নিজস্ব প্রতিবেদক:
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বাংলার চেয়ে ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ড ব্যবহার বাড়ছে। রাজশাহীতে ব্যবসা- প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সংস্থার ইংরেজি সাইনবোর্ডেও আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। কতিপয় দোকানপাটের সাইনবোর্ডে ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় ব্যবহার রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে পুরো সাইনবোর্ডের অধিক অংশ জুড়েই ইংরেজির ব্যবহার ; বাংলা ছোট করে লেখা থাকে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, এই প্রবণতা দুঃখজনক। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর ক্ষেত্রে এটি অন্তরায়।
বাংলায় সাইনবোর্ড লেখার বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও ৯ বছরেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তবে বেশ কিছু দোকান সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাদের পণ্যগুলো দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডের। বিদেশেও শোরুম রয়েছে। বিদেশে তাদের শোরুমের নাম ইংরেজিতে লেখা। তাই দেশের সাইনবোর্ডগুলোতে ইংরেজিতে লেখা হয়েছে। তবে এসব সাইনবোর্ডেও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা লেখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু সেটা অনেকেই মানছেন না। বাংলা ব্যবহার করলেও তা এতো ছোট কওে ব্যবহার হয়- যা বাংলাকে তুচ্ছ করে দেখানো হয়।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এক আদেশে দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বর প্লেট, সরকারি দফতরের নামফলক এবং গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধ করতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এছাড়া বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭-এর ৩ ধারায়ও সরকারি অফিস, আদালত, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য কাজে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
রাজশাহী নগরীর অলোকার মোড় থেকে গণকপাড়া মোড় পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে দোকান রয়েছে প্রায় ৮০টি। এরমধ্যে শুধু ইংরেজিতে নাম লেখা দোকান রয়েছে ৩১টি। শুধু বাংলায় লেখা নামে দোকান রয়েছে ২৪টি। আর বাংলা-ইংরেজিতে মিলে লেখা দোকান রয়েছে ২৫টি। সেই হিসেবে ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ডের সংখ্যাই বেশি। শুধু ইংরেজিতে নাম লেখা দোকানগুলো হলো রিয়েলমি, ভিভো, কেফে ৭১, স্কাই ব্লু, ওইনার, রাইজ, ইত্যাদি। এছাড়া ইংরেজি বাংলা লেখা দোকানগুলোর মধ্যে রয়েছে- স্টাইল প্রো, দরজি বাড়ি, ডিম্যান্ড, আটিক্যাল, সেইলর ইত্যাদি।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) পক্ষ থেকে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে শুধু ইংরেজি সাইনবোর্ডের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিন্তু তাতেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। এবিষয়ে রাসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আবু সালেহ মো. নূর-ঈ-সাইদ বলেন, ব্যবসায়ীদের বলে লাভ হয় না। প্রতিবছরই আমরা ব্যবসায়ীদের বলি সাইনবোর্ডের ব্যপারে। তারা শোনেন না। তাদের হাইকোর্টের নির্দেশনার বিষয়ে বার বার জানানো হয়েছে। কেউ কেউ শোনেন; আবার অনেকেই শোনেন না। বাংলা সাইনবোর্ডের জন্য ব্যবসায়ীদের আগামি কয়েকদিনের মধ্যে চিঠি দেওয়া হবে।
এবিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজশাহী নগরীর নিউমার্কেট এলাকায় কয়েক ব্যবসায়ী জানান, ইংরেজিটা সহজ ও ফ্যাশন মনে হয় অনেকের কাছে। তাই ইংরেজি নাম বেশি চলে। অনেক দোকানে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাও আছে। নগরীর বেশিরভাগ শোরুম কিংবা ব্যাংকবুথের নাম ইংরেজিতে লেখা। এছাড়া কিছু কিছু ব্যাংকে বাংলা ও ইংরেজিতে নাম লেখা চোখে পড়েছে। তবে শো-রুমগুলোর সাইনবোর্ডে ইংরেজি নাম বড় করে লেখা হয়েছে। আর বাংলা লেখা ছোট। এছাড়া ইংরেজি ব্যবহারে এগিয়ে কোচিং সেন্টারগুলো। তাদের অবস্থা আরও করুণ। কোচিং সেন্টারগুলোর সাইনবোর্ডে বাংলার ব্যবহার নেই বললেই চলে।
অ্যাডভোকেট সৈয়দা শামসুন্নাহার মুক্তি বলেন, দেশের সর্বত্রই বাংলা ভাষা হওয়া উচিত। তার পরেও সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের বাংলা ভাষা বিশ্বস্বীকৃত একটা ভাষা। বাংলা ভাষায় কোর্টে রায় হচ্ছে। যারা আদেশ অমান্য করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।
রাজশাহী কলেজের মাস্টার্স শেষবর্ষের শিক্ষার্থী আবদুস সালাম বলেন, সব জায়গায় বাংলার চেয়ে বেশি ইংরেজি চলে। দেশের বেশির ভাগ পণ্যে ইংরেজিতে নাম লেখা। স্থানীয়ভাবে তৈরি পণ্যে শুধু বাংলায় নাম লেখা থাকে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের কোম্পানী ওয়ালটন। তার প্রতিটি পণ্যে ইংরেজিতে নাম লেখা। এছাড়া দেশের অনেক ব্যান্ড শোরুমগুলোর নাম ও পণ্যের নাম ইংরেজিতে লেখা। এখানে ইংরেজি ভাষাকে বড় করে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ইংরেজি লেখাটা বর্তমানে ফ্যাশন হয়ে গেছে। ব্যাবসায়ীদের ধারণা ইংরেজি লেখা নাম মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে। তাই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকরা মনে করেন, ইংরেজি নাম হলে তার দোকান মডার্ন মনে হবে ক্রেতাদের কাছে। আসলে এটি ভুল ধারণা তাদের। আইন প্রয়োগ করে এসব বন্ধ করতে হবে।
রাজশাহী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মহা. হবিবুর রহমান বলেন, এবিষয়ে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ দরকার। সম্প্রতি হাই কোর্টে বাংলায় রায় লেখা হচ্ছে। এটি অনেক ভালো একটি বিষয়। ভাষার প্রতি ভালোবাসা থেকে হয়েছে। আসলে এইটি হওয়া উচিত। তবে আমাদের দেশের বিভিন্ন সাইনবোর্ড ও ব্যানারে ইংরেজি নাম লেখা হচ্ছে।