আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও রবীন্দ্রনাথ

আপডেট: আগস্ট ১৪, ২০১৭, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ

ড. হাসান রাজা


শিক্ষা জাতির মেরুদ-। এই শিক্ষাদর্শন মানবসভ্যতার মূল চালিকা শক্তিও বটে। একটি জাতির আত্মবিকাশ তথা সামগ্রিক অস্তিত্বের পূর্ণ স্বাধীন বিকাশে বিশ্বজনীন শিক্ষা সাধনার কোনও বিকল্প নেই। বাঙালি হিসেবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করাটা সময়ের দাবি। মানব সভ্যতার ইতিহাসের প্রথম শিক্ষাগুরু সক্রেটিসের প্রধান শিষ্য প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র চিন্তার মধ্যে যে শিক্ষাদর্শনের কথা বলেছেন তা কখনও বাস্তবায়িত হয় নি। শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে বারবিয়ানা স্কুল, ফ্রেইরি, কোরাইয়াশি সোসাকু, সামাহিল পদ্ধতি থেকে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন ছিল অনেক বেশি জীবনমুখি। কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়নে কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ে না। আমাদের বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৬ বছর অতিক্রান্ত হলেও এখন পর্যন্ত আমাদের শিক্ষানীতির সাথে কর্মনীতির কোনও বাস্তব সম্পর্ক স্থাপিত হয় নি। বর্তমানে আমাদের দেশে সাধারণ শিক্ষা, ইংরেজি মাধ্যম, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে চার ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি চালু রয়েছে। সময়োপযোগী বিষয়গুলির বাইরেও প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিষয় খুলছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। শত শত বিষয়ে ন্যূনতম পাঁচ বছর লেখাপড়া করার পরও শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে কোচিং বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ কর্ম কমিশন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হয়। ‘শিক্ষা সব সময় সবার জন্য’ অথবা একটি দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হলেও দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জীবনে একবার মাত্র ভর্তির সুযোগ পাবে শিক্ষার্থীগণ। এমন অনাচার সবাই মুখবুজে কীভাবে সহ্য করছেন তা আমার বোধগম্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বব্যাংকের লোভনীয় প্রকল্প বাস্তবায়নে তাদের তাবেদার তল্পিবাহকে পরিণত হচ্ছে ক্রমশ। সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্য, উপ-উপাচার্যগণ সরকারকে তুষ্ট করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্বশাসনকে গলা টিপে হত্যা করতে একটুও দ্বিধান্বিত হচ্ছেন না। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকের মধ্যবর্তী সময়ে কোমলমতি শিশুদের ঘাড়ের উপর ঝুলিয়েদেয়া হয়েছে দুই-দুইটি পরীক্ষা। সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতির নামে কি যে অনাচার চলছে, এ বিষয়ে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই কারও। নানা অনিয়ম আর দুর্নীতি মাথায় জনগণ এখন মানসিক বিকারগ্রস্ত প্রায়। এই দুঃসময় চলতেই থাকলে তথাকথিত সুবিধাভোগী বিত্তবান শিক্ষিতজনদের কিছুই যায় আসে না। কারণ তাদের সন্তানেরা হয় দেশের বাইরে বা ইংরেজি মাধ্যমে সবচেয়ে ধনিদের স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করে। বলায় বাহুল্য যে, এ দেশের সব চোরই শিক্ষিত কিন্তু যদিও সব শিক্ষিত ব্যক্তিই চোর নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় যে যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে সেই যোগ্যতায় শিক্ষক হওয়া যাবে না, আবার মাস্টার্স পাশের পর পূনরায় পাঁচ বছর লেখাপড়া করে পিএইচ ডি. ডিগ্রি অর্জন করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করার জন্য তার কোনো মূল্যায়ন এ দেশে নেই। অদ্ভুত একটা নিয়মে চলছে এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। দেখবার কেউ নেই, কথা বলার কেউ নেই। অথচ যাদের দেখানো পথে আজও আমরা জীবন ও জগৎকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করি সেইসব গুণি মহাজনদের শিক্ষাদর্শনে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনও মুক্তিও নেই আমাদের।
বাঙালির শিক্ষাদর্শন নিয়ে এ দেশে প্রথম স্বাধীনভাবে যুগোপযোগী কথা বলেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মাত্র ১৬ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথই প্রথম শিক্ষার সূচনাকালে এই শিক্ষাব্যবস্থার ভয়ংকর রূপ নিজের জীবনাভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করেছিলেন। রবীন্দ্র শিক্ষা-চিন্তার প্রথম প্রকাশ আমরা লক্ষ করি ১৮৭৭ সালে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্যের একটি সমালোচনা লিখতে গিয়ে তিনি লেখেন- ‘বঙ্গদেশে এখন এমনি সৃষ্টিছাড়া শিক্ষাপ্রণালি প্রচলিত হইয়াছে যে তাহাতে শিক্ষিতেরা বিজ্ঞান দর্শনের কতোগুলি বুলি এবং ইতিহাসের সাল ঘটনা ও রাজাদিগের নামাবলি মুখস্ত করিতে পারিয়াছেন বটে, কিন্তু তাহাতে তাঁহাদের রুচিরও উন্নতি হতে পারে না, তাই উহারা স্বাধীনভাবে চিন্তা করিতেও শিখেন নাই।’ এই সৃষ্টিছাড়া শিক্ষাপ্রণালির সরাসরি রূপ তিনি শৈশবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন খুব মর্মান্তিকভাবে। তাই ১২ বছর বয়সে সাধারণ স্কুল থেকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হওয়া মাত্র তিনি স্কুল থেকে অবলীলায় পালিয়েছিলেন। এই শিক্ষাব্যবস্থা কী নির্মম, পাশবিক এবং হৃদয়হীন হতে পারে তা তিনি শৈশবেই উপলব্ধি করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ যেমন শৈশবে শিক্ষার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েছিলেন, তেমনি আমাদের দেশের শিশুরা বর্তমান সময়েও এর থেকে ব্যতিক্রম নয়। কোমলমতি শিশুরা দেশের ভবিষৎ। তাই তাদের শিক্ষা পদ্ধতিও নিঃসন্দেহে সহজ ও আনন্দদায়ক হওয়া উচিত। শিশুর সাথে জীবনের কোনো সংযোগ নেই। মানুষের জীবনে থাকে নানা পর্যায়। বিশেষ করে একটি শিশু শৈশব, যৌবন, কৈশোর পেরিয়ে পৌঢ়ত্বে পদার্পণ করে। শিশু শিক্ষায় তাই মানসিকগঠণ অনুযায়ী পাঠপ্রক্রিয়াও নির্বাচিত হওয়া প্রয়োজন। একটি পর্যায়ের শিক্ষা প্রদানও তাই একই রকম হওয়া উচিত নয়। কিন্তু আমাদের দেশের পরিবার এবং স্কুলগুলোর দিকে তাকালেই এর ভয়াবহ রূপ পরিলক্ষিত হয়। কী নির্মম, নিদারুণ বোঝা চাপিয়ে দিয়ে শিশুদেরকে মানুষ থেকে তথাকথিত যান্ত্রিক মানুষ বানানোর দুর্বার চেষ্টা চলছে। আর এই চেষ্টায় প্রাথমিক শিক্ষা থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা হয়ে পড়েছে কোচিং নির্ভর। এভাবে মুখস্থ যান্ত্রিক শিক্ষায় ব্যতিব্যস্ত সন্তানেরা আসলে তারা কি প্রকৃত শিক্ষা পাচ্ছে ? না সত্যিকার মানুষ হচ্ছে। হ্যাঁ হচ্ছে, তবে তা হয় অতিরিক্ত শিক্ষার চাপে পিষ্ট এক একজন অসহায় প্রাণিবৎ মানুষ। একটি শিশুর শিক্ষার প্রথম পর্যায় হওয়া উচিত ভাষার সাথে পরিচয় করে দেওয়া। এই ভাষা শিক্ষাটা অবশ্যই আশে-পাশের পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে পর্যবেক্ষণ মারফত হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, শিশুর ভাষা শিক্ষার জন্য ওয়ার্ড বুক চাপিয়ে দেওয়া হয়। মাতৃভাষা বাংলার চেয়ে বেশি করে ইংরেজি শেখার প্রতি মানসিক চাপ প্রয়োগ করা হয়। এভাবে শুরু হয় মুখস্ত বিদ্যার কল বানানোর প্রথম পর্যায়। পাশ্চাত্যে যেখানে বিদ্যালয়গুলোতে প্রথমে শোনানো হয় তারপর বলানো এবং পরে লেখানোর পাঠদান করা হয়, যা শিশু মননের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অন্যদিকে আমাদের দেশে পুরো উল্টো বিষয়। আগে লেখা শেখানো হয় তারপর পড়া। পুরোপুরি ভুল শিক্ষাপদ্ধতি আর কী। আর শিশুর শৈশবে ভাষা জ্ঞানটা হওয়া উচিত মাতৃভাষায়। তাহলে একটি শিশুর মধ্যে শিক্ষার সাথে জীবনের সামঞ্জস্য সাধন ঘটবে। তাই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- ‘আমাদের বাল্যকালের শিক্ষায় আমরা ভাষার সহিত ভাব পাই না। আবার বয়স হইলে ঠিক তাহার বিপরীত ঘটে, যখন ভাব জুটিতে থাকে তখন ভাষা পাওয়া যায় না। এ কথাও পূর্বে উল্লেখ করিয়াছি যে, ভাষাশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ভাবশিক্ষা একত্রে অবিচ্ছেদ্যভাবে বৃদ্ধি পায় না বলিয়াই য়ুরোপীয় ভাবের যথার্থ নিকটসংসর্গ লাভ করি না এবং সেই জন্যই আজকাল আমাদের অনেক শিক্ষিত লোক য়ুরোপীয় ভাব সকলের প্রতি অনাদর প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিয়াছেন। অন্যদিকেও তেমনি ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই আপনার মাতৃভাষাকে দৃঢ় সম্বন্ধ রূপে পান নাই বলিয়া মাতৃভাষা হইতে তাঁহারা দূরে পড়িয়া গেছেন এবং মাতৃভাষার প্রতি তাঁহাদের একটি অবজ্ঞা জন্মিয়া গিয়াছে। বাংলা তাঁহারা জানেন না সে কথা ¯পষ্টরূপে স্বীকার না করিয়া তাঁহারা বলেন, বাংলায় কি কোন ভাব প্রকাশ করা যায়? এ ভাষা আমাদের মতো শিক্ষিত মনের উপযোগী নহে। প্রকৃত কথা আঙুর আয়ত্তের অতীত হইলে তাহাকে টক বলিয়া উপেক্ষা আমরা অনেক সময় অজ্ঞাত সারে করিয়া থাকি…।’ (শিক্ষার হেরফের)। মূলত শিক্ষার মূল লক্ষই হচ্ছে আত্মাবিকাশ থেকে আত্মদর্শন। সকল ক্ষুদ্রতা ঝেড়ে ফেলে বিশ্বজনীন জীবন ভাবনায় আপন অন্তরের অসীম সত্যকে দু’হাতে বিলানোর মাধ্যমে আমরা প্রকৃত স্বস্তি পেতে পারি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সীমাবদ্ধতা শেখাবে সীমানা ভাঙার গান। অথচ চলমান শিক্ষাপদ্ধতি চিরকাল কতিপয় স্বার্থপর ব্যক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে, হোক সে দেশের বা বিদেশের। তাই শিক্ষা সংস্কার প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-‘বিদ্যাশিক্ষায় আমাদেরও মন খাটিতেছে নাÑ আমাদেরও শিক্ষাপ্রণালীতে কলের অংশ বেশি। যে-ভাষায় আমাদের শিক্ষা সমাধা হয়, সে-ভাষায় প্রবেশ করিতে আমাদের অনেক দিন লাগে। ততদিন পর্যন্ত কেবল দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া হাতুড়ি পেটা এবং কুলুপ-খোলার তত্ত্ব অভ্যাস করিতেই প্রাণান্ত হইতে হয়। আমাদের মন তেরো-চোদ্দো বছর বয়স হইতেই জ্ঞানের আলোক এবং ভাবের রস গ্রহণ করিবার জন্য ফুটিবার উপক্রম করিতে থাকে, সেই সময়েই অহরহ যদি তাহার উপর বিদেশী ভাষার ব্যাকরণ এবং মুখস্থবিদ্যার শিলাবৃষ্টিবর্ষণ হইতে থাকে, তবে তাহা পুষ্টিলাভ করিবে কী করিয়া। প্রায় বছর কুড়ি বয়স পর্যন্ত মারামারির পর ইংরেজি ভাষায় আমাদের স্বাধীন অধিকার জন্মে, কিন্তু ততদিন আমাদের মন কী খোরাকে বাঁচিয়াছে। আমরা কী ভাবিতে পাইয়াছি, আমাদের হৃদয় কী রস আকর্ষণ করিয়াছে, আমাদের কল্পনাবৃত্তি সৃষ্টিকার্য চর্চার জন্য কী উপকরণ লাভ করিয়াছে। যাহা গ্রহণ করি, তাহা সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ করিতে থাকিলে তবেই ধারণাটা পাকা হয়। পরের ভাষায় গ্রহণ করাও শক্ত প্রকাশ করাও কঠিন। এইরূপে রচনা করিবার চর্চা না থাকাতে যাহা শিখি তাহাতে আমাদের অধিকার দৃঢ় হইতেই পারে না। তবু মুখস্থ করিয়া শেখা এবং লেখা, দুয়ের কাজ চালাইয়া দিতে হয়। যে-বয়সে মন অনেকটা পরিমাণে পাকিয়া যায়, সে-বয়সের লাভ পুরালাভ নহে। যে-কাঁচাবয়সে মন অজ্ঞাতসারে আপনার খাদ্য শোষণ করিতে পারে, তখনই সে জ্ঞান ও ভাবকে আপনার রক্তমাংসের সহিত পূর্ণভাবে মিশাইয়া নিজেকে সজীব সবল সক্ষম করিয়া তোলে। সেই সময়টাই আমাদের মাঠে মারা যায়। সে-মাঠ শস্যশূণ্য অনুর্বর নীরস মাঠ। সেই মাঠে আমাদের বুদ্ধি ও স্বাস্থ্য কত যে মরিয়াছে তাহার হিসাব কে রাখে।’
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে আমাদের দেশে প্রচলিত ইংলিশ মিডিয়াম এবং ও-লেভেল, এ-লেভেল পর্যায়ের স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য। তাদের প্রতি দৃষ্টি দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। এই জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা আসলে এক ধরনের পরগাছা শ্রেণির নাগরিক তৈরি করছি। দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য সর্বোপরি মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা এদের মধ্যে বিকাশ লাভ করে না। তারা অবস্থান করে এ দেশে কিন্তু তাদের স্বপ্ন, আশা-আকাক্সক্ষা, ভবিষ্যত পরিকল্পনা তৈরি হয় ইউরোপ-আমেরিকার আদলে। তাই তারা নিজ দেশে থেকেও পরবাসী। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বড় ত্রুটিটিও হলো মুখস্তবিদ্যায় ছাত্রদেরকে পারদর্শী করে তোলারই প্রতিযোগিতা। যে শিক্ষার সাথে কোনো আনন্দ নেই, সেই শিক্ষায় কেউ মননশীল, সৃষ্টিশীল মানুষ হতে পারে না। আর সৃষ্টিশীলতা ব্যতিত শিক্ষার কোনো মূল্যও নেই। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-নিজের প্রতি, জীবন ও জগতের প্রতি ভালোবাসা ও মমত্ববোধের শিক্ষাটা কোনো শিশুই মাতৃগর্ভ থেকে শিখে আসে না। পরিবারে, স্কুলে তাকে শেখাতে হয়। পাঠ্যপুস্তকের ও সহপাঠ বইয়ের আশ্রয়ে এবং শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর দিয়ে শিশুকে শেখাতে হয় কী করে দেশ, দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশকে আপন করে নেবে; কী করে দেশের মহৎ অর্জনগুলোকে ভালোবাসতে ও সম্মান করতে শিখবে, জাতি-ধর্ম-গোত্র-ধনী-দরিদ্র-সকল মানুষকে কী করে ভালোবাসতে, শ্রদ্ধা করতে, সম্মান করতে শিখবে। এই শিক্ষাই সর্বাগ্রে জরুরি। শুধু কাগজ-কলমে পরীক্ষার ব্যবস্থা করে শিশুর সুনাগরিক হয়ে ওঠার দক্ষতা পরিমাপ করা যায় না; পরিশীলিত মানুষ হয়ে ওঠার প্রবণতা যাচাই করা যায় না। এর জন্য দরকার নিবিড় পরিচর্যা। শিশুর সকল সম্ভাবনাকে বিবেচনায় রেখে গভীর মমতা ও ¯েœহ দিয়ে তাদের শিক্ষিত করে তোলা দরকার। রবীন্দ্রনাথ এ স¤পর্কে বলেছেন-‘ছেলে যদি মানুষ করিতে চাই তবে ছেলেবেলা হইতেই তাহাকে মানুষ করিতে আরম্ভ করিতে হইবে; নতুবা সে ছেলেই থাকিবে, মানুষ হইবে না। শিশুকাল হইতেই, কেবল স্মরণশক্তির উপর সমস্ত ভর না দিয়া, সঙ্গে সঙ্গে যথা পরিমাণে চিন্তাশক্তি ও কল্পনাশক্তির স্বাধীন পরিচালনার অবসর দিতে হইবে। সকাল হইতে সন্ধ্যা কেবলই লাঙল দিয়া চাষ এবং মই দিয়া ঢেলা ভাঙ্গা, কেবলই ঠেঙালাঠি মুখস্থ এবং একজামিন আমাদের এই মানব-জনম-আবাদের পক্ষে, আমাদের এই দুর্লভ ক্ষেত্রে সোনা ফলাইবার পক্ষে যথেষ্ট নহে। এই শুষ্ক ধুলির সঙ্গে, এই অবিশ্রাম কর্ষণ পীড়নের সঙ্গে রস থাকা চাই।” (শিক্ষার হেরফের)।
নানাভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ভিতরে-বাহিরে সমস্যাগ্রস্ত। রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতার খপ্পরে পড়ে আজ শিক্ষাদর্শন বাণিজ্যিক আগ্রাসনের কাছে পরাস্ত প্রায়। তাই আমাদের শিক্ষাদর্শন আজ হুমকির সম্মুখিন। এর ভয়াবহতা খুঁজে পাওয়া যাবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন আজ শুধুই সনদ বিক্রির প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তাইতো দেখা যায়, বাজারের পণ্যের চাহিদার মতো করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিষয়ের মূল্য নিরূপিত হচ্ছে। এখানে মানবিক বিষয়গুলোর চেয়ে বাণিজ্য বিষয়গুলো পড়তে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আগ্রহ প্রবল। আর যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ., এমবিএ বা ক¤িপউটার সায়েন্স, চিকিৎসাবিদ্যা এবং ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে অধ্যয়ন করে, তাদের মধ্যে অধিকাংশেরই মানসিকতা বিদেশি বহুজাতিক কো¤পানিতে বেশি বেতনের চাকরি পাওয়ার। অর্থাৎ তাদের কাছে শিক্ষা মানবিকবোধ, চেতনা বিকাশের কোনো মাধ্যম নয়; এখন এটা শুধুমাত্র ব্যবসা ও মুনাফা লাভের মাধ্যম। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আর একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, অর্জিত শিক্ষার সাথে ব্যবহারিক জীবনের বিস্তর ফারাক। যেমন-তত্ত্বীয় বিজ্ঞানে পড়াশোনা করেও খুব স্বাভাবিকভাবেই ধর্মীয় কুসংস্কার, আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতা এবং সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনা দ্বারা নিজেকে চালিত করা। আবার এও দেখা যায়, বিজ্ঞানের কোনো সূত্রের সাথে ধর্মীয় গ্রন্থের কোনো ঘটনা, শ্লোক বা আয়াত প্রমাণের চেষ্টা করা। ধর্ম হলো বিশ্বাসের বিষয়, আর বিজ্ঞান-দর্শন হলো যুক্তি ও পরীক্ষার বিষয়। এই বিষয়গুলো ঘটে সিলেবাসে শুধু বিষয়ের বিষয়ীকরণ করার কারণে। কারণ-যে শিক্ষার্থী বিজ্ঞান, প্রকৌশল বা চিকিৎসা বিদ্যায় অধ্যয়ন করে, তারা শুধু ওই বিষয়ের উপরই পড়াশোনা করে। এসব বিষয়ের সিলেবাসে সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞানের ইতিহাস ও দর্শন, ইতিহাসের দর্শন প্রভৃতি বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকে না। তাই শিক্ষার্থীরা এক ধরনের একমুখি জ্ঞান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ অর্জন করে এবং পরগাছা গোত্রের মানুষে রূপান্তরিত হয়। তাই রবীন্দ্রনাথ তার শিক্ষার বাহন প্রবন্ধে বলেছেন- ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় হইতেও আমরা সেই ডিগ্রীর টাকশালের ছাপ লওয়াকেই বিদ্যালাভ বলিয়া গণ্য করিয়াছি। ইহা আমাদের অভ্যাস হইয়া গেছে। আমরা বিদ্যা পাই বা না পাই বিদ্যালয়ের একটা ছাঁচ পাইয়াছি। আমাদের মুশকিল এই যে, আমরা চিরদিন ছাঁচের উপাসক। ছাঁচে-ঢালাই করা রীতিনীতি চাল-চলনকেই নানা আকারে পূজার অর্ঘ্য দিয়া এই ছাঁচ-দেবীর প্রতি অচলা ভক্তি আমাদের মজ্জাগত। সেই জন্য ছাঁচে ঢালা বিদ্যাটাকে আমরা দেবীর বরদান বলিয়া মাথায় করিয়া লই; ইহার চেয়ে বড়ো কিছু আছে এ কথা মনে করাও আমাদের পক্ষে শক্ত।’ আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিতে মানবিক বোধ এবং মানসিক চিন্তাশক্তি বাড়ানোর এবং সৃষ্টিশীল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই শিক্ষাপদ্ধতিতে ভালো শিক্ষার্থী নির্ধারণের মাপকাঠি হলো- পরীক্ষার খাতায় কে কতো ভালোভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, তার উপর নির্ভর করে ভালো কে তার নির্বাচন। কিন্তু চিন্তা যে নিরন্তর চর্চার বিষয় এবং চর্চায় মাধ্যমেই শিক্ষার্থী উন্নততর এবং জটিল চিন্তায় ব্যাপৃত হতে পারে, এ বিষয়টি কখনও তেমন বিবেচনায় আনা হয় না। অধিকন্তু প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নোট মুখস্থ করার জোর প্রতিযোগিতা। আর এর মাধ্যমে ঘটে পরীক্ষার পাশের সনদ। মুখস্ত করার এই ভয়ংকর প্রবণতাকে রবীন্দ্রনাথ চৌর্যবৃত্তির সাথে তুলনা করেছেন। শিক্ষা নামক গ্রন্থের ‘শিক্ষার বাহন’, এবং ‘শিক্ষার সঙ্গীকরণ’ নামক প্রবন্ধে পরীক্ষা পাসের জন্য শিক্ষার্থীদের মুখস্থনির্ভরতার প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি শুধু ঔপনিবেশিক শিক্ষাদর্শনের বিরোধীতাই করেন নি, পাশাপাশি এ শিক্ষাদর্শনের বিপরীতে নতুন শিক্ষা পদ্ধতি বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি বিকল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছিলেন। যা আজও কালের সাক্ষী হয়ে তার বার্তা বহন করছে, কিছুটা হলেও চারদিকে তার সুবাতাস ছড়াচ্ছে। যদিও রবীন্দ্র পরবর্তী সময়ে এই বিশ্ববিদ্যায়তনেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। নানারকম বিধিনিষেধ জুড়ে সেটি এখন অনেকটায় সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মত। এখন সেখানেও শিক্ষার্থী ধর্ষণ হচ্ছে। দুই বছরের মাস্টার্স কোর্স করতে আরও বাড়তি এক বছর তাদের পিছে পিছে ঘুরতে হয় ব্রিজ কোর্সের নামে। যদিও রবীন্দ্রনাথ মাতৃভাষা বাংলার প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন তবু তারা ইংরেজিকেই পুজা করতে অভ্যস্ত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকাবস্থায় এই দুষ্কর্মটি তিঁনি কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তবে একটি কথা না বললেই নয় যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের শিক্ষাপদ্ধতির যে সব ত্রুটির কথা বলেছেন, সেসব ত্রুটির বাইরেও সময়ের সাথে সাথে এইসব সমস্যা বেড়ে গেছে বহুগুণ। এসব সমস্যা সমাধান কীভাবে সম্ভব যদি না তার মূলে পৌঁছানো যায় ? আর বর্তমানে অশিক্ষিত চোর, বাটপার, খুনি, ধর্ষক, লুটেরা, দুর্নীতিবাজ চরিত্রহীন রাজনৈতিক নেতারা সংসদে গিয়ে জাতির ভাগ্য বিধাতার আসনে বসে নিজেদের মতো আইন প্রণয়ন করছে। আর তাদের আশীর্বাদ পেতে তথাকথিত অধ্যাপক, শিক্ষাবিদগণ তাদের পদলেহি হয়ে পেছন পেছন লাইন দিচ্ছেন। তাই শুধুমাত্র আদর্শের কথা মুখে বলে তার সুফল ঘরে তোলা সম্ভব নয়, যতক্ষণ না আমরা এর মূল প্রভাবককে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে দেখব। অর্থাৎ একটি দেশের রাষ্ট্র পরিচালনাকারী গোষ্ঠি যেভাবে জনগণকে রাষ্ট্রের অনুগত রাখতে চান, তারা সেভাবেই রাজনৈতিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে রাষ্ট্র কাঠামোর সাথে স¤পর্কিত অন্যান্য বিষয়সহ শিক্ষাপদ্ধতিও তাদের মতো করে ঢেলে সাজাতে পারেন। এটাই স্বাভাবিক বিষয়। আর তাই জনগণের সজাগ দৃষ্টি ও প্রত্যাশার সাথে সাথে এ বিষয়কে সার্থক করতে রাষ্ট্রসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। তাই  চলমান এই সমস্যার রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই সমস্যার সমাধান সবার আগে রাষ্ট্রের হাতে ছেড়ে দেয়ার পাশাপাশি এ বিষয়ের ব্যবহারিক দিকটিকে এগিয়ে নিতে শুধু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল পাঠপদ্ধতি ও এর পাঠ্যক্রম নিয়ে তাঁর সর্বকালীন শিক্ষাদর্শন এর উপর যথার্থ ত্রুটি নির্দেশ করেছেন। তাই নিঃসন্দেহে, আমাদের অস্থির ক্ষয়িষ্ণু এই সময়ের হাত থেকে মানবজীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অর্জন শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে রবীন্দ্র শিক্ষাদর্শনের আলোকে তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং বর্তমানে বহুজাতিক কোম্পানির পণ্যরূপ প্রতিষ্ঠিত ঔপনিবেশিক তথা বাণিজ্যিক শিক্ষা কাঠামোকে পরিহার করার মাধ্যমেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার চলমান ত্রুটিগুলোকে শনাক্ত এবং সমাধানের রূপরেখা নিরুপণের জন্য জাতির গুণি বিদ্বান সন্তানদের ভাবতে হবে আজই। যা মানবজাতির সুমহান শিক্ষাব্যবস্থাকে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করবে।
লেখক : রবীন্দ্র গবেষক ও লেখক
যধংংধহৎধলধথৎধল @ুধযড়ড়.পড়স