নিজস্ব প্রতিবেদক:সিল্ক আর রাজশাহী, নামেই যেন একে অপরের পরিপূরক। কয়েক দশক থেকে থেকে চলে আসছে এই পরিচিতি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষের রুচি ও ফ্যাশন বদলে গেলেও অমলিন সিল্কের ঐতিহ্য। সারাবছর তো বটেই, ইদ মৌসুমেও অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে সিল্কের শাড়ি বা পাঞ্জাবি। বিশেষ করে ধনী ব্যক্তিদের কাছে এক আভিজাত্যের নাম সিল্ক।
রাজশাহীর অভিজাত নারীদের কেনাকাটায় বহু ধরনের পোশাক থাকলেও তালিকায় একটি হলেও সিল্কের পোশাক থাকবেই। পাঞ্জাবি, শাড়ি কিংবা রেশম কাপড়ে তৈরি থ্রিপিস কিংবা অন্য কোনো পোশাক যেন চাই-ই চাই। ইদ ঘনিয়ে আসায় শেষ মুহূর্তে তাই জমে উঠেছে রাজশাহীর সিল্কের বাজার।
বিসিক নগরীর সিল্ক শোরুমগুলোতে এখন সকাল হলেই ভিড় জমাচ্ছেন ক্রেতারা। ভিড় থাকছে গভীর রাত পর্যন্ত। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পুরো বছরই কেনাকাটা হয়। তবে দুই ঈদে বেচাকেনা সবচেয়ে বেশি। যে কারণে তাদের ব্যস্ততা বেড়ে যায় দ্বিগুণ। ক্রেতাদের পোশাকে বৈচিত্র্য আনতে নতুন কিছু দেওয়ার প্রয়াস চালান ব্যবসায়ীরা।
তারা জানান, রেশমের হ্যান্ড প্রিন্ট ও আর্ট প্রিন্টের ডিজাইনে বেশকিছু ভ্যারাইটি থাকছে এবার। আর নতুন নতুন ডিজাইনগুলোতে ক্রেতারা বেশি আকৃষ্ট হচ্ছেন। শোরুম থেকে পাইকাররাও পোশাক নিয়ে যাচ্ছেন। বিসিকের সিল্ক শোরুমগুলোতে রেশমের তৈরি পাঞ্জাবি, থ্রিপিস, শাড়ি, ওড়না, শার্ট বিক্রি হচ্ছে। সর্বনিম্ন দুই হাজার টাকা থেকে শুরু করে দেড় থেকে দুই লাখ পর্যন্ত বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে এসব পণ্য।
ক্রেতাদের পছন্দের পোশাক তৈরিতে বেশ কিছুদিন ধরেই ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগররা। সারা দেশে রাজশাহীর সিল্কের সুনাম থাকায় বাইরে থেকেও ক্রেতারা আসছেন শোরুমগুলোতে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, অনলাইনে বিক্রি বৃদ্ধির কারণে প্রত্যাশিত ক্রেতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা। ২০ রোজার পর ক্রেতাদের সমাগম আরও বাড়াতে পারে।
নগরীর সিল্ক শোরুমগুলোতে দেখা যায়, রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী সিল্কের শাড়ি, পাঞ্জাবি, শেরওয়ানি, থ্রি-পিস, শার্ট, হিজাব, ওড়না, স্কার্ফের মতো পোশাক বিক্রি হচ্ছে। নিরিবিলি পরিবেশে ক্রেতারা তাদের পছন্দের পোশাক দেখছেন।
সিল্কের পোশাকের দাম বরাবরই একটু চড়া। নিম্নআয়ের মানুষের নাগালের বাইরে। বিভিন্ন রঙ ও ডিজাইনের পাঞ্জাবি দুই হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। সিল্কের থ্রিপিস ৩ হাজার ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ২০ হাজারের ওপরেও রয়েছে। আর শাড়ি ২ হাজার থেকে শুরু করে ৩ লাখ টাকা পর্যন্তও আছে। সিল্ক ছাড়াও সুতির পাঞ্জাবি বিক্রি হচ্ছে এক হাজার টাকা থেকে ৪ হাজার টাকার মধ্যে। মসলিন সিল্ক রয়েছে ৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার মধ্যে। মটকা সিল্ক রয়েছে ৩ হাজার টাকা থেকে ৬ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে।
সিল্কের শার্ট রয়েছে ৭০০ থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে। ফুলহাতা ও হাফহাতা ডিজাইনের বিভিন্ন রঙের ফতুয়া রয়েছে সাড়ে ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায়। সুতি শার্ট রয়েছে ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকার মধ্যে। কাটোয়ার ডিজাইনের শাড়ি, সফট সিল্ক শাড়ি রয়েছে এক হাজার ৬০০ থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে। এন্ডি সিল্ক রয়েছে ৩ হাজার ৭০০ থেকে ৫ হাজার টাকায়। বলাকা সিল্ক রয়েছে ৪ হাজার ২০০ থেকে ৫ হাজার টাকায়। র-মসলিন রয়েছে ৬ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে। বলাকা স্টিজ শাড়ি রয়েছে ৬ হাজার থেকে ১৪ হাজার টাকার মধ্যে। এ ছাড়া রয়েছে পার্টি ড্রেস, কন্ট্রাস্ট থান শাড়ি, সুুতি পোশাক, জুতা ও স্যান্ডেল সহ বাহারি সব পণ্যের সমারোহ।
রাজশাহী সিল্ক মানে রাজশাহীর তুতগাছ থেকে পাওয়া গুটির সুতা দিয়ে তৈরি, এমনটা সত্য নয়। আসলে দেড় দশক ধরেই রাজশাহী সিল্কের যেসব পোশাক বাজারে পাওয়া যায়, তা তৈরি হয়ে থাকে বিদেশি সুতা দিয়ে। মূলত চীন থেকে আসা সুতা দিয়ে তৈরি হয় রাজশাহী সিল্ক। তবে সুতা বাইরে থেকে এলেও রাজশাহীর কারিগরদের হাতের নিপুণ কাজ মন জয় করে অনেকের। আর এই সূত্র ধরেই রাজশাহীর সিল্ক শো রুমগুলোতে প্রতিদিনই ভিড় জমাচ্ছে সিল্ক ভক্তরা।
রাজশাহীর বিসিক শিল্পনগরীর সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টরি এবং শোরুমের নাম হচ্ছে- ‘সপুরা সিল্ক মিলস লিমিটেড’। তাই ঈদে সব শ্রেণির ক্রেতাদের আগ্রহের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় এ প্রতিষ্ঠানের শোরুম। নতুনত্ব তৈরিতে শীর্ষে থাকেন তারা। এখানে ইদের কেনাকাটা করতে এসেছিলেন চাকরিজীবী ফারহানা তৃষা। তিনি বলেন, সিল্কের শাড়ি ছাড়া ইদ কি করে হয়? তাই শাড়ি কিনতে এসেছেন। সে সঙ্গে স্বামীর জন্য সিল্কের পাঞ্জাবিও নেবেন। তিনি বলেন, রাজশার্হী সিল্কের ব্যাপক সুনাম আছে। চাকরীর সুবাদে এখন রাজশাহীতে থাকা হয়। তাই এখন সিল্কের শাড়ি নিচ্ছি।
দিপা প্রজ্ঞা নামের এক তরুণী জানান, সিল্কের পণ্যের আভিজাত্যই আলাদা। তাই প্রতিবছর ঈদেই তিনি অন্য থ্রিপিসের সঙ্গে একটি হলেও সিল্কের থ্রিপিস কেনেন। সেই ধারাবাহিকতার ব্যতিক্রম হচ্ছে না এবার। আর এ বছর অনেক সুন্দর সুন্দর কালেকশন এসেছে। সবই তার কাছে ভালো লাগছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা নেবেন সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
সপরিবারে সিল্কের পণ্য কিনতে এসেছেন কলেজ শিক্ষক তাজবুল হক। তিনি বলেন, মেয়ের জন্য জামা ও স্ত্রীর জন্য থ্রিপিস নেবো। নিজের জন্য পাঞ্জাবি নেবো। ইদের কেনাকাটায় সিল্ক ছাড়া তো জমে উঠে না। তাই প্রতিবারই সিল্ক থেকেই নেওয়া হয়।
ইদের কেনাকাটা করতে এসেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি বলেন, রাজশাহী সিল্ক ঐতিহ্য। সিল্কের কদর সারাদেশেই আছে। ইদে সিল্ক বাদে অন্য কিছু নিয়ে চিন্তাও করা যায় না। তাই প্রতিবার ইদে সিল্কের শাড়ি কেনা হয়। এগুলো সব সময় পরা যায়। আরামদায়ক কাপড়ও।
সপুরা সিল্ক মিলস লিমিটেডের শোরুম ম্যানেজার সাইদুর রহমান জানান, ইদ উপলক্ষে শেষ মুহূর্তে তাদের শোরুম জমে উঠেছে। রমজানের শুরু থেকে বিক্রি শুরু হলেও এখনই ভিড় বেশি। সকাল থেকেই শোরুমে ক্রেতাসমাগম ঘটছে। আর ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ক্রেতারাও আসছেন। বিক্রি ভালো চলছে। এবারের আমাদের লক্ষ্য ২০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করা। এ কয়েকদিনে আমার লক্ষ্যে পূরণ হয়ে যাবে।
রাজশাহী সিল্ক ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী আবদুল কাদের মুন্না জানান, অন্যান্য ইদের মতো এবারও ব্যবসা মোটামুটি ভালো হচ্ছে। শাড়ি, পাঞ্জাবি, শেরওয়ানি, থ্রি-পিস, শার্টসহ বিভিন্ন পোশাক বিক্রি হচ্ছে। বলাকা, মক্কা, কাতান, ছিপ কাতানসহ বিভিন্ন নামের শাড়ি ২ হাজার থেকে শুরু করে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছেন। এছাড়া পাঞ্জাবি ৫০০ থেকে ৭ হাজার, শেরওয়ানি ৮ থেকে ২৫ হাজার, থ্রি-পিস ১ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছেন। এছাড়া সিল্কের থ্রি-পিস, হিজাব, ওড়না, স্কার্ফ এবং মসলিন, মটকা, তসর কাতান, বলাকা কাতান, সাটিং সিল্ক ও এনডি প্রিন্টের শাড়ি বিক্রি হচ্ছে।