‘ইলিশ মোকাম’ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে বদলে গেলো সাইনবোর্ড

আপডেট: অক্টোবর ১৩, ২০২৪, ১২:১৬ অপরাহ্ণ

সোনার দেশ ডেস্ক :


ক্ষমতার পালাবদলে ইলিশের মোকাম হিসেবে পরিচিত বরিশাল নগরের পোর্ট রোড মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের নামও বদলে গেলো। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) অর্থাৎ সরকারিভাবে যে নামটি কাগজে-কলমে ব্যবহার হচ্ছে সেটির সাইনবোর্ড আজ পর্যন্ত কেউ দেখেনি।

এমনকি অনেকে সরকারিভাবে দেওয়া নামটি জানেও না। এর আসল নাম ‘পদ্মাবতী-হাটখোলা লেবার হ্যান্ডলিং মাছঘাট’।
মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, যখন যারা ক্ষমতায় থাকেন তখন তাদের দলের নেতাকর্মীরা নগরের পোর্ট রোড মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেন। ক্ষমতার দাপটে আড়তদারদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় অতিরিক্ত খাজনা।

ইলিশের দামও নির্ধারণ করে দেন। তবে বর্তমানে অন্তর্র্বতী সরকার ক্ষমতায় থাকলেও বিএনপির নেতাকর্মীরা ইলিশ মোকামের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। বদলে দিয়েছেন মোকামের সাইনবোর্ড। একইসঙ্গে বাজারের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা থাকাকালে স্থানীয় নেতাকর্মীরা ক্ষমতার দাপট দেখাতে দুবার বরিশাল নগরের পোর্ট রোড মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের নামের সাইনবোর্ড পরিবর্তন করেছেন।

২০০৮ সালে তৎকালীন বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি শওকত হোসেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নামের সাইনবোর্ড পরিবর্তন করে এলাকার নাম অনুসারে রসুলপুর মার্কেট হিসেবে এই মৎস্য কেন্দ্রের নামের সাইনবোর্ড টানিয়ে দেন।

২০১৮ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ ওই নাম পরিবর্তন করে বরিশাল জেলা মৎস্য পাইকারি অবতরণ কেন্দ্র সংবলিত সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেন।

৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর সম্প্রতি শহীদ জিয়া মৎস্য পাইকারি অবতরণ কেন্দ্র সংবলিত সাইনবোর্ড টানিয়ে দেওয়া হয়। তবে এটি বছরের পর বছর ধরে ইলিশের মোকাম হিসেবে ব্যবসায়ীদের কাছে পরিচিত।

এই মোকামের একাধিক ব্যবসায়ী ও মাছ বিক্রেতা জানিয়েছেন, যখন যারাই ক্ষমতায় থেকেছেন তাদের নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে থাকে এই মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র। বাজার ঘিরে গড়ে তোলা হয় সিন্ডিকেট। বছর বছর বাড়ানো হয় খাজনা। বেঁধে দেওয়া হয় মাছের দামও।

এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের কিছুই করার থাকে না। ৫ আগস্টের পর আবারও মোকামের নাম পরিবর্তন হয়েছে। আগের সাইনবোর্ডের নিচে শহীদ জিয়ার নাম জুড়ে নতুন সাইনবোর্ড টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগে শহীদ জিয়ার নামেই সাইনবোর্ড ছিল। পরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা দুবার সেই সাইনবোর্ড পরিবর্তন করেছেন।

নতুন সাইনবোর্ড টানিয়ে দেওয়ার প্রধান উদ্যোক্তা এই মোকামের আড়তদার জহির সিকদার। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘১৯৯৫ সালে শহীদ জিয়ার নামে ২০ শতাংশ জমি কিনে শহীদ জিয়া মৎস্য পাইকারি অবতরণ কেন্দ্র হিসেবে নামকরণ করে মোকামের সাইনবোর্ড দেওয়া হয়েছিল।

পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরণ ওই নাম পরিবর্তন করেন। একইভাবে সাদিক আব্দুল্লাহ মেয়র হয়ে আবারও নাম পরিবর্তন করে নতুন সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেন। নাম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মোকামের ব্যবসায়ী কমিটিতেও পরিবর্তন আসে।

তখন তাদের কাছের লোকজনের নেতৃত্বে ছিল পোর্ট রোডের ব্যবসা। তারা যেভাবে বলতো সেভাবেই চলতো। এখন আর সেভাবে চলছে না।’
জহির সিকদার আরও বলেন, ‘মহানগর আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক নীরব হোসেন টুটুলের একক আধিপত্যের কারণে কোনও ব্যবসায়ী ইলিশ কিনতে পারতেন না।

কিনলেও শেষ পর্যন্ত তার কাছেই বিক্রি করতে বাধ্য করা হতো। এমনকি কত টাকা হবে ইলিশের মণ এবং কত কেজিতে মণ হবে, তা বেঁধে দিতেন টুটুল। যেখানে এক টন ইলিশের খাজনা ছিল ৩৪ টাকা ৫০ পয়সা। তা তিনি নিতেন আট হাজার টাকা। এভাবে মোকামের পদে পদে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করায় ব্যবসায়ীরা দিন শেষে ব্যবসা করতে পারতেন না।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের আগের নাম ফিরিয়ে আনা হয়েছে। সেইসঙ্গে ব্যবসায়ীদের জিম্মি অবস্থা থেকে মুক্ত করা হয়েছে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী খাজনা এবং ইলিশের দর আড়তদাররা মিলে নির্ধারণ করেছেন। কারও কাছ থেকে বাড়তি কোনও খাজনা আদায় করা হচ্ছে না।’

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও বরিশাল মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পোর্ট রোড হলো ব্যবসায়ীদের মোকাম। এ কারণে ব্যবসায়ীরা ওখানে শহীদ জিয়ার নামে ২০ শতাংশ জমি কিনে শহীদ জিয়া পাইকারি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র গড়েন।

এরপর সেখানে যেসব জায়গা নিচু ছিল, তা ভরাট করে ২০০ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হয়। ওই সময় থেকেই শহীদ জিয়া পাইকারি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র হিসেবে চলে আসছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সেই নাম পরিবর্তন করেছিল। এখন আবার আগের নামে ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন মোকামের ব্যবসায়ীরা।’

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের উপপরিচালক আব্দুর রাজ্জাক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ক্ষমতার পালাবদলে পোর্ট রোড পাইকারি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের নাম পরিবর্তন হয়। আগেও বেশ কয়েকবার নাম পরিবর্তন হয়েছিল। এখন আবার পরিবর্তন করে নতুন নাম দেওয়া হয়েছে।

তবে আগে এবং বর্তমানে যে সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে সেটি সরকারি কাগজে-কলমে নেই। কী নামে আছে, তা অনেকে জানেও না।’
তিনি আরও বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে কাগজ-কলমে চলে আসছে পদ্মাবতী-হাটখোলা লেবার হ্যান্ডলিং মাছঘাট নামে। কীর্তনখোলা নদীর সঙ্গে সংযোগ পোর্ট রোড খাল দিয়ে ওই হাটে বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন স্থান থেকে ট্রলার ভর্তি করে মাছ আসতো।

সেই মাছ ট্রলার থেকে তুলে পাইকারিতে হাটে বিক্রি হতো। সেখান থেকে মাছ চলে যেতো বিভাগের বিভিন্ন বাজার থেকে শুরু করে দেশের নানা স্থানে। সেটিকে কেন্দ্র করেই নামকরণ হয়েছে। তবে পরবর্তীতে এটি ইলিশের মোকাম হিসেবে অত্যাধিক পরিচিতি পায়। বছর বছর এটি লিজ দেওয়া হয়। লিজ দেওয়ার সময় সরকারিভাবে যে নাম আছে, সেই নামই ব্যবহার হয়ে আসছে।’
তথ্যসূত্র: বাংলাট্রিবিউন

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ