ইসি গঠনে ৬ সদস্যের সার্চ কমিটি

আপডেট: জানুয়ারি ২৬, ২০১৭, ১২:০৭ পূর্বাহ্ণ

সোনার দেশ ডেস্ক



নতুন সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার বাছাইয়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা চারজনের সঙ্গে দুই অধ্যাপকের সহায়তা নিচ্ছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির কাছে নাম প্রস্তাবকারী এই সার্চ কমিটির প্রধান করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে। বর্তমান ইসি গঠনে গতবারও একই দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।
গতবারের মতো এবারও সার্চ কমিটিতে হাই কোর্ট বিভাগের একজন বিচারক থাকছেন। এবার এই দায়িত্ব পেলেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
গতবারের মতোই সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান ও কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) পদধারী ব্যক্তিরা থাকছেন এই কমিটিতে। তারা হলেন পিএসসির এবারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক এবং সিএজি মাসুদ আহমেদ।
এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য শিরীণ আখতারকে সার্চ কমিটিতে নেয়া হয়েছে।
আপিল বিভাগের বিচারপতি মাহমুদ হোসেনের সঙ্গে গতবার সার্চ কমিটিতে ছিলেন হাই কোর্টের বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান, পিএসপির তৎকালীন চেয়ারম্যান এ টি আহমেদুল হক চৌধুরী ও তৎকালীন সিএজি আতাউল হাকিম।
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান চারজনের সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন; এবার সদস্য সংখ্যা দুজন বাড়িয়ে দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে এতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন আবদুল হামিদ।
প্রয়াত জিল্লুর রহমানের মতোই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মাসব্যাপী সংলাপের পর বুধবার সার্চ কমিটি গঠন করেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। সকালে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে ছয় সদস্েযর সার্চ কমিটি গঠনের বিষয়ে চিঠি পাওয়ার পর সার-সংক্ষেপ তৈরি করে তা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।  সেখান থেকে ফাইল ফেরত আসার পর সন্ধ্যায় ছয় সদস্যের সার্চ বা অনুসন্ধান কমিটির প্রজ্ঞাপন জারি হয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে। নবগঠিত সার্চ কমিটির সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবে এই দপ্তর।
প্রজ্ঞাপন জারির পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবদুল ওয়াদুদ সাংবাদিকদের বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপের পরিপ্রেক্ষিতে ইসি গঠনের লক্ষ্যে এই সার্চ কমিটি গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এ্ই সার্চ কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্েয রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ দিতে বলা হয়েছে।”
সার্চ কমিটি গঠনের আগেই এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিএনপি। গঠিতব্য সার্চ কমিটির সদস্যদের নাম গণমাধ্যমে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এরা সবাই তো সরকারের ‘পছন্দের লোক’।
“আমরা শুধু হতাশ হইনি, আমরা ক্ষুব্ধ হয়েছি। আমরা জানি না, এই সার্চ কমিটি কী ধরনের নির্বাচন কমিশন গঠন করবে,” বিকালে এক অনুষ্ঠানে বলেন তিনি।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের কোনো প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলে আসছেন, সার্চ কমিটি কিংবা ইসি গঠন রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার, তার সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন তারা।
সার্চ কমিটিতে যারা
এবার সার্চ কমিটি যে ছয় সদস্েযর হচ্ছে, রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবে সকালেই তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নিশ্চিত করেন। তবে প্রজ্ঞাপন না হওয়া পর্যন্ত নাম প্রকাশে রাজি হননি তিনি।
সকালে বঙ্গভবনের চিঠি পাওয়ার পর দুপুরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে দেখা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম। পরে তারা দুজনে সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পাওয়ার পর তারা সার্চ কমিটির বিষয়ে আদেশ জারি করবেন। তিনিও তখন পর্যন্ত কারও নাম প্রকাশে রাজি হননি।
আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা না হলেও বঙ্গভবনের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, পিএসসি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক, সিএজি মাসুদ আহমেদ, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও শিরীণ আখতার সার্চ কমিটিতে থাকছেন।
দুপুরে যোগাযোগ করা হলে অধ্যাপক শিরীণ আখতার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি দুপুরে জানতে পেরেছি। এটা পবিত্র দায়িত্ব। দায়িত্ব পেলে তা সুষ্ঠুভাবে সুন্দরভাবে নিরপেক্ষভাবে সকলের সহযোগিতায় সম্পন্ন করতে চাই।”
অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি। তবে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের এই সদস্যের সঙ্গে সরকারের তরফ থেকে যোগাযোগ করার বিষয়টি তার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নিশ্চিত করে। সন্ধ্যায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সবার নাম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ হয়।
সৈয়দ মাহমুদ হোসেন: ছয় বছর ধরে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতে বিচারকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। ১৯৮১ সালে জেলা আদালতের আইনজীবী হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। হাই কোর্টে আসেন তার দুই বছর পর। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব পালন করে ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাই কোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। এর দুই বছর পর হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতি হওয়া মাহমুদ হোসেন আপিল বিভাগে উন্নীত হন ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি।
ওবায়দুল হাসান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এবং আইন বিভাগ থেকে এলএলবি ডিগ্রি নিয়ে ওবায়দুল হাসান জেলা আদালতে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন ১৯৮৬ সালের মার্চে। তার দুই বছর পর হাই কোর্ট বিভাগে এবং ২০০৫ সালে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসাবে তালিকাভুক্ত হন তিনি। ২০০৯ সালের জুনে হাই কোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসাবে নিয়োগ পান। ২০১১ সালের জুনে স্থায়ী হন সেখানে। ২০১২ সাল থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকের দায়িত্বে আছেন তিনি।
মোহাম্মদ সাদিক:  ১৯৮২ সালের নিয়মিত বিসিএস ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ সাদিক নির্বাচন কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) থাকার সময় ২০১৪ সালের ২৭ অক্টোবর পিএসসি সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। গত বছরের ২৫ এপ্রিল পিএসসির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। ১৯৫৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জে জন্ম নেয়া সাদিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি নিয়ে যুক্তরাজ্যে উচ্চ শিক্ষা নেন। পরে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সিলেটিনাগরী লিপির উপর গবেষণার জন্যে ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। আমলাদের মধ্যে কবি হিসেবে পরিচিত সাদিক বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনে সক্রিয় রয়েছে। তিনি বাংলা একাডেমি ও এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ-এর জীবন-সদস্য। জাতীয় কবিতা পরিষদ ও বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি।
মাসুদ আহমেদ: ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পান মাসুদ আহমেদ। ’৮১ ব্যাচের এ কর্মকর্তা হিসাব ও নিরীক্ষা ক্যাডারে সরকারি চাকরি শুরু করেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ও পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। সরকারি কর্মকর্তা মাসুদ আহমেদও লেখালেখি করেন। তার প্রকাশিত গল্পের সংখ্যা ১০০টি, এছাড়া সাতটি উপন্যাসও লিখেছেন তিনি। তার লেখা নিয়ে তৈরি আটটি টেলিফিল্ম বিভিন্ন টেলিভিশনে সম্প্রচার হয়েছে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম অধ্যাপনার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ সমানভাবে লিখে যাচ্ছেন। বাংলা একাডেমি, কাগজ সাহিত্য পুরস্কারসহ নানা সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য তিনি।
শিরীণ আখতার: বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শিরীণ আখতার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম নারী উপ-উপাচার্য হিসেবে গত বছরের ২৮ মার্চ কাজ শুরু করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির অষ্টম উপ-উপাচার্য। ১৯৮৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া শিরীণ আখতার ১৯৯৬ সালের ১ জানুয়ারি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিইএচডি ডিগ্রি নেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার আগে চট্টগ্রামের এনায়েত বাজার মহিলা কলেজে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছিলেন তিনি।
সার্চ কমিটির কাজ যেভাবে
সার্চ কমিটি রাষ্ট্রপতির কাজ সহজ করতে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য কয়েকটি নাম প্রস্তাব করবে। তার মধ্য থেকে অনধিক পাঁচজনকে নির্বাচন পরিচালনাকারী সাংবিধানিক সংস্থার দায়িত্বভার অর্পণ করবেন রাষ্ট্রপ্রধান। এর মধ্যে একজন হবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার, বাকিরা নির্বাচন কমিশনার।
গতবার অর্থাৎ ২০১২ সালেও ১০ কার্যদিবসের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ জমা দিতে সার্চ কমিটিকে বলা হয়েছিল। তারা সিইসি পদের জন্য দুজন কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ ও আলী ইমাম মজুমদারের নাম প্রস্তাব করে।
তার মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান সাবেক সচিব কাজী রকিবকে সিইসি করেছিলেন।
নির্বাচন কমিশনারের চারটি পদে আটজনের নাম সুপারিশ করেছিল গতবারের সার্চ কমিটি; তার মধ্য থেকে চারজনকে কমিশনার পদে নিয়োগ পান।
গতবার সার্চ কমিটি গঠনের পরপরই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নেয়া প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার মনোনয়নের জন্য সর্বোচ্চ পাঁচটি নাম পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছিল।
সেই সঙ্গে সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সব মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্যসচিবের নামের তালিকাও মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে চেয়েছিল গতবারের সার্চ কমিটি।
একইভাবে সুপ্রিম কোর্টের নিবন্ধককে অবসরপ্রাপ্ত জেলা বিচারকদের নামের তালিকা কমিটিতে পাঠানোর জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল। এছাড়া সার্চ কমিটির সদস্যরা নিজ বিবেচনায় যোগ্য ব্যক্তিদের নাম সংগ্রহ করেন। সব নাম নিয়ে বৈঠকে বসে সার্চ কমিটি।
এবার তিন সদস্যের উপস্থিতিতে কমিটির কোরাম গঠিত হবে; সভায় উপস্থিত সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে প্রস্তাব চূড়ান্ত করবে তারা। সিদ্ধান্তের সমতার ক্ষেত্রে সভায় সভাপতিত্বকারী সদস্যের নির্ণায়ক সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা থাকবে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।
নিজেদের প্রস্তাব চূড়ান্ত করে রাষ্ট্রপতির কাছে তা পাঠায় সার্চ কমিটি। রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ দেয়ার মধ্য দিয়ে বিলুপ্তি ঘটে এই কমিটির।
কাজী রকিব নেতৃত্বাধীন আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগেই বিদায় নিচ্ছেন। তারপরই দায়িত্ব নেবে নতুন ইসি, যার জন্য গঠিত হয়েছে সার্চ কমিটি।- বিডিনিউজ