আমি কখনোই বেশি পান করি না

আপডেট: নভেম্বর ১২, ২০১৬, ১১:৩১ অপরাহ্ণ

জাসটিন ট্রুডু
একটু কল্পনা করলেই ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারবে সেই সময় ম্যাকগিল উইমেন্স ইউনিয়ন এবং সেক্সচুয়াল এসল্ট সেন্টার অফ ম্যাকগিল’স স্টুডেন্টস সোসাইটির বিতার্কিক মেয়েদের কর্মকা- কীভাবে একই ধারায় প্রবাহিত হচ্ছিলো। আমি যখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, তখন সেন্টারটি পুরুষ পরামর্শক নিয়োগ দেয়া শুরু করে। ম্যারি মার্গারেট জোনস নামে আমার এক বন্ধু আমাকে এমন কাজে যুক্ত হবার জন্য আহ্বান জানায়। কয়েক বছর আগে ইউনিভার্সিটি অফ মন্ট্রিয়লস ইকোল পলিটেকনিক এ ঘটে যাওয়া সেই ভয়াবহ ঘটনা আমাকে নারীদের বিষয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী করে তুলে। সেই ঘটনার জায়গাটা ছিলো আমার স্কুলের একেবারে কাছে। ইতোমধ্যে আমি সত্যিই বিতর্কের কচকচানিতে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার শুধু মনে হচ্ছিলো, আর বেশি কথার ফুলঝরি নয়, এবার কাজ করার সময় এসেছে। আর যেহেতু আমার মানুষের সাথে যোগাযোগ করার ভালো এক ক্ষমতা আছে অতএব একটা যথার্থ ও সুন্দর কাজের জন্য সেটার সদ্ব্যবহার করা যেতেই পারে।
সেক্সচুয়াল এসল্ট সেন্টার তার স্বাভাবিক কাজের বাইরে একটি দল গঠন করে যার মূল কাজ ছিলো যৌনভাবে নিগৃহীত হয়েছে এমন কারো বিশেষ সাহায্য-সহযোগিতা বা পরামর্শের প্রয়োজন পড়লে তাদের বাড়িতে গিয়ে বা সংগঠনের কক্ষে তাদের সাথে প্রয়োজনীয় কথা বলে বা আলাপ করে তার সম্ভাব্য সমাধান খুঁজে বের করা।
যৌনভাবে  নিগৃহীত বা ধর্ষণের শিকার হয়েছে এমন কারোর সাথে কথা বা আলোচনা করার জন্য সেই নারী কর্মীদের পাশাপাশি যে কিছু সংখ্যক ছেলেদের নেয়া হয়েছিলো আমি ছিলাম তাদের মধ্যে প্রথম দলে। আমরা একটু আলাদাভাবে অভিনয় এবং আলোচনার মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের চিন্তা-চেতনায় যৌন হয়রানির স্বরূপ ও প্রভাবটা তুলে ধরার চেষ্টা চালিয়ে যেতাম। আমাদের এই প্রচেষ্টা বা এই বিষয়টাকে সবার সামনে তুলে ধরার যে কৌশল ছিলো তা বিশেষভাবে এক গুরুত্বের দাবি রাখে। কারণ অনেকেরই ধারণা ছিলো, ধর্ষণ এমন একটা বিষয় যা সাধারণত হয়ে থাকে। ঝোপ-ঝাড়ের আড়াল থেকে কোনো অপরিচিত এক ব্যক্তি কারো ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো আর তেমন এক বাজে কাজ করে ফেললো। কিন্তু আমরা সবাইকে বুঝাতে চাচ্ছিলাম যে, ধর্ষণের যারা শিকার হন তারা অধিকাংশই অপরিচিত কোনো ব্যক্তি দ্বারা হন না, বরং এর সাথে যুক্ত থাকে তাদের আশেপাশের খুবই পরিচিত মানুষ যাদের চিন্তায় সেক্স ও ক্ষমতার লিপ্সা প্রচ-ভাবে কাজ করে। আমরা এমন কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম যাতে ভবিষ্যতে কোনো মেয়েকে যদি এমন অপ্রত্যাশিত অবস্থায় পড়তে হয় তবে সে উত্তেজিত বা ধ্বংসাত্মক কিছু  না করে কীভাবে বুদ্ধির সাথে বিষয়টার মোকাবেলা করে সেখান থেকে নিজেকে রক্ষা করবে। আমরা পুরুষদের জানাতে চাইতাম মেয়েরা তাদের যে সব মেসেজ দেয় সেগুলোর মানে যেনো ঠিকভাবে বুঝে, সেই মেয়ের সাথে সেভাবে আচরণ করে। মেয়েরা যে রাজি নয় এটা বুঝানোর জন্য “না’ শব্দটায় যে ব্যবহার করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। তারা যদি বলে, “আমি এই বিষয়টাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি না।” – এমনটা বললেও বুঝে নিতে হবে তারা ওটা চাচ্ছে না। অথবা তারা যদি এমনও বলে, “আমাদের এখন আবার পার্টিতে ফিরে যাওয়া উচিৎ,” তাহলেও বুঝতে হবে তারা সেক্সের পর্যায়ে যেতে চাচ্ছে না। ফলে পুরুষদের সে ধরনের ব্যবহার করা উচিৎ বা সে রকম ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখা প্রয়োজন যাতে অপ্রীতিকর কিছু না ঘটে।
আমার ভাবতে ভালো লাগে সেক্সুয়াল এসাল্ট সেন্টার -এ আমাদের কাজকর্ম বেশ ইতিবাচক ফল নিয়ে এসেছিল। প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে কেমন এনেছিলো সেটার কথা বলছি না, কিন্তু ছাত্রদের ক্ষেত্রে এই ফলাফলটা ছিলো খুবই ইতিবাচক। ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন যখন যৌন নিপীড়ন বিষয়টা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দিক থেকে দেখভাল করার জন্য একজনকে নিয়োগ দেয়ার উদ্যেগ নিচ্ছিলো আর বিষয়টা নিয়ে কিছুটা কানাঘুষা চলচ্ছিলো, তখন আমি এবং আরেকজন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট এর সাথে এ ব্যাপারে আমাদের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে কথা বলেছিলাম।  আমার জীবনে এটা একটা খুব বড় শিক্ষা ছিলো যে, মানতে না পারা বিষয় নিয়ে প্রতিষ্ঠানের সাথে কীভাবে সুন্দর ও শালীনভাবে কথা বলে এর সমাধানের পথে যাওয়া যায়। আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টা ওমনভাবে তুলে ধরার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আমাদেরকে ধন্যবাদ দেয়া হয়েছিলো। তবে খুব ভদ্রভাবেই আমাদের প্রস্তাব এড়িয়ে কর্তৃপক্ষ তাদের সিদ্ধান্তেই বহাল ছিলো।
খুব স্বাভাবিকভাবেই ম্যাকগিলের সেই বছরগুলোতে আমার ভিতর সামাজিক চিন্তা চেতনার একটা বড় পরিবর্তন এসেছিলো। আমার জীবনে সেই দল বেঁধে হৈ চৈ এর ব্যাপারটা কমে আসছিলো এবং আমার আসলে কী করা উচিৎ বা কোন পথে চলা প্রয়োজন সেটা সম্পর্কে আমার ভিতর এক সুষ্ঠূ ধ্যান-ধারণার জন্ম হচ্ছিলো। আমি তখনও বাবার কাছেই থাকতাম। বাবা আমাকে সামান্যটুকু স্বাধীনতা দিতেন না। তবে এটা সত্যি, মাঝে মধ্যে আমি নিজেকে বয়স্ক সমাজ জীবনের আনন্দ-উচ্ছ্বাস আর উচ্ছ্বংখলার মধ্যে ডুবিয়ে ফেলতাম।
আমার আঠারো বছর হওয়া পর্যন্ত আমি যে মদ পান করতাম, তা ছিলো কোনো নৈশভোজে এক গ্লাস ওয়াইন বা এমন কিছু। স্কুলে থাকতে আমি সাধারণত কোনো রকম মদ পান করতে চাইতাম না যার ফলে ব্রেবফ এর কোনো পার্টি শেষে গাড়ি চালানোর ভারটা আমার ওপরই পড়তো। সেই সব পার্টিতে আমি যখন বলতাম, ” একটু ভালো সময় উপভোগ করার জন্য আমি পান করতে চাই না”, তখন অন্যরা চোখ ঘুরিয়ে আমাকে ভালোভাবে দেখে নিতো। আমি কিন্তু ভিতর থেকেই মদ্যপানের কোনো তৃষ্ণা না থাকার ফলেই এমনটা বলতাম যে, আমি পান করবো না এবং আমি তাই করতাম। কয়েকটি বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া, বাবার মৃত্যুর সময়ের সেই মাসগুলিতে আমার জীবনে কখনো বেহুশ মদ্যপানের কোনো ঘটনা ঘটেনি। মাঝে মধ্যে আমি হয়তো এক গ্লাস সুন্দর ঠা-া বিয়ার খেয়েছি অথবা ভালো কোনো খাবারের সাথে এক গ্লাস ওয়াইন, এই ছিলো আমার মদ পানের স্বাভাবিক অভ্যাস। সত্যি কথা বলতে কী, আমি কখনোই বেশি পান করি না।
তবে বলতে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার জীবনে বন্ধুদের সাথে অল্প কিছু সময় পার্টিতে কেটেছে। থিয়েটার-সেন্ট-ডেনিস এর কোণার দিকে রু ইমেরি’তে বন্ধুরা একটা মজার অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করেছিলো এবং ওখানেই মাঝে মাঝে চমৎকার সব পার্টির হতো। এক রাতে সেই পার্টিতে পান করে আমি এত বেশি টালমাটাল হয়ে গেলাম যে ম্যাকগিল মার্টলেটস এর ছাপ মারা পোষাক পরে দৌড়ে রাস্তায় নেমে গেলাম। ম্যাকগিল মার্টলেটস নামটা দেয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি বিশেষ অ্যাথলেটিক দলকে। (তবে আমাকে জিজ্ঞেস করো না অ্যাপার্টমেন্ট এর পার্টিটা কীভাবে শেষ হয়েছিলো)। সেই পোষাকের ছাপটা দেখতে ছিল একটা রাগান্বিত চঞ্চুওয়ালা লাল দোয়েলের মত। একেবারে টাল অবস্থায় ওই মুহূর্তে আমার মনে হলো, জীবনের চরমতম আনন্দটা উপভোগ করতে গেলে সেই বড় রাগান্বিত দোয়েলটাকে রাস্তার ধারের সব জানালাগুলোয় বসিয়ে দিই। দোয়েলগুলো যখন শব্দ করে চুক চুক করে ডাকবে, তখন সেন্ট-ডেনিস রাস্তা দিয়ে যারাই যাবে তারাই কিছুক্ষণের জন্য হলেও চমকে উঠবে। আমার মনে হচ্ছিলো, পথচারীদের এমন চমকে উঠা কা-টা দেখা হবে সবচেয়ে আনন্দের।
আমি মনে হয় মাতলামিটা খুব বেশি করে ফেলছিলাম। বন্ধুরা বুঝতে পারছিলো আমাকে আর বেশি মাতলামি করতে দেয়া উচিৎ নয়। ফলে তারা আমাকে জাপটে ধরে বুঝাতে চাইছিলো, আমরা আর একটা চমৎকার সুন্দর পার্টিতে যাবো। এই বলে তারা আমার শরীর থেকে  আস্তে করে সেই ছাপ মারা পোষাকটা খুলে নিয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে আমাকে একা পেছনের সিটে বসিয়ে ড্রাইভারকে আমার বাসার ঠিকানাটা বলে আমাকে বাড়ির দিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলো।
আমি যখন বাড়িতে পৌঁচ্ছিলাম, তখন বাবা কোনো এক ডিনার পার্টি থেকে বাসায় ফিরছিলেন। আমার ওই অবস্থা দেখে তিনি খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন। পরের দিন সকালে তিনি আমাকে সামনে বসিয়ে মদ্যপানের যত সব খারাপ দিক আছে সেগুলো শুনাতে লাগলেন। আমি চুপ করে সব কিছু শুনে যাচ্ছিলাম। আমি কোন পরিপ্রেক্ষিতে এবং কেনো এমন মাতাল হয়ে গেলাম তার কিছুই আমি বাবাকে বললাম না, এমন কী এমন কিছুই বললাম না, তাঁর তিন ছেলের মধ্য আমি সব সময় যা কিছু করি সেগুলোতে কারো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয় এবং আমি মদ পানকে আনন্দ হিসেবেও নিই না। ফলে আমাকে নিয়ে তাঁর চিন্তার তেমন কিছুই নেয়। কিন্তু সেই মুহূর্তে বাবার কথার পিঠে পিঠে কথা বলার মত অবস্থা আমার ছিলো না।
(চলবে)