মঙ্গলবার, ২১ মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ৭ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
মো. আব্দুল কুদ্দুস
সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গরত্ন শেখ হাসিনা ২০৪১ সাল নাগাদ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের রূপকল্প ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর মতে স্মার্ট বাংলাদেশের চারটি ভিত্তি হবে যেমন- তথ্য-প্রযুক্তির জ্ঞান নির্ভর স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট গভার্নমেন্ট, স্মার্ট ইকোনমি এবং স্মার্ট সোসাইটি। এছাড়াও ২০৩০ সাল নাগাদ এসডিজির লক্ষ্য অর্জন এবং ২১০০ সাল নাগাদ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা অর্জনের চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে তো আছেই। বিশেষজ্ঞদের মতে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও উল্লিখিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজন দক্ষ মানসম্পদ। দরকার শিখনফল ভিত্তিক শিক্ষা বা নিড বেইজড এডুকেশন। অন্যদিকে, এই দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির বড় দায়িত্ব হলো দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়েসমূহের। বিশ্ববিদ্যালয় হলো সভ্যতার শেষ দূর্গবিশেষ। এক কথায় বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা যেতে পারে জ্ঞানের অতিথিশালা। এখানে জ্ঞানের চর্চা, গবেষণা, নতুন জ্ঞান অনুসন্ধান ও জ্ঞান সৃষ্টি হয়ে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৫৩টি সরকারি ও ১০৭টি বে-সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানের অতিথিশালা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়াও দেশে ৪৬,৯০,৮৭৬ জন উচ্চশিক্ষা গ্রহণেচ্ছু শিক্ষার্থীদের জন্য ২,২৬৮টি কলেজ এবং ১,৩৪৬টি মাদ্রাসা আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রধান উপাদান দক্ষ মানবসম্পাদ তৈরিতে দেশের সরকারের উদ্যোগ কতটুকু? উচ্চশিক্ষা প্রদানে আমাদের বিশ্বদ্যিালয়সমূহ কতটুকু সক্ষম? দক্ষ মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকগণ কতুটুকু প্রস্তুত?
এখন একে একে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজ করা যাক। উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে এবং সরকারি-বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ্যতাভিত্তিক পঠন-পাঠনের মধ্যে সমরূপতা আনয়নের লক্ষ্যে ২০২১ সালে বাংলাদেশ সরকার ন্যাশনাল কোয়ালিফিকেশনস ফ্রেমওয়ার্ক (বিএনকিউএফ) প্রণয়ন করেছে। বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশেন কাউন্সিল আইন ২০১৭ প্রণয়ন করেছে। এই আইনের ধারা ১৫ মোতাবেক উল্লিখিত ফ্রেমওয়ার্কটি এখন বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল (বিএসি)। বিএনকিউএফ-এ বর্ণিত বিধি মোতাবেক এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনা অনুযায়ী ইতোমধ্যে দেশের সকল বে-সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে আউটকাম বেইজড এডুকেশন (ওবিই) কারিকুলাম প্রস্তুত করা হয়েছে। কিছুসংখ্যক সরকারি এবং স্বায়িত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় পূর্বেই কারিকুলাম প্রণয়ন করে ফেলেছে। তবে বেশিভাগ বিশ্ববিদ্যালয় ওবিই কারিকুলাম প্রস্তুত করতে পারে নি। তবে আশাব্যঞ্জক খবর এই হতে পারে যে, কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্রেমওয়ার্কটি এখন বাস্তবায়নাধীন। বিএসি ইতোমধ্যে অ্যাক্রেডিটেশন স্ট্যান্ডার্ডস ও বিধি অনুযায়ী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং এর প্রোগ্রামসমূহের অ্যাক্রেডিটেশনের কাজ এগিয়ে নিতে সচেষ্ট রয়েছে। সুতরাং বলা যেতে পারে উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নের সরকারি পর্যায়ে পর্যাপ্ত না হলেও যথেষ্ট উদ্যোগ হাতে নেওয়া হয়েছে।
এখন দেখা যাক, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে কতটুকু সক্ষম। শিক্ষা মনোবিজ্ঞানীগণ মনে করেন, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির অন্যতম হাতিয়ার হলো আউটকাম বেইজড এডুকেশন বা শিখলফল ভিত্তিক শিক্ষা। এই পদ্ধতির একটি চমৎকার দর্শন আছে। সেই দর্শন হলো ‘সকল শিক্ষার্থীই শিখবে’। উল্লিখিত পদ্ধতির দুটি উদ্দেশ্য আছে যার একটি সকল শিক্ষার্থীকে জ্ঞান, দক্ষতা এবং মানবিক আচরণে পরিপূর্ণ করা এবং অন্যটি হলো প্রথম উদ্দেশ্য পূরণে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এবং এর কর্মকর্তাদের সক্ষম করে গড়ে তোলা। তিনটি প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিখনফল ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করবে। প্রেক্ষাপটগুলো হলো-সকল শিক্ষার্থী শিখে এবং সফল হয়, কিন্তু একই সময়ে এবং একই পদ্ধতিতে নয়, সফলভাবে অর্জিত শিখনফল শিক্ষার্থীদের জীবনে সফলতা বয়ে আনে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ এই সফলতা অর্জনে শতভাগ নিশ্চয়তা প্রদান করে। প্রকৃতপক্ষে শিখনফল ভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতির ব্যাপকতা আছে এর মূলনীতি এবং বাস্তব অনুশীলনেরর মধ্যে। এই পদ্ধতির মূলনীতিগুলো হলো, শিখনফল হবে নিড বেইজড, শিখনফল অর্জনে পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, সফলতা অর্জনে থাকবে উচ্চাকাঙ্খা এবং থাকবে শিখনফলের একটি চূড়ান্ত বিন্দু। বাস্তব অনুশীলনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ পর্যাপ্ত সময়, পদ্ধতিগত সুবিধা, প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য স্বচ্ছ ভিশন ও মিশন প্রতিষ্ঠা, দক্ষতা ও যোগ্যতার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেঞ্চমার্ক অনুশীলন এবং কারিকুলাম প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকা। উপর্যুক্ত লক্ষ্য অর্জনে, বিএনকিউএফ-এ প্রকৌশল শিক্ষার জন্য ওয়াশিংটন অ্যাকর্ড-১৯৮৯ এবং ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ)-২০১৫ এর আদলে শিক্ষার্থীদের জন্য দশটি বা বারোটি যোগত্যা যেমন- ডিসিপ্লিন সুনির্দ্দিষ্ট জ্ঞান, সমস্যা বিশ্লেষণ, সমস্যা সমাধান, অনুসন্ধানী জ্ঞান, ব্যক্তিগত ও দলীয় কাজ, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, প্রকৌশল ও সমাজ, পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন, যোগাযোগ দক্ষতা, নীতিবিদ্যা, প্রকল্প ব্যবস্থাপনা এবং জীবনব্যাপি শিক্ষা ইত্যাদি নির্ধারণ করা হয়েছে। সবকিছইু কাগজে-কলমে লেখা থাকলেও আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ অংশিজনদের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ মানবসম্পদ সরবরাহ করতে পারছে না বলে অভিযোগ বিস্তর!
উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রস্তুতি থাকলেও এই পবিত্র এবং বিশাল কর্মযজ্ঞটি আসলে সম্পন্ন করবেন সম্মানিত শিক্ষকগণ। আমি বিশ্বাস করি, দেশের বহু শিক্ষক তাঁদের নিজস্ব অর্থায়নের গবেষণাগার তৈরি করে ‘সোনার মানুষ’ বিনির্মাণে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো- আমাদের দেশের আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় অহংবোধ দক্ষ মানবসম্পদব গঠনে সরকারি সদিচ্ছাকে পরাহত করে থাকে। যেমন, আমাদের দেশের বড় বড় কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্দান্ত মেধাবী প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও কেউ কখনো অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের নিয়োগের ব্যাপারে ছাড় দেয় না। উদাহরণস্বরূপ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী কখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার কল্পনাও করতে পারেন না। অন্যদিকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গ্র্যাজুয়েট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন তাও কল্পনা করতে পারেন না। অথচ উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষার্থী দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আমিত্বের কারণে নিয়োগ বোর্ডে প্রত্যাখ্যাত হলেও বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় যেমন- অক্্রফোর্ড, কেমব্রিজ, এমআইটি, বোস্টন ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনামের সাথে শিক্ষকতা করে যাচ্ছেন। আমাদের দুঃখের বিষয় হলো- উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বহু শিক্ষক এখনো বিএনকিউএফ-এর নামও শোনেন নি! জানেন না নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়েল ভিশন ও মিশন। উচ্চশিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতকরণে যে ১০টি মান নির্ধারণ করা হয়েছে তা অনেকে কোনদিনও পড়ে দেখেন নি! এসডিজি অর্জন এবং স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ইউজিসি যে ‘স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং ফর হাইয়ার এডুকেশন ২০১৮-২০৩০’ শীর্ষক একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে তা দেশের অধিকাংশ শিক্ষক পড়ে দেখেন নি! কলেজ-মাদ্রাসার বহু শিক্ষক ওই দলিলগুলোর নামই শোনেন নি! যে দেশের শিক্ষক সরকারের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিকল্পনার সাথে সঙ্গতি রেখে প্রণীত শিক্ষা দলিল পাঠই করেন নি তাঁরা কিভাবে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন?
তবে আমি মনে করি আমাদের সময়ে এসেছে এখন ঘুরে দাঁড়াবার। দরকার শিক্ষকদের শিক্ষা, গবেষণা এবং চাকরির কর্মদক্ষতা মূল্যায়নের। সুখি, সমৃদ্ধ, উন্নত, ও তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যেই আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার মূল প্লেয়ার উপাচার্য ও সহ-উপাচার্য নিয়োগের পূর্বে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিকট থেকে একটি ‘একাডেমিক উন্নয়ন রূপকল্প/কর্মপরিকল্পনা’ আহবান করে সেমিনারে উপস্থাপন পূর্বক বিশেষজ্ঞ সদস্যদের দ্বারা মূল্যায়ন করে শ্রেষ্ঠ পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে থেকে একজন উপাচার্য ও সহ-উপাচার্য নিয়োগ প্রদান করতে হবে। সকল শিক্ষকের নিয়োগ ও পদন্নোতির জন্য উপর্যুক্ত শিক্ষা দলিলগুলোর উপর ভালোভাবে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে জ্ঞান অর্জন করতে বাধ্য করতে হবে। কেননা, সরকারের নীতি ও পরিকল্পনার সাথে অসামঞ্জ্যপূর্ণ শিক্ষা কখনো গ্র্যাজুয়েটদের জন্য ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারে না। পারবে না দেশকে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে দিতে। ইতোমধ্যে অ্যাক্রেডিটেশন বিধি তৈরি করা হয়েছে। সুতরাং দেশের কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেন যথাযথ কর্তৃপক্ষের অ্যাক্রিডিটেশন ব্যাতিত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারেন খুব অল্প সময়ের মধ্যে তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় আমাদের স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন অধরা থেকে যাবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক বিজনেস স্টাডিজ বিভাগ ও অতিরিক্ত পরিচালক, ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেল (আইকিউএসি), নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী।