বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৩ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
ওয়ালিউর রহমান বাবু
ঊনসত্তুরের গণতান্ত্রিক আন্দোলন আসাদ, মতিউরসহ নাম না জানা অনেকের আত্মদানে তীব্র হতে থাকলো। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আগরতলা মামলায় জড়িয়ে বন্দি অবস্থায় সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করা হলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলো। এই হত্যার প্রতিবাদে কিংবদন্তী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে উনসত্তুরের ১৭ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হলো। তৎকালিন ছাত্রনেতা মুক্তিযোদ্ধা সাইদুর রহমানের দেয়া তথ্যে জানা যায়, ওইদিন বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত ছাত্রদের সাথে রাজশাহী শহরের আন্দোলনরত ছাত্ররা সরকার সমর্থিত আয়েন উদ্দিনের বাড়িতে চড়াও হয়। মিছিলকারীরা সরকার সমর্থিত রাজশাহী কলেজের প্রিন্সিপাল অধ্যক্ষ আব্দুল হাই এর বাড়ির দিকে যাবার চেষ্টা করলে পুলিশের লাঠিচার্জ আর কাঁদুনে গ্যাসে ষোলজন ছাত্র আহত হলো। এ খবর পেয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে মধ্যশহরে এসে প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা বাংলা বিভাগের প্রধান মাযহারুল ইসলাম আহতদের সেবা দিতে থাকলেন। প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা আহত ছাত্রদের বললেন, ‘ভয় নেই, আমরা তোমাদের পাশে আছি’। সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের ভাষা দিবসের আলোচনা সভা প্রতিবাদ সভায় রূপ নেয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. আব্দুল খালেকের দেয়া তথ্যে জানা যায়, ড. মাযহারুল ইসলামের সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সভায় প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করলেন, ‘মরতে যদি হয় সকলে একসাথে মরবো।’ অধ্যাপক হবিবুর রহমান, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, ড. কাজী আব্দুল মান্নান, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখ বক্তব্য রাখলেন। পরের দিন ১৮ ফেব্রুয়ারি কর্মসূচি ঠেকাতে ১৪৪ ধারা দিয়ে পুলিশের সাথে ইপিআর সেনাবাহিনী নামানো হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ক্যাম্পাস ছেড়ে মধ্যশহরে আসার সিদ্ধান্ত নিলো। সেনাবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অস্ত্র তাক করলো। মধ্যশহরে আন্দোলন তুঙ্গে। আন্দোলনরত ছাত্রদের ঐক্য ভেঙ্গে দিলো ১৪৪ ধারা। মধ্যশহরের একটি মিছিলে নেতৃত্ব দিতে থাকলেন ছাত্রনেতা রাজশাহী সিটি কলেজের ছাত্র নুরুল ইসলাম। লাল প্লেবয় শার্ট পড়া নুরুল ইসলাম পুলিশ ইপিআর সেনাবাহিনীর নজরে পড়ে গেলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. আব্দুল খালেকের দেয়া তথ্যে জানা যায়, সেনাবাহিনী দেখে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররা উত্তেজিত হয়ে উঠলো। ড. শামসুজ্জোহা, ড. মাযহারুল ইসলাম, ড. এমআর সরকার, ড. কাজী আব্দুল মান্নান, ড. কছিম উদ্দিন মোল্লা, অধ্যাপক হবিবুর রহমান (শহিদ) অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ছাত্রদের ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করার সময় সেনাবাহিনীর এক অফিসার গুলি করার নির্দেশ দিলেন। ড. শামসুজ্জোহা পরিচয় দিয়ে বললেন “না” ছাত্ররা ক্যাম্পাসে ফিরে যাবে। কিন্তু অফিসারটি তা না শুনে সৈনিকদের প্রস্তুত হতে বললেন। ম্যাজিস্ট্রেট মো. নাসিমকে ঘটনাটি জানালে তিনি সৈনিকদের সেখান থেকে সরিয়ে বেতার কেন্দ্রের রিলে সেন্টারের কাছে যেতে বললেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল আলী আশরাফের দেয়া তথ্যে জানা যায়, ছাত্ররা যখন ক্যাম্পাসে ফিরছে তখন ছাত্রদের একটি অংশ উত্তেজিত হয়ে লেফটেন্যান্ট খাদেমের অস্ত্র কেড়ে নেবার চেষ্টা করলে ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেলো। সেনাবাহিনীর গুলিতে ড. আব্দুল খালেক, ড. কাজী আব্দুল মান্নান, ড. কছিম উদ্দিন মোল্লা আহত হয়ে পাশে থাকা খড়ের গাদার মধ্যে পড়ে গেলেন। লেফটেন্যান্ট খাদেম এক বাঙালি সৈনিকের কাছ থেকে মর্কফোর রাইফেল দিয়ে ড. শামসুজ্জোহকে গুলি করলে গুলিটি ড. শামসুজ্জোহার শরীরের ঢুকে পেচিয়ে বেয়েনট চার্জের মত ক্ষত বিক্ষত করে দিলো। আহত ড. কছিম উদ্দিন মোল্লা, ড. কাজী আব্দুল মান্নান ও অধ্যাপক আব্দুল খালেক কে বন্দি করে সেনাবাহিনীর গাড়িতে পৌরসভা ভবনে আনার সময় উত্তেজিত ছাত্র জনতা গাড়িটির উপর চড়াও হতে থাকলো। তৎকালিন ছাত্রনেতা মুক্তিযোদ্ধা সাইদুর রহমানের দেয়া তথ্যে জানা যায়, ড. শামসুজ্জোহাকে হাসপাতালে আনা হচ্ছে খবর শুনে ছাত্রনেতা নুরুল ইসলাম সোনাদিঘির মোড়ে ব্যারিকেড সরিয়ে দেবার সময় সেনাবাহিনীর গুলিতে শহিদ হলেন। বুট জুতো দিয়ে তার শরীরকে ক্ষত-বিক্ষত করে রাস্তায় ছেচড়িয়ে পৌরসভা ভবনে ফেলে রাখা হলো। সেদিনের আন্দোলনে থাকা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজের দেয়া তথ্যে জানা যায়, বাড়ির নিষেধ উপেক্ষা করে রাজশাহী হাই মাদ্রাসা (বর্তমান হাজী মুহাম্মদ মহসিন স্কুল এন্ড কলেজ)-র সপ্তম শ্রেণির ছাত্র তার ছোট ভাই আব্দুস সাত্তার সহপাটি মোসলেমকে সঙ্গে নিয়ে তাকে খুঁজতে এসে মিছিলে যোগ দেয়। রাজশাহী কলেজের মহিলা হোস্টেলের পাশে গুলিবিদ্ধ হলে সোনবাহিনী তাঁকে নির্যাতন করে রাস্তায় ছেচঁড়ে পৌরসভা ভবনে রাখলে এক গাড়িচালক তাকে চিনতে পেরে কৌশলে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। আহত সহপাঠি মোসলেম কোন রকমে নিজেকে রক্ষা করলো। স্কুলছাত্র আবুলসহ অনেকে আহত হলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. আব্দুল খালেকের দেয়া তথ্যে জানা যায়, সেনাবাহিনীর গাড়িটি তাদের নিয়ে পৌরসভা ভবনে ঢুকতেই ড. কছিম উদ্দিন মোল্লা জ্ঞান হারালেন। তিনি তাঁকে স্ট্রেচারে করে পৌরসভা ভবনের বাইরে এনে সুস্থ করার চেষ্টা করলেন। তিনি সুইপারদের দিয়ে পাশের সোনাদিঘি থেকে পানি আনিয়ে রুমাল ভিজিয়ে ড. কছিম উদ্দিন মোল্লার চোখে মুখে পানি দিতে থাকলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি আবারো জ্ঞান হারালেন। অবস্থা খারাপ হতে থাকলে হাসাপাতালে তাকে পাঠানো হলো। খোলা একটি পিকআপে সেনাবাহিনীর কড়া পাহারায় ড. শামসুজ্জোহাকে রক্তাক্ত অবস্থায় পৌরসভা ভবনে এনে বারান্দায় একটি টেবিলের উপর ফেলে রাখা হলো। দুপুর বারোটার দিকে বন্দি শিক্ষকদের পৌরসভা ভবনের নিচতলা থেকে উপরে নিয়ে গিয়ে একটি ঘরে বন্দি রাখা হলো। তারা শুনতে পেলেন আহতদের আহাজারি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. আব্দুল খালেকের ধারণা সম্ভবত আহতদের মধ্যে থেকে আসা আহজারিটি ছিলো ড. শামসুজ্জোহার। অনেক রক্ত ক্ষরণের পর পৌরসভা ভবন থেকে সংকটজনক অবস্থায় ড. শামসুজ্জোহাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হলো। (সেখানে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে দেশের প্রথম বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহা জীবন দান করলেন) । বন্দি অবস্থায় ড. আব্দুল খালেক ও ড. কাজী আব্দুল মান্নান অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকলেন। দুপুর তিনটার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে আসা ছাত্ররা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে তাদের হাসপাতালে পাঠাতে বললে সেনাবাহিনী গুরুত্ব দিলো না। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে আসা ছাত্রদের কাছে তারা শুনতে পেলেন ড. শামসুজ্জোহা মারা গেছেন। রাজশাহীতে কারফিউ দেয়া হলো। সেনাবাহিনী ড. আব্দুল খালেক ও ড. কাজী আব্দুল মান্নানকে মুক্তি দিয়ে রেডক্রসের গাড়িতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পাঠিয়ে দিলো। শহিদ নুরুল ইসলামের পরিবার থেকে জানা যায়, কারফিউয়ের মধ্যে সেনাবাহিনী শহিদ নুুরুল ইসলামের বাবাকে ডেকে লাশ নিতে শর্ত দিলো। সন্তানের লাশ নিতে তিনি শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আব্দুল খালেকের দেয়া তথ্যে জানা যায়, ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যু ও শিক্ষক গ্রেফতার নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর শামসুল হকের সাথে পূর্ব পকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের চরম বাকবিত-া হয়। মোনায়েম খানের ক্ষমতা নড়বড়ে হয়ে উঠলো। উপাচার্য প্রফেসর শামসুল হক ওই দিন সন্ধ্যায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসাপাতাল থেকে শহিদ ড. শামসুজ্জোহার লাশ গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিয়ে গেলেন। পরেরদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি দুপুরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন হকি গ্রাউন্ড বর্তমান সাবাস বাংলাদেশ চত্বরে জানাজা শেষে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভবনের সামনের বাগানে দাফন করা হয়।
রাজশাহীর ঘটনায় সারাদেশে সৃষ্টি হলো তিব্র প্রতিবাদের ঝড়। কেঁপে উঠলো রাজপথ। শহিদ ড. শামসুজ্জোহা, আসাদ, মতিউর, নুরুল ইসলাম-সাত্তার, মোসলেম, আবুল এ রকম অনেকের অবদানে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে গেলো। পাকিস্তানের লৌহমানব প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ক্ষমতায় আর থাকতে পারলেন না। ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলার মামলা থেকে বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পেলেন। পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হলো। ড. শামসুজ্জোহাকে হত্যা করার অপরাধে লেফটেন্যান্ট খাদেম শাহ কে শাস্তি পেতে হলো। ছয় মাস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ আগস্ট আহত স্কুল ছাত্র আব্দুস সাত্তার মারা গেলো। বাঙালিদের অধিকারবঞ্চিত করতে আবারো ষড়যন্ত্র শুরু হলো। জানা অজানা মিলিত রক্তের ধারার পথ বেয়ে উনসত্তুর হয়ে গেলো একাত্তরের অগ্রদুত দিশারী ।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক , প্রডিউসার প্রেজেন্টার রেডিও পদ্মা