বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২ শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ ।
সোনার দেশ ডেস্ক :
উত্তর আফ্রিকায় অবস্থিত ছোট্ট একটি দেশ। দেশটির বেশির ভাগ অংশ জুড়ে সাহারা মরুভূমি। এর উত্তরে ভূমধ্যসাগর, পূর্বে মিশর, দক্ষিণ-পূর্বে সুদান, দক্ষিণে চাদ ও নাইজার এবং পশ্চিমে আলজিরিয়া ও তিউনিসিয়া।
৯০ শতাংশ মরুভূমি দিয়ে ঘেরা লিবিয়া এতটাই শুষ্ক যে, এর সীমানা দিয়ে কোনও স্থায়ী নদী প্রবাহিত হয় না। বছরভর পানীয় জলের উৎস এতটাই অমিল যে, সামান্য বৃষ্টির জল দিয়ে তা পরিপূর্ণ করা অসম্ভব। সেচের কাজও দূরস্থান। বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে গোটা দেশে সবুজের ছোঁয়া নেই বললেই চলে।
দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যা এবং কম বৃষ্টিপাতের কারণে জল সরবরাহের তীব্র সঙ্কটে ভুগছিল মরুদেশটি। বিশেষত পাহাড়ি অঞ্চলে পানীয় জল সরবরাহ করার ক্ষেত্রে প্রবল বাধার সম্মুখীন হতেন সে দেশের বাসিন্দারা।
লিবিয়ার বেশির ভাগ জল সরবরাহের উৎস ছিল উপকূলে অবস্থিত ব্যয়বহুল ডিস্যালিনেশন প্ল্যান্ট। যে সামান্য জমিতে চাষের কাজ হত, সেখানে সেচের জন্য খুব কম পরিমাণ জলই অবশিষ্ট থাকত। এই সেচের জল ছিল মরুভূমির দেশের কৃষিকাজের একমাত্র বিকল্প। উপকূলের কাছাকাছি বৃষ্টি-নির্ভর জলাধারের উপর ভরসা করেই চলত চাষবাষের কাজ।
সমস্যা আরও বাড়ে, যখন দেশের অন্যতম বড় শহর ত্রিপোলিতে দীর্ঘ দিন ধরে ব্যবহৃত উপকূলীয় জলাধারগুলি ক্রমে দূষিত হয়ে ওঠে এবং এর লবণাক্ত ভাব ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিল সে দেশের সরকার। সেই সময়ে হয় এক আশ্চর্য আবিষ্কার। ১৯৫৩ সালে তেলের অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে প্রচুর পরিমাণে ভূগর্ভস্থ পানীয় জল আবিষ্কার হয় দেশটিতে।
খনিজ তেলের সন্ধান না পাওয়া গেলেও জলের যে বিশাল ভান্ডার আবিষ্কৃত হয় তাতে পাল্টে যায় লিবিয়ার ইতিহাস। হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো অবস্থা হয় দেশবাসীর। মরুদেশের ভূগর্ভের নীচে যে পরিমাণ জলের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল, তা দিয়ে নাকি গোটা পৃথিবীর ৪০ বছরের জলের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব।
১৯৫০-এর দশকে তেল অনুসন্ধানের সময় লিবিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব মরুভূমির আল-কুফরাহ এলাকায় প্রথম ভূগর্ভস্থ জলের সন্ধান মেলে। পরবর্তী বিশ্লেষণে দেখা যায়, এটি ‘নুবিয়ান স্যান্ডস্টোন অ্যাকুইফার’ নামের জীবাশ্ম জলের একটি বিশাল আধারের অংশ।
এই জমা জলের সমুদ্র দিয়ে মরুভূমির দেশে জল সহজলভ্য করার জন্য বিশ্বের বৃহত্তম সেচ প্রকল্পের সূচনা করেন তৎকালীন শাসক ম্য়ুাম্মর গদ্দাফি। যুগান্তকারী এই প্রকল্প ‘গ্রেট ম্যানমেড রিভার প্রকল্প’ নামে পরিচিত। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে এর মাধ্যমে গোটা দেশের জলের ঘাটতির সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালায় গদ্দাফি সরকার।
তবে কাজটি মোটেই সহজ ছিল না। কারণ জলভান্ডারটি আবিষ্কৃত হয়েছিল লিবিয়ার দক্ষিণ অংশে। অথচ এই দেশের সিংহভাগ জনসংখ্যা ও শহর ছিল উত্তর লিবিয়ায়। রাজধানী ত্রিপোলি, বেনগাজ়ি, ডারনার মতো ঘনবসতি পূর্ণ এলাকায় জল সরবরাহ করায় বিস্তর বাধা ছিল।
উচ্চ তাপমাত্রার কারণে লিবিয়ায় জল দ্রুত শুকিয়ে যায়। তাই মাটির উপর দিয়ে খাল কেটে বা কৃত্রিম নদী তৈরি করে সেই জল পরিবহণ করা সম্ভব ছিল না। এ ক্ষেত্রে একটাই পন্থা, মাটির নীচে পাইপ দিয়ে দক্ষিণ থেকে উত্তরাংশে জল পরিবহণ।
হিসাব করে দেখা যায় দেশের প্রতিটি শহরে এই নদীর মিষ্টি পানীয় জল পৌঁছে দিতে ২৮২০ কিলোমিটার পাইপ বসাতে হবে। সেই মতো পরিকল্পনা শুরু করে গদ্দাফি সরকার। ১৯৮৩ সালে প্রকল্পটি পরিচালনার জন্য সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয় ‘গ্রেট ম্যান-মেড রিভার অথরিটি’।
১৯৮৪ সালের অগস্ট মাসে সূচনা হয় ‘গ্রেট ম্যানমেড রিভার’ প্রকল্পের। ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে লিবিয়ায় ব্যবহৃত সমস্ত মিঠে জলের চাহিদার ৭০ শতাংশ মেটানো হয়েছিল এই জল দিয়েই।
নদীর জল বয়ে আনার জন্য দৈত্যাকার পাইপের প্রয়োজন হয়। সেগুলির একেকটি চওড়ায় ১৩ ফুট ও ৮০ টন ওজনের ছিল। প্রকল্পটি শেষ করতে কংক্রিট ও ইস্পাত দিয়ে বানানো মোট ৫ লাখ পাইপ ব্যবহার করা হয়। তাজিরবু এবং সারিরেতে খনন করা হয় ১৩০০ কুয়ো। কুয়োগুলি ছিল ৫০০ মিটারের বেশি গভীর।
জীবাশ্ম জলকে প্রথমে দু’টি পাইপলাইনের মাধ্যমে আজদাবিয়ায় অবস্থিত একটি জলাধারে সঞ্চয় করা হয়েছিল। ১৯৮৯ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে সেখান থেকে জল দু’টি দিকে পাইপ দিয়ে সরবরাহ করা হয়েছিল, পশ্চিমে উপকূলীয় শহর সুর্টে এবং উত্তরে বেনগাজ়িতে। ১৯৯১ সালে বেনগাজ়িতে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রথম ধাপের কাজের সমাপ্তি উদ্যাপন করা হয়েছিল।
‘জিএমআর ২’ বা এই প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপে ১৯৯৬ সালে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিতে পানীয় জল সরবরাহ শুরু হয়। জাবাল আল-হাসাউইনাহ অঞ্চলের তিনটি কুয়ো থেকে জল সংগ্রহ করে পাইপলাইনের মাধ্যমে উত্তর এবং পূর্ব দিকের উপকূলে নিয়ে যাওয়া হয়। ত্রিপোলিতে শেষ হওয়ার আগে মিসুরাতা এবং আল-খুমসের মতো শহরগুলিতে জল সরবরাহ করা হয়।
গোটা প্রকল্পটি শেষ করতে ২৫০০ কোটি ডলার খরচ হয়েছিল। এই প্রকল্পের জল দিয়ে ৬০ লক্ষ মানুষের দৈনন্দিন পানীয় জলের চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়েছিল। প্রকল্পটি শেষ হওয়ার পর লিবিয়ার শাসক গদ্দাফি একে পৃথিবীর ‘অষ্টম আশ্চর্য’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। প্রকল্পের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের সফল রূপায়ণের পর আরও তিনটি ধাপের কাজ চলতে থাকে।
২০১১ সালে শাসক মুয়াম্মর গদ্দাফির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে দেশবাসী। পতন হয় সরকারের। নেপথ্যে ছিল নেটো বাহিনী। নেটোর বিমানবাহিনীর হামলায় প্রকল্পের জন্য পাইপ তৈরির দু’টি কারখানার মধ্যে একটি ধ্বংস হয়ে যায়।
২০১১ থেকে টানা গৃহযুদ্ধের ফলে জল প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিকাঠামোর অবনতি ঘটে। ১০ এপ্রিল ২০২০ তারিখে ত্রিপোলি এবং পার্শ্ববর্তী শহরগুলিতে জল সরবরাহ নিয়ন্ত্রণকারী একটি স্টেশন সশস্ত্র গোষ্ঠী দখল করে নেয়। ফলে ২০ লক্ষেরও বেশি মানুষের কাছে জল সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার অনলাইন