আদিবাসীদের ভাষা নিয়ে রাজনীতি নয়

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭, ১:০১ পূর্বাহ্ণ

 মিথুশিলাক মুরমু


আমার ছোট্ট মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। টেক্স বুক বোর্ড প্রণীত দ্বিতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ের এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘মায়ের ভাষাকে মাতৃভাষা বলা হয়।’ অতঃপর বলা হয়েছে, ‘আমাদের মাতৃভাষা বাংলা।’ আমার মেয়েটি আস্তে আস্তে আমাকে শোধালেন, বাবাÑ আমাদের মাতৃভাষা কি বাংলা? সহসা আমি তাকে বললাম, আমরা কী সাঁওতাল বা বাঙালি? সে আমাকে বললো-সাঁওতাল। তাহলে আমাদের মাতৃভাষা কী বাংলা না সাঁওতালি? সে উত্তর দিলো- সাঁওতালি। অতএব তোমার মায়ের মাতৃভাষা বাংলা নয় সাঁওতালি? আমাদের পূর্ব পুরুষরা প্রত্যেকেই সাঁওতালি ভাষায় কথা বলেছেন এবং সমাজ জীবনে চর্চা করেছেন।
সুদুর অতীতে খ্রিস্টিয়ান সমাজের প্রধান ধর্মগুরুরা একমাত্র ল্যাটিন ভাষাতেই ধর্মীয় অনুশাসন, রীতি-নীতি পরিচালনার জন্য গুরুত্বারোপ করতেন। ল্যাটিন ভাষা ছাড়া স্বর্গীয় ঈশ^র যেন মর্ত্যলোকের প্রার্থনা, প্রশংসা কোনো কিছুরই বোধগম্য নয়।  অতঃপর মার্টিন লুথার পঞ্চদশ শতাব্দীতে প্রটেস্ট করার পরই বহু ভাষায় প্রার্থনা, প্রশংসার রীতিটি চালু হয় যা আজ অবধি বিদ্যমান। এই একাবিংশ শতাব্দীতে এসে পোপ ফ্রান্সিস মেক্সিকো সফরে এসে পুনরায় স্থানীয় আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রার্থনা করার অনুমতি দিয়েছেন। ভ্যাটিকান কর্তৃপক্ষ ডিক্রি জারি করে ওই তিন ভাষায় প্রার্থনা করার অনুমতি দেয়া হয়। তিনি অবশ্য মেক্সিকোর চিয়াপাস রাজ্যের আদিবাসীদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার জন্য ক্ষমাও চেয়েছেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ ফ্রান্সিস-এর উপস্থিতিতে চিয়াপাস রাজ্যে তিনটি আদিবাসী ভাষায় ধর্মীয় প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। মহামান্য পোপ বলেছেন, ‘অনেক সময় একযোগে ও সংঘবদ্ধভাবে আপনাদের ভুল বোঝান হয়েছে। বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে সমাজ থেকে। …কেউ কেউ আপনাদের মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে খাটো করে দেখেছে। অন্যরা ক্ষমতা, অর্থ ও বাজারপ্রবণতার কারণে বোধশক্তি হারিয়ে আপনাদের ভূমি চুরি কিংবা দূষিত করেছেন।’ পাঁচদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে পোপ ফ্রান্সিস আরো বলেছেন, ‘আদিবাসীদের প্রকৃতিপ্রেম থেকে বাকি বিশে^র অনেক কিছু শেখার রয়েছে।’ আলজেরিয়ার প্রাচীন ভাষা ‘বারবার’-কে সরকারি মর্যাদা দিয়েছে দেশটির পার্লামেণ্ট। আইনজ্ঞ ও ভাষাবিদ্রা বলছেন, সরকারি ভাষা আরবি’র পাশাপাশি বারবার ভাষাভাষী অঞ্চলের স্কুলগুলোতে সরকারিভাবে এ ভাষায় পাঠদান করা যাবে। প্রাচীন এই ভাষা স্থানীয়ভাবে ‘আমাজিঘ’ নামে পরিচিত। ২০০২ সালে এটি আলজেরিয়ার জাতীয় ভাষার স্বীকৃতি পেয়েছিলো। সপ্তম শতাব্দীর আগ পর্যন্ত বারবার গোষ্ঠীর লোকেরা ছিলেন প্রকৃতপক্ষে উত্তর আফ্রিকার অধিবাসী। বর্তমানে আলজেরিয়ার ৩ কোটি ৯০ লাখ জনসংখ্যার ১ কোটি ৩০ লাখই প্রাচীন এই গোষ্ঠীর লোক।
আমার দেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি শ্রী সুরেন্দ্র কুমার সিনহা উচ্চ আদালতে মাতৃভাষা বাংলার প্রচলন করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, ‘মাতৃভাষায় আমাদের কার্যাবলি পরিচালিত হবে। এটি সত্যিই দরকার। এটি নি¤œ আদালতে চালুু হয়েছে। আমি মনে করি, এটি আমাদের উচ্চ আদালতে চালু করা উচিত। আমাদের কয়েকজন বিচারপতি বাংলায় রায় লেখেন। আমিও চিন্তা করছি দুই একটা রায় বাংলায় লিখবো।…আমাদের মনে রাখতে হবে মাতৃভাষা ও দেশীয় সংস্কৃতির পারস্পারিক সম্পৃক্তি আমাদের জাতি গঠনে ও অতীত সংগ্রামে পাথেয় হয়েছে। আর সে কারণেই আমাদের মাতৃভাষা এবং দেশীয় সংস্কৃতিকে আমাদের ধারণ ও লালন করতে হবে। করতে হবে এর সৃজনশীল ও কার্যকর রূপান্তর।’ আদিবাসী মণিপুরী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি মাননীয় প্রধান বিচারপতি এস. কে সিনহা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে উপলব্ধি করেছেন ৯৯ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা ‘বাংলা’, রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা’ ভাষার প্রচলনকে অগ্রাধিকার প্রদানের কিন্তু নিজ মাতৃভাষার প্রতিও রয়েছে সমান গুরুত্বতা। মাতৃভাষা বাংলা, মাতৃভাষা মণিপুরী, মাতৃভাষা সাঁওতাল, মাতৃভাষা মান্দি কিংবা মাতৃভাষা চাকমা, ত্রিপুরা ভাষার মধ্যে দিয়েও সৃজনশীলতা সম্ভব সেটি তিনি স্বীকার করেছেন। প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, সহযোগিতা এবং প্রতিটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশায়ন।
আমরা জাতীয় দৈনিকগুলো থেকে জানতে পেরেছি যে, নিউইয়র্কের সরকারি স্কুলগুলোতে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাসহ অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় ভাষার দ্বিভাষিক শিক্ষা কর্মসূচি চালুর আহবান জানিয়েছে ডেমোক্র্যাট দলীয় মার্কিন কংগ্রেসের দুই সদস্য জোফেস ক্রাউলি ও গ্রেস মেং। ২০১০ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুসারে নিউইয়র্কে দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত নাগরিকের সংখ্যা ৩ লাখ ৫১  হাজার। এরমধ্যে পাঁচ বছরের বেশি আগে বাংলাদেশ থেকে এসেছে এমন মানুষের সংখ্যা ৮৪ হাজার ৬৬২। তাদের ৫৩ শতাংশই ইংরেজি ভাষায় সম্পূর্ণ দক্ষ নয়। জানা যায়, জনগণনার ভিত্তিতেই নিউইয়র্কে ভোট গ্রহণের ব্যালেটপত্রে বাংলা চালু করা হয়েছে। এছাড়া নিউইয়র্কের ৬০টি ভোটকেন্দ্রে বাংলা, হিন্দি ও পাঞ্জাবি ভাষার দোভাষীর উপস্থিতির ব্যবস্থাও রয়েছে। দুই কংগ্রেস সদস্যের আহবান থেকেই প্রমাণিত হয় যে, একাধিক দক্ষিণ এশীয় ভাষায় শিক্ষা কর্মসূচি চালু হওয়া কতটা জরুরি। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে নিউইয়র্কের স্কুল ব্যবস্থায় দ্বিভাষিক কর্মসূচি রয়েছে এমন স্কুলের সংখ্যা ১৮২টি। তারমধ্যে সর্বাধিক দ্বিভাষিক কর্মসূচি রয়েছে স্প্যানিশ ভাষার সঙ্গে (১৫৩টি স্কুলে)। তারপর রয়েছে যথাক্রমে চিনা (১১), ফরাসি (৯), ক্রেয়ল (৩), রুশ (২), কোরিয়ান (১) ও আরবি ভাষার (১)। অবশ্য বাংলা থেকে ইংরেজিতে উত্তরণের একটি মধ্যবর্তী কর্মসূচি (ট্রানজিশনাল বাইলিঙ্গুয়াল এডুকেশন) শহরটির তিনটি স্কুলে চালু রয়েছে।  ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের লা কুরনভে ফ্রেঞ্চ বাংলা স্কুলও উদ্বোধন করা হয়েছে। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম শহীদুল ইসলাম প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেছেন, ‘প্রবাসে বাংলা ভাষী শিশু কিশোরদের জন্য একটা বাংলা স্কুল অপরিহার্য ছিল… এই স্কুলের জন্য প্রয়োজনীয় সার্বিক সহযোগিতার জন্য ফ্রান্সে বাংলাদেশের দূতাবাস সচেষ্ট থাকবে। সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা জামিরুল ইসলাম বলেছেন, ‘প্রবাসে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের বাংলাভাষা পরিপূর্ণভাবে শেখানোর লক্ষ্য নিয়ে ফ্রেঞ্চ বাংলা স্কুল শুরু হলো।’ বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দক্ষিণ আফ্রিকার দেশ সিয়েরালিওনে পৌঁছিয়েছে। পাশ^বর্তী দেশ ভারতের কয়েক কোটি মানুষের মুখের ভাষা বাংলা। গৌরবোজ্জ্বল ’৫২ বাংলা ভাষা আন্দোলনের ভাস্কর্য জাতিসংঘের সম্মুখভাগে উন্মোচন করা হয়েছে। বিগত ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ‘মুক্তধারা ফাউন্ডেশন’ ও ‘বাঙালি চেতনা মঞ্চের’ উদ্যোগে শিল্পী খোরশেদ আলম সেলিমের নক্সায় এবং শিল্পী মৃণাল হকের তৈরিতে বাংলা ভাষার দীর্ঘ ইতিহাস ঘোষিত হয়ে চলেছে। তারপরও অর্ধশতাধিক বছর পূর্বে আব্দুল লতিফ গাইতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চাই।’
আমাদের গণতান্ত্রিক সরকারের ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে আদিবাসীদের জন্য প্রাক্ প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষাদান কর্মসূচি হাতে নেয়ার কথা থাকলেও ২০১৬ খ্রিস্টাব্দেও প্রতিশ্রুতির পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটেনি, যা খুবই হতাশার। এক হিসেবে দেখা গেছে যে, দেশে বসবাসরত প্রায় ২৫ লক্ষাধিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী নিজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ২০১০ খ্রিস্টাব্দে যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হলে, সেখানে এ দেশের আদিবাসী তথা সরকারি ভাষায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে অর্ন্তভুক্ত হয়্। এরই প্রেক্ষিতে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের শুরুতেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উদ্যোগী হয় প্রাক প্রাথমিক পর্যায়ে আদিবাসীদের জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির। এ বিষয়ে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ২০১২ খ্রিস্টাব্দে গঠিত হয় একটি জাতীয় কমিটি। সেই কমিটির সুপারিশে প্রাথমিকভাবে ছয়টি (চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মান্দি, সাঁওতাল ও উরাঁও) ভাষায় পাঠ্যপুস্তক তৈরি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও আনুসাঙ্গিক প্রক্রিয়া হাতে নেয়া হয়। সূচনাবর্ষে (২০১৪-২০১৫) পাঁচটি আদিবাসী ভাষা এবং পরবর্তী বর্ষে আরো কিছু ভাষা এভাবে ক্রমান্বয়ে সম্ভাব্য সব আদিবাসীর মাতৃভাষায় প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সম্পন্ন করার কথা রয়েছে। কিন্তু সে প্রক্রিয়ার তেমন কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান হচ্ছে না। এখন স্বভাবতই আদিবাসীদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে ক্ষোভ, হতাশা এবং বিশ^াসহীনতা, বিশেষ করে আদিবাসী সাঁওতালদের মধ্যে। অপরদিকে ভাষার বর্ণমালা (বাংলা বর্ণমালা নাকি রোমান বর্ণমালা) বিতর্কে সাঁওতালরা মশগুল হয়ে পড়েছে। তবে এটি স্বীকার্য যে, এখনই আমার দেশের ছোট ছোট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষাগুলো রক্ষার, লালন-পালন ও চর্চার সুযোগ সৃষ্টি করে না দিলে অচিরেই মাতৃভাষাগুলো পৃথিবীর আলো-বাতাস থেকে হারিয়ে যাবে অতল গহীনে। প্রয়াত শিল্পী আব্দুল লতিফ-এর রচিত গান শোভা পাবে আদিবাসীদের কণ্ঠে ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চাই।’ মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেতৃত্বদানকারী আমার বাংলাদেশ-এর প্রতি অঙ্গুলি যেন না ওঠে, তারই ব্যবস্থা রাষ্ট্রকে নিতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট