আদিবাসীরা স্বাধীনতার পক্ষাবলম্বন করে

আপডেট: ডিসেম্বর ২০, ২০২২, ১২:১০ পূর্বাহ্ণ

মিথুশিলাক মুরমু:


বরেন্দ্রভূমির আদিবাসীরা মহান মুক্তিযুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়েই মাতৃভূমিকে মুক্ত করার লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁর বিস্তীর্ণভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাসকারী সাঁওতাল, উরাঁও, পাহাড়িয়া, কোল, রাজোয়াড়, মাহালীরা নিশ্চুপ হয়ে থাকেনি; শত্রু শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তুলে নিয়েছিলো থ্রি নট থ্রি, মেশিনগান, হাত বোমা কিংবা দেশীয় অস্ত্রাদি। উত্তরবঙ্গের কোনো জায়গাতেই আদিবাসীদের মধ্যে কেউ-ই রাজাকার, শান্তিবাহিনীর সদস্য, আল-বদর, আল-সামস্ বাহিনীর সাথে হাত মেলাইনি। দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা থেকেই সাময়িকভাবে সীমান্ত রেখা অতিক্রম করলেও ফিরে এসেছে প্রশিক্ষিত হয়ে। বরেন্দ্রভূমির আদিবাসীর এই ঐকান্তিক সমর্থনের দরুণ হত্যা, নির্যাতন-অত্যাচারের শিকার হয়েছে। রাজশাহীন গোদাগাড়ী থানার কাশিঘুটু (আমতলীপাড়া)র ১১ জন সাঁওতাল শহিদ হয়েছেন। স্থানীয় রাজ্জাক রাজাকারের প্ররোচনায় এপ্রিল মাসের দিকে হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যায় এবং গুলি করে হত্যা করে। এরা হলেন- মানিক টুডু (২৬), পিতা- মুটরু টুডু; বাবলু হেমব্রম (৪০), পিতা- রাম হেমব্রম; হোপনা সরেন (৫০), পিতা- রামসিং সরেন; মানিক সরেন (ষষ্ঠ শ্রেণীতে অধ্যয়তরত), পিতা- হোপনা সরেন; হারমু মুরমু (৭০), পিতা- খুনা মুরমু; মঙ্গলা মুরমু (দুই ভাই ছিলেন), পিতা- ঠোয়া মুরমু; মুটরু টুডু, পিতা- ছুতার টুডু, কিষ্টু মুরমু, ধনাই মার্ডী, মঙ্গল মুরমু, পিতা- মারাং মুরমু এবং বুসতি। কাশিঘুটু গ্রামের লোকদের অপরাধ ছিলো তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, খাবার এবং সেবাযত্ন করেছে। আজ পর্যন্ত তাদের স্মরণার্থে কোনো স্মৃতিফলক, স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একেবারেই উপেক্ষিত হয়েছে সাঁওতাল শহিদরা।
শহিদ নাডা হেমরম, টুনু মার্ডি, ধেরিয়া, জটু সরেন, কানু হাঁসদা বাঁশবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা। মুক্তিযুদ্ধে তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন ছিলো। তাদের সর্বোত্তম সহযোগিতার কথা পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর আলবদর, রাজাকাররা জেনে গেলে হাজির হয় বাঁশবাড়িয়া গ্রামে। সেদিন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, আব্বাস আলীর ছেলে মো. আব্দুস সামাদ (মুসা) ওরফে ফিরোজ খাঁ। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ এপ্রিল পুঠিয়ার ৪ নম্বর ভালুকগাছি ইউনিয়নের পশ্চিমভাগের বাঁশবাড়িয়া গ্রামে নিজহাতে তরবারি দিয়ে ও পাকিস্তানি আর্মিরা গুলি করে নাডা, কানু, টুনু ও জটুকে হত্যা নিশ্চিত করে। তাদের কারোরই লাশের সন্ধান পাওয়া যায় নি। এর পরপরই প্রচ- ক্ষিপ্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গ্রামটিকে জ্বালিয়ে দেয়। অসহায় আদিবাসী লোকজন দিকবিদিক পালিয়ে যায়।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ শে নভেম্বর নওগাঁ সাপহার-এর সৎপুর, পাইকবান্দা, হলাকান্দরের ৩৫ জন আদিবাসীকে ব্রাশফায়ার করে মারা হয়। ৩৫ জনের মধ্যে ৩৩ জনই ছিলেন সাঁওতাল সম্প্রদায়ের। একমাত্র বেঁচে যাওয়া মি. গুলু মুরমু ২৬ জনের পরিচয় দিতে পেরেছিলেন- শহিদ মুন্সি টুডু, পিতা- মঙ্গল টুডু; শহিদ যোনা টুডু, পিতা- অদগ টুডু; শহিদ মাংগাত মাজহী সরেন, পিতা- জপলা সরেন; শহিদ বয়লা হাঁসদা; শহিদ বার্নার্ড সরেন, পিতা- লেদেম সরেন; শহিদ সুফল হেমরম, পিতা- যিতু হেমরম; শহিদ বুদু হেমরম, পিতা- বাকা হেমরম; শহিদ সরকার মুরমু, পিতা- সম মুরমু; শহিদ মিস্ত্রী সরেন; শহিদ সবান; শহিদ ধুদু মুরমু, পিতা বাগরেদ মুরমু; শহিদ রবিকান্ত বর্মন, পিতা- পানু বর্মন; শহিদ মাতলা মুরমু, পিতা- বড়হাল মুরমু; শহিদ কবিরাজ মুরমু, পিতা- মাতলা মুরমু; শহিদ মদন মুরমু, পিতা- মাতলা মুরমু; শহিদ ভূতু সরেন; শহিদ বুধরাই টুডু; শহিদ যাদু মুরমু; শহিদ হারা সরেন; শহিদ মশাই সরেন; শহিদ চুড়কা টুডু; শহিদ সুফল হেমরম; শহিদ পাত্রাস; শহিদ যোসেফ; শহিদ জেঠা হাঁসদা। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীকালে এই আদিবাসী গ্রাম দুটি- পাইকবান্দা, হলাকান্দর নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
বরেন্দ্রভূমির আদিবাসীরা দেশ স্বাধীনের পরবর্তীকালে প্রত্যাবর্তন করেছে, নতুন আশা, স্বপ্ন দেখেছে কিন্তু মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করতে পারেনি। এখনো আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধারা স্বীকৃতির আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরে ফিরছেন, এখনো দেশ স্বাধীনের রক্ত¯্রােতে আদিবাসী শহিদদের স্বীকৃতি মেলেনি। তাঁদের নামে কোনো স্মৃতিফলক, স্মৃতিসৌধ, রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোনোটিরই নামকরণ হয়ে ওঠেনি। আদিবাসীরা দেশকে ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছে, জীবন উৎসর্গ করেছে; প্রতিদানে রাষ্ট্রের এগিয়ে আসা উচিত, নূন্যতম দাবিগুলো পূরণে সরকারের আন্তরিকতাই যথেষ্ট।
লেখক: সংবাদকর্মি