শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
জাসটিন ট্রুডু
আমার আন্ডারগ্রাজুয়েট বছরগুলোতে আমি যখন ইংরেজি সাহিত্য পড়ছিলাম, তখন আমি শত শত বই পড়ে ফেলেছিলাম এবং সেই সাথে উইলিয়াম ব্লেক, আলডাক্স হাক্সলি ও ওয়ালেস স্টিভেন্স এর মত বিভিন্ন ধরনের লেখকদের ওপর অনেক রচনা লিখেছিলাম। আমি এই প্রক্রিয়ায় মধ্যে যেতে যেতে জ্ঞানের বুদ্ধিবৃত্তিক দিগন্তের অভিজ্ঞতা নেয়ায় লিবারেল আর্টস পড়ার যে মূল লক্ষ্য থাকে, তার স্বাদ নিতে পেরেছিলাম।
ওই সময়টা আবার আমার কাছে ছিলো সমস্ত রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনা ও আদর্শকে গ্রহণ ও বর্জনের এক পরীক্ষণের সময়। সাধারণত এই ধরনের ব্যাপারটা কুড়ি বছরের আগে পিছে থাকা সব ছেলে মেয়ের মধ্যেই ঘটে যারা মনে মনে এক ধরনের আদর্শিক চিন্তা-ভাবনা নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। এই প্রবেশের সাথে সাথেই সাধারণত তাদের মনে গভীর কিছু নাটকীয় প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। প্রশ্নগুলো সাধারণত হয়ে থাকে, আমাদের এই জীবনের অর্থ কী বা কীভাবে একটা ভালো সমাজ গড়া যায়? অথবা সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আমাদের কোন পথ অবলম্বন করা উচিৎ? এই ধরনের অনুসন্ধান বা জিজ্ঞাসু মন ক্যাম্পাসের অধিকাংশ বুদ্ধি চর্চার ছেলেমেয়েকে হয় গোঁড়া মার্ক্সবাদ বা আয়ান র্যান্ডস এর বস্তুনিষ্ঠবাদ মতবাদের দিকে ধাবিত করে।
আমি কলেজের যে কোনো ছাত্রের মতই এ ব্যাপারে খুবই উৎসুক ছিলাম, কিন্তু আমি সবসময়ই কাউকে অতিরিক্ত ভক্তি করা বা কাউকে একেবারে গোনার মধ্যে না আনার যে চর্চা সে ব্যাপারে সন্ধিহান ছিলাম। আমার বাবা থমাস একুইনাস এর সেই যে সচেতন উচ্চারণ-“এক পক্ষ নেয়া গোঁড়া ব্যক্তিকে আমি সবসময় ভয় করে চলি” ‘কে খুবই পছন্দ করতেন। বাবার এই পছন্দটাকে আমি গভীরভাবে হৃদয় দিয়ে ধারণ করতাম। ফলে যখনই আমার কোনো বন্ধু বা ক্লাসমেট এসে আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করতো যে, জীবনে সব চেয়ে না সমাধান হওয়া ও বারবার উচ্চারিত প্রশ্নের উত্তর বা যে কোনো বড় রাজনৈতিক ব্যাপারের সমাধান পাওয়া যেতে পারে শুধুমাত্র ‘কমিউনিস্ট ম্যানুফেস্টো”তে বা ‘এটলাস শ্রাগড”এ অথবা এ ধরনের একপেশী কোনো দর্শনে। তখন আমি সেটা কোনোভাবেই মানতে পারতাম না। সত্যি বলতে কী, এ ব্যাপারগুলোতে বা এ সব ভাবনায় আমি ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম। আমার বাবার কাছ থেকে একটা যে বড় ও গভীর জ্ঞান আমি নিয়েছিলাম তা হচ্ছে, এই পৃথিবীটা হচ্ছে একটা এত বৃহৎ জায়গা আর এত বিভিন্ন ধরনের বিষয় নিয়ে তৈরি যে কখনো কোন এক বিশেষ মতবাদ বা দর্শন দিয়ে এর সব কিছু বিচার করা যাবে না বা সবকিছুকে এক আদর্শিক ছাতার নীচে কখনোই আনা উচিত নয়। আমি আমার ক্যাম্পাসে যতগুলো রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনার চর্চা চলছিলো আমি তার সব কিছুই জানার চেষ্টা করতাম, কিন্তু আমি যখন গ্রাজুয়েট হলাম তখনো আমি সেই ক্যাম্পাসে প্রবেশের সময়ের মতই উন্মুক্ত মনেরই একজন মানুষ ছিলাম যে কোনো গোঁড়া মতবাদকে ধারণ করে নি বা এক পেশে কোনো মতবাদ বা দর্শনে বুদ হয়ে থাকে নি।
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বছরগুলো ছিলো কুইবেক, প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা এবং দেশ হিসেবে কানাডার যে ধরণ তার সাথে এক গভীর বুঝাপড়ার এক অধ্যায়।
আমি প্রায় বাবাকে বলতে শুনতাম তাঁর যৌবনকালের কুইবেকের রাজনৈতিক পরিবেশ কেমন ছিল। সেই সাথে তিনি কীভাবে বিচলিত হতেন তাঁর সময় এবং আমার সময়ে সেই কুইবেকের রাজনৈতিক জগতে যে ব্যাপক এক পার্থক্য বিরাজ করছিলো, তা দেখে। সেই চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে কুইবেকের জাতীয়তাবাদ চেতনা একটা খুব শক্তিশালী শক্তি ছিলো, যেটা বর্তমান সময়ের মত কোনো বিচ্ছিন্নবাদী চিন্তা ভাবনার ছিলো না, বরং সেটা ছিলো সম্পূর্ণ আলাদা কিছু। আমার বাবার যৌবনকালে কুইবেকের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গুরুরা উত্তর আমেরিকার বৃহত্তর প্রটেস্টান্ট বলয়ের মধ্য থেকে এই প্রদেশকে ফরাসি ক্যাথলিক চরিত্র থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। তাঁরা খুবই সাধারণভাবে জোর দিয়েছিলেন কৃষক আর করাতিদের এক সমাজ গড়তে তুলতে যেখানে খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে থাকবে উকিল, পাদ্রী এবং ডাক্তার আর রাজনীতিবিদরা সবকিছু দেখভাল করবে। আর অর্থ ও ব্যবসা সংক্রান্ত সব কাজ চলবে ইংরেজিতে। কিন্তু এই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকলো। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে বাবাসহ একদল চিন্তাবিদ, আর্টিস্ট ও লেখক এক ধরনের নীরব বিপ্লব ঘটাতে শুরু করলেন- যাতে শিক্ষা, নগরায়ন ও অসাম্প্রদায়িকতা হয়ে উঠলো আধুনিক কুইবেকের মূল স্তম্ভ।
কুইবেক ধীরে ধীরে আরো ব্যাপকতার দিকে এগুতে থাকে এবং এর জাতীয়তাবাদ আন্দোলন সত্তরের দশকে এক শক্তিশালী রূপ ধারণ করতে থাকে। আমি আশির দশকে ব্রেবফ এ পড়ার সময় এটা ভালোভাবে কাছ থেকে দেখি। আমি দেখেছিলাম, কুইবেক কীভাবে আরো বেশি সরকারি ক্ষমতা ও ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে আরো বেশি স্বীকৃতির দিকে এগুচ্ছিলো। ১৯৮২ সালে কুইবেকের সম্মতি ছাড়া কানাডার সংবিধানে ফেডারেল সরকারের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন নতুন এক বিতর্কের সূত্রপাত করে যাতে পরবর্তী দশক ধরে এক নতুন সমাধানের চেষ্টা চলতে থাকে যে, কুইবেককে কীভাবে বা কী ধরনের ক্ষমতা দেয়া যায় যাতে তাদের চাওয়া পাওয়াটা মেটানো যায়। রাজনীতিবিদ আর সংবিধান বিশেষজ্ঞরা অনেক দর কষাকষিতে এর সমাধান খুঁজতে থাকেন এবং এর ফলাফল হয়েছিলো ১৯৮৭ সালের ব্যর্থ মিচ লেক চুক্তি।
১৯৯২ সালের শার্লোট-টাউন চুক্তিকে ঘিরে যে গণভোট প্রচারণা শুরু হয়েছিলো তখন আমি ম্যাকগিল এর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, সেই সময়েই কানাডার রাজনীতির সাথে আমি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেলাম।
আমার বাবাসহ বেশ কিছু কানাডার ফেডারেলিস্ট জোরেশোরে এই চুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন। কারণ অবস্থার পরিপ্রক্ষিতে এটা মনে হচ্ছিলো, অটোয়ার কেন্দ্রীয় সরকার কুইবেকের ক্রমবর্ধমান দাবির কাছে নতি স্বীকার করতে যাচ্ছে। চুক্তির এক নম্বর অনুচ্ছেদে যা উল্লেখ আছে তাতে কানাডার সংবিধানে সংশোধনী এনে মেনে নিতে হবে, “কানাডার মধ্য থেকেও কুইবেক সম্পূর্ণ এক আলাদা সমাজ।” এটার ফলে আবার এমনও ঘোষণা দিতে হবে যে, “একটি সম্পূর্ণ আলাদা সমাজ হিসেবে কুইবেককে মেনে নেয়া ও এর প্রচার করার জন্য কুইবেকের সরকার ও আইন পরিষদের যে ভূমিকা তাকে আরো জোর দিয়ে মেনে নেয়া।” আর ২১ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, হাউস অব কমন্স এ শতকরা ২৫ ভাগ আসন সংরক্ষণের নিশ্চয়তা দিতে হবে কুইবেককে, ভবিষ্যতে এর জনসংখ্যা কম বা বেশি যা-ই হোক সেটা কোনো আমলে নেয়া যাবে না।
আমি সব সময় নিজেকে কানাডিয়ান ফেডারেলিস্ট হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম। আমি না করেওতো পারতাম না। কিন্তু ১৯৯০ এর শুরুর দিকে সেই পরিচয়টাও যথেষ্ট ছিলো না। কারণ সেই সময় যে বিভিন্ন ধরনের সংশোধন প্রস্তাব একের পর এক আমাদের চারিদিকে ঘুরপাক খাচ্ছিলো তার মূল লক্ষ্য ছিলো, একটি আদর্শ ফেডারেল কাঠামোটা কী ধরনের হওয়া উচিৎ। যেহেতু শার্লোট-টাউন চুক্তি নিয়ে বিতর্ক তখন পুরোদমে চলচ্ছিলো। আমি সেই চুক্তির সমস্ত বিষয়টা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়া শুরু করলাম। আমি যখন সেই চুক্তির সব অনুচ্ছেদ, ধারা-উপধারার সব পৃষ্ঠা রঙ্গিন কলম দিয়ে দাগিয়ে দাগিয়ে পড়া শেষ করলাম, তখন আমি উপলব্ধি করলাম, ওই চুক্তির নিয়ম-নীতির মধ্যে যে সমস্যা আছে তাতে কুইবেকের করার কিছুই নেই। ওই চুক্তিতে সাধারণ অবস্থায় প্রদেশগুলোকে যে লম্বা ছাড় দেয়া হয়েছিলো, তার বিনিময়ে যা ফেডারেল সরকারের কাছে আসবে তা ছিলো খুবই সামান্য। আমার মনে হয়েছিলো, ওটা একটা অনেক বড় ব্যাপার। আমি কখনোই নিজেকে সেই ধরনের ফেডারেলিস্ট হিসেবে কখনোই মনে করি না, যে চিন্তা করে নীতি নির্মাণের সব ক্ষেত্রেই অটোয়ার উপস্থিতি প্রবল দৃশ্যমান থাকবে। কিন্তু আমি মনে করি, শার্লোট-টাউন চুক্তি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য খুব ভালোভাবে ভারসাম্যের কাজ করতে পারতো। এটা অবশ্যই হতে পারতো, যদি সব ধরনের অনুষ্ঠানে ফেডারেল সরকারের অর্থায়ন বন্ধ করে এবং সব জায়গায় ফেডারেল সরকারের আরোপিত ক্ষমতাকে খর্ব করা যেতো। আমি ধারণা করতে পারছিলাম, এখানেই কিছু একটা ভুল হচ্ছিলো।
(চলবে)