আধুনিকতার ছোঁয়ায়, বিলুপ্তির পথে টাইপিস্ট মেশিন

আপডেট: অক্টোবর ২৭, ২০২১, ১০:৫৩ অপরাহ্ণ


নিজস্ব প্রতিবেদক:


‘দলিল থেকে সব নথি লেখেছি দুই হাতে। দম ফেলার সময় ছিল না। দু’হাত দিয়ে কাজ করে শুমার (শেষ) করতে পারিনি। টাইপিস্টদের কদরের সেই দিন আর নেই। কম্পিউটারের এই যুগে কাজ হারিয়েছি আমরা টাইপিস্টরা।’ কথাগুলো টাইপিস্ট আব্দুস সাত্তার (৭০) এর।

তিনি জানান, রাজশাহী কোর্টে অনেক টাইপিস্ট ছিলেন। কেউ কেউ মারা গেছেন, কেউ আবার কাজের অভাবে পেশা পরিবর্তন করেছেন। আমি (আব্দুস সাত্তার), হাবিবুর, রেন্টু ও মোস্তাফিজুর এখনো এই কাজ করি রাজশাহী কোর্টে।

সামনের টাইপরাইটারটি দেখিয়ে আব্দুস সাত্তার বলেন, দীর্ঘদিন এই মেশিনে কাজ করছি। অনেক মায়া পড়ে গেছে। জীবন-জীবিকা চলেছে এই মেশিনের ইনকামে (উপার্জনে)। এখন এই মেশিন (টাইপরাইটার) টাকা দিলেও পাওয়া যাবে না। নষ্ট হলে মেরামতের ব্যবস্থা নেই। অল্প সমস্যা হলে নিজেরাই ঠিক করি। বড় ধরনের সমস্যা হলে বাদ দিতে হয়।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন- ১৯৭৩ সালের দিকে টাইপরাইটার মেশিনের দাম ছিল ১১ হাজার টাকা। প্রথম অবস্থায় জার্মানি থেকে আসতো এই মেশিন। পরের দিকে ভারত থেকে আসতে শুরু হলে কমে যায় দাম। ১৯৭৫ সালের পরে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকায় পাওয়া যেত। ১৯৭৩ সালের দিকে শুধু ইংরেজি টাইপ হতো। তার ৪ থেকে ৬ বছরে পরে ‘মুনীর অপটিমা বাংলা টাইপ মেশিন’ যোগ হয় টাইপরাইটারে।

সরেজমিনে রাজশাহী কোর্টে গিয়ে দেখা গেছে, আব্দুস সাত্তার ও হাবিবুর কাজ করছেন। রেন্টু ছিলেন না তার মেশিনের কাছে। তবে মোস্তাফিজ থাকলেও অলস সময় কাটাচ্ছিলেন। তারা জানালেন, আগের মতো আর কাজ হয় না। টাইপরাইটারের কাজ এখন কম্পিউটারে হয়। তবে কিছু আমরাও করে থাকি।

টাইপিস্ট মোস্তাফিজুর রহমান জানান, উকিলবারের আশেপাশে কোলাহলে মুখরিত থাকে সবসময়। চিরচেনা দৃশ্য টাইপ রাইটারের খটখট শব্দ। দলিল-পত্র থেকে যেকোনো আবেদন টাইপ করতে মানুষ ছুটে আসতেন টাইপিস্টদের কাছে। কম্পিউটারের ব্যবহার বৃদ্ধি, টাইপরাইটার মেশিন মেরামতের ব্যবস্থা নেই, কালির অভাব ছাড়াও নানা কারণে টাইপরাইটার মেশিনের ব্যবহার কমে এসেছে।’

হাবিবুর রহমান (৬৯) জানান, ‘সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন টাইপ মেশিনে কাজের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। এরপরে ১৯৭৩ সাল থেকে রাজশাহী কোর্টে টাইপ রাইটারের কাজ করি। তিনি বলেন, এই পর্যন্ত ৭টি টাইপ রাইটার মেশিন ব্যবহার করেছি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই মেশিনের ব্যবহার কমে গেছে।

টাইপিস্ট রেন্টু ইসলাম বলেন, আগে এইকাজের অবস্থা খুব ভালো ছিল। সারাদিনে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পেতাম। এখন ২৫০-৩০০ টাকা উপার্জন করতে কষ্টকর হয়ে যায়।
দলিল লেখক হাসান মৃধা জানান, ‘যন্ত্র পুরনো হলেও, টাইপ রাইটারের প্রয়োজনীয়তা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। এখনো আদালতের কিছু নোটিশ এবং নথিপত্র আছে যা টাইপ রাইটার ছাড়া কম্পিউটারে করানো সম্ভব নয়। অনেক ফর্ম আছে যেগুলো কম্পিউটারে টাইপ করলে সেগুলো কোর্টে গ্রহণযোগ্য হয় না। এছাড়া কিছু নোটিশ আছে, সিআরও ফর্ম আছে যেগুলো টাইপরাইটার ছাড়া আমাদের করা সম্ভব না।’