমাজ!
১৯৬১ সালে মাত্র ৬২ বছর বয়সে আত্মহত্যার আগে নোবেল জয়ী ও আমেরিকার বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক ‘আর্নেস্ট হেমিংওয়ে’ লিখেছেন, ‘মানুষ ধ্বংস হতে পারে কিন্তু পরাজিত হতে পারেনা। অর্থাৎ তিনি ধ্বংস হয়েছেন কিন্তু সমাজের কাছে পরাজিত হননি এটি বলাই যায়।
বিখ্যাত নাট্যকার নির্মাতা আতিকুল হক চৌধুরীর ১৮/১৯ বছরের ছেলে, যে বড়দের দেখলে লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খেত। সে একদিন আত্মহত্যা করে বসল। এরকম একজন ভদ্র ছেলে কী করে আত্মহত্যা করল?
১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর চলন্ত ট্রাম গাড়িতে জীবন দিল একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। বাংলা ভাষার একজন অসাধারণ কবি। তাঁর পরিবার থেকে জানা যায়, পারিবারিক ভাবে তিনি সুখি ছিলেন না। তিনি চরম অর্থকষ্টে ছিলেন। বাধ্য হয়ে এক নর্তকীকে নিজ বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন। মানুষটির দেহ ট্রামের ক্যাচারের মধ্যে ঢুকে থেঁতলে যায়। এই মানুষটি আর কেউ নন ‘কবি জীবনানন্দ দাস’।
আমার বাল্যবন্ধুর মা তার সুইসাইড নোটে লিখেছিলেন, ‘আমাকে বাঁচতে দেয়া হলনা।’ অর্থাৎ এখানে তার বাঁচার আকুতি প্রকাশ পায়। তাহলে কে তাকে বাঁচতে দেয়নি, সমাজ?
পত্রিকায় প্রকাশ, একজন অবিবাহিত কলেজ ছাত্রী আত্মহত্যার পূর্বে লিখে গেছেন, ‘আমার মতের যখন মূল্যই নেই তবে কী নিয়ে বাঁচব? এখানে পরিবার বা সমাজের প্রতি তার অভিমান এবং হতাশা প্রকাশ করে গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদার মতে আত্মহত্যা একটি সামাজিক সমস্যা। অর্থাৎ কোনো না কোনো সামাজিক কারণেই মানুষ আত্মহত্যা পথ বেছে নেয়। সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতিই একজন মানুষকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। জিনাত হুদার মতে এটিকে বায়োলজিক্যাল হিসেবে দেখা হয়না। তবে এক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানীগণের মত কী? অথবা বায়োলজিক্যাল বিষয় এর পেছনে ক্রিয়াশীল কিনা কিংবা কতটুকু ক্রিয়াশীল তা আরও গবেষণার বিষয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম বলেন, প্রত্যেক মানুষের জীবনে একটি খারাপ সময় আসে বা আসতেই পারে। এবং তা একসময় কেটে যায়। তাই খারাপ সময়টিকে মোকাবিলার ক্ষমতা বাচ্চাদেরকে শেখাতে হবে। তিনি আরও বলেন, ছোট-শিশুরা তাদের বাবা-মার কাছে কিছু পেতে বা তার চাহিদা পূরণ করতে বায়না ধরবে- এটিই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের বন্ধুত্বসুলভ আচরণে সন্তানদের সঙ্গে মিশে যেতে পারলে তার বায়না লাঘব করা সম্ভব হয়। স্কুলগামীরা অর্থাৎ টিন এজরা খুব সামান্যতেই মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে। এজন্যে স্কুল পর্যায়ে কাউন্সেলিং করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সরকারকেই উদ্যোগি হতে হবে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক, ডা. বিধান চন্দ্র রায় পোদ্দার বলেন, এখন আমাদের এক ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হচ্ছে, যার মধ্য দিয়ে আমাদের সন্তানরা বেড়ে উঠছে। পূর্বে সন্তানদের মধ্যে বাবা-মার নিয়ন্ত্রণ ছিল। সে নিয়ন্ত্রণ পরিবেশের কারণেই কমে যাচ্ছে। এই নিয়ন্ত্রণহীনতার মধ্যে বাচ্চাদের ব্যক্তিত্ব গঠনে চাপ সহ্য করার ক্ষমতা লোপ পাচ্ছে, যা সমাজের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর। এ থেকেই সমাজে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. ফজলুর রশীদ খান (এফ,আর, খান) বলেন, ‘অভাব ও অপরাধ হাতে হাত ধরে চলে। ঠিক তেমনি কিশোর অপরাধ ও পরিবার’ হাতে হাত ধরে চলে। অর্থাৎ তাঁর মধ্যে একজন শিশু কিংবা ব্যক্তি অপরাধপ্রবণ হওয়ার মূল কারণ পরিবার ও সমাজ থেকেই উদগৃহিত হয় এবং আত্মহত্যাও পরিবার তথা সমাজ থেকেই উদগৃহিত হয়।
বলা যেতে পাওে, আত্মহত্যা মূলতঃ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক এবং অর্থনৈতিক কারণেই ঘটে থাকে। আজকের বাংলাদেশে সামাজিক সমস্যা এবং পারিবারিক বন্ধন অনেকাংশেই তার চরিত্র পাল্টিয়েছে। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে ক্রমাগত একক পরিবারে পরিণত হচ্ছে। ফলে শিশু কিশোর তাদের দাদা-দাদী সহ নিকট আত্মীয়ের আদর-স্নেহ ও উপদেশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাবা-মার ব্যস্ততায় শিশুরা বুয়া অথবা অন্য কারো সান্নিধ্যে বড় হওয়ায় একাকীত্ব বোধে বেড়ে উঠছে। যা একটি শিশুর জন্য কোনোভাবেই কাম্য হতে পারেনা। তাছাড়া বাবা-মা নিজেরা যা হতে পারেন নি, তা সন্তানের নিকট থেকে কামনা করায় সন্তানরা এক ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে বড় হয়। এছাড়া ছোট অবস্থায় বাচ্চাদের ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা না দেয়ার ফলে তাদের ভেতর ধর্মীয় ভীতি কাজ না করায় পরিবেশের সঙ্গে খাপ না খাওয়াতে পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। তাই এটি একটি সামাজিক সমস্যাই বটে।
এটি রোধে তাই আমাদের সমাজকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

লেখক প্রবন্ধকার