নিজস্ব প্রতিবেদক:
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় এবার নতুন করে আলোচনায় এসেছে কাঁচামরিচ। রাজশাহীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মাত্র এক মাসের ব্যবধানে কাঁচা মরিচের দাম প্রায় দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে।
ক্রেতারা বলছেন, সাধারণত এই সময়ে কাঁচা মরিচের দাম স্থিতিশীল থাকে, সেখানে এবার ক্রেতাদের পকেটের উপর চাপ বাড়ছে। বাজারে সিন্ডিকেটের কারণে এই অস্বাভাবিক দাম বাড়ানো হচ্ছে। তাদের মতে, সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ব্যবসায়ীরা মূল্য বাড়ানোর অপচেষ্টা করছেন। বিক্রেতারা এ ধরনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলছেন, প্রকৃতির প্রতিকূলতার কারণেই সরবরাহ কমে গেছে, যার প্রভাব বাজারে পড়েছে।
চাষিরা জানিয়েছেন, টানা দুই মাসের খরা এবং পরবর্তীতে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে মরিচের ফলন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক স্থানে ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে সরবরাহে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে বাজারে চাহিদার তুলনায় মরিচের সরবরাহ অনেক কম, যা মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন। তাছাড়া, পরিবহন খরচ বৃদ্ধির প্রভাবও দাম বৃদ্ধিতে যুক্ত হয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
শুক্রবার (৪ অক্টোবর) রাজশাহীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, কাঁচা মরিচের দাম ক্রেতাদের জন্য অত্যন্ত চাপ সৃষ্টি করছে। এক কেজি কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৩৬০ থেকে ৩৭০ টাকার মধ্যে, যা এক মাস আগের তুলনায় দ্বিগুণ।
সাহেব বাজারে সবজি কিনতে আসা একজনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, গত মাসে ১৫০ টাকা কেজি দরে কাঁচা মরিচ কিনেছি। আজ এসে দেখি তা ৩৭০ টাকা হয়ে গেছে। বাসায় কাঁচা মরিচ ছাড়া রান্না-বান্না করা যায় না।
কাঁকন দাস নামে রাজশাহীর একজন সবজি বিক্রেতা জানান, বাজারে কাঁচা মরিচের দাম এতটাই বেড়ে গেছে যে, বেশি দামে এক পাল্লা (৫ কেজি) মরিচ কিনে এনে ছোট আকারে বিক্রি করলে তার লাভ হচ্ছে না। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ১০ থেকে ২০ টাকার মরিচ বিক্রি করলে খরচই উঠে আসে না। এই অবস্থায় থাকলে আমাদের জন্য মরিচ বিক্রি করা বন্ধ করে দেওয়াই ভালো।
তিনি আরও বলেন, বৃষ্টির কারণে সড়কগুলো তলিয়ে গেছে, যার ফলে পরিবহন ব্যবস্থা ভীষণভাবে ব্যাহত হয়েছে। এই কারণে বাজারে গাড়ি ঠিকমতো পৌঁছাতে পারছে না, ফলে পাইকারদের কাছেও মরিচের সরবরাহ সীমিত।
সাহেব বাজারের আরেক সবজি বিক্রেতা মিন্টু মিয়া জানান, কয়েকদিন ধরে চলমান বৃষ্টির কারণে শুধু কাঁচা মরিচ নয়, অন্যান্য সবজির দামও বেড়ে গেছে। আমরা বেশি দামে কিনতে বাধ্য হচ্ছি, তাই বেশি দামে বিক্রি করা ছাড়া আমাদের আর উপায় নেই। ক্রেতারা শুধুমাত্র বিক্রেতাদের দোষারোপ করছেন, কিন্তু বাজারের প্রকৃত অবস্থা আলাদা।
কাঁচা মরিচের দাম এক ধাক্কায় এতোটা বেড়ে যাওয়ায় বাজারে বিক্রি তলানিতে ঠেকেছে বলে দাবি খুচরা বিক্রেতাদের।
ভ্যানে বিভিন্ন সবজিসহ কাঁচা মরিচ বিক্রি করেন মাহাদি হাসান। তিনি জানান, মরিচের এতো দাম, আজকে আর নতুন করে মরিচ নিয়ে আসা হয়নি। গতদিনেরগুলোই বিক্রি হচ্ছে না। সবাই ৫০ গ্রাম, ১০০ গ্রাম করে নিচ্ছে। কাঁচা মরিচের দাম বাড়ায় আমাদের তো কোন লাভ নাই। আমরা যে দামে কিনবো, ওই হিসাবেই বিক্রি করবো।
কাঁচা মরিচ ছাড়াও বাজারের অন্যান্য সবজির দামও বেড়েছে। কাকরোল, মুলা, ঝিঙ্গা ৬০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত সপ্তাহে ছিল ৫০ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে। তবে করলা ও বেগুন বিক্রি হচ্ছে ১৩০ ও ১০০ টাকায়, যা গত কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে ৩০-৬০ টাকা। ৫০ থেকে ৫৫ টাকার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে আলুর দাম। পেঁয়াজ, আদর দাম স্থিতিশীল থাকলেও বেড়েছে রসুনের দাম, বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ২৮০ টাকায়।
একই চিত্র চাল ও মাছের বাজারেও। প্রকারভেদে প্রতিকেজি মোটা চাল ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা ও মাঝারি চাল (আটাশ) বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। সপ্তাহের ব্যবধানে ইলিশের দাম না বাড়লেও কেজিপ্রতি ১০ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে সব প্রকার নদী ও সামুদ্রিক মাছের দাম। বাড়েনি পুকুরে চাষ করা মাছসহ গরু ও খাসির মাংসের দাম।
ক্রেতা মাহবুবুল আলম জানান, বাজারের নিত্যপণ্যের দাম মধ্যবিত্তদের সাধ্যের বাইরে চলে গেছে। কাচাঁবাজারসহ দিন দিন সব পণ্যের দাম বাড়ছে, ক্রয় করতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে। নিত্যপণ্যের বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যদি প্রশাসন নিয়মিত মনিটরিং করতো তাহলে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসতো বলেও জানান ক্রেতারা।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উতিরিক্ত উপ পরিচালক শারমিন সুলতানা জানিয়েছেন, সাধারণত বর্ষার মৌসুম, বিশেষ করে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যখন বেশি থাকে তখন মরিচ গাছের ফুল পড়ে যায়, গাছও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বৃষ্টিপাতের কারণে কৃষকরা সেভাবে গাছের পরিচর্যা করতে পারেন না, মরিচ সংগ্রহ কমে যায়। সব মিলিয়ে সার্বিক উৎপাদন ব্যহত হওয়ার কারণেই বর্ষা মৌসুমে বাজারে কাঁচা মরিচের দাম বেড়ে যেতে পারে।
রাজশাহী জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মাসুম আলী বলেন, আমাদের কাজ হচ্ছে কোথাও কোনো ব্যবসায়ী পণ্য মুজুদ করে কোনো সিন্ডিকেট করছে কিনা সে বিষয়ে তদারকী করা। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি এই রকম অনৈতিক কার্যকলাপের সাথে জড়িত থাকার প্রমাণ থাকে তাহলে আমাদের নিয়মিত অভিযানে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ুতিনি বলেন, বাজারের পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করার দায়িত্ব ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের না। মুক্তবাজারে কোনো পণ্যের দামে ব্যবসায়ীরা কারসাজি করলে সেটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।