একজন অপরাজিতা ফেন্সি বানুর এগিয়ে চলার গল্প

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৪, ১:১০ অপরাহ্ণ


আব্দুর রউফ রিপন, নওগাঁ প্রতিনিধি: ‘মাতা ভগিনী, কণ্যে! আর ঘুমিও না, ওঠো’Ñ শত বছর আগের বেগম রোকেয়ার এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে নওগাঁর বদলগাছীর নারীরা ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। এই জাগরণে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ‘ফেন্সি বানু’ নামের এক অপরাজিতা নারী।
যিনি শত প্রতিকূলতার মধ্যেও কখনো থেমে থাকেননি। কূপমন্ডকতার অন্ধকার থেকে মুক্ত করে সমাজকে এগিয়ে নেয়ার কাজে নানা ভাবে অবদান রেখে চলেছেন এই আত্মপ্রত্যয়ী নারী।

বদলগাছীর কদমগাছী গ্রামের আলতাফ মন্ডল ও রহিমা বেগমের পরিবারে জন্ম নেন ফেন্সি বানু। নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন একজন সফল নারী হিসেবে। হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সমাজের পিছিয়ে পড়া অন্য নারীদের ভাগ্যের উন্নয়নের জন্য। নিজ প্রচেষ্টা ও কর্মদক্ষতার মাধ্যমে তিনি জেলায় একটি পরিচিত মুখ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।

ফেন্সি বানু বলেন, শিক্ষা জীবনের শুরুতে তার রাজনীতিতে পদচারণা। ১৯৯৭ সালে মথুরাপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে খড়ি। ক্রমান্বয়ে ১৯৯৮ সালে বদলগাছী মহিলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের আহবায়ক ও ২০০৩ সালে বদলগাছী উপজেলা ছাত্রলীগের ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক, ২০০৫ সালে বদলগাছী উপজেলা যুব মহিলা লীগের আহবায়ক, ২০০৬ সালে বদলগাছী উপজেলা যুব মহিলা লীগের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক, ২০১২ সালে বদলগাছী উপজেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১৩ সালে নওগাঁ জেলা যুব মহিলা লীগের যুগ্ম-আহবায়ক ২০১৫ সালে নওগাঁ জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়ে অদ্যবধি দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহসিকতা ও দক্ষতার জন্য তিনি এখন জেলায় একজন নির্ভরযোগ্য নারী নেত্রী হয়ে উঠেছেন। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সর্বোপরি রাজনৈতিক অধিকারহীনতার কারণে নারীর অবস্থান এখনো নাজুক। ফলে তারা সমাজ ও রাষ্ট্রে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠছে ও বেঁচে থাকছে। নারীর এই অবস্থা ও অবস্থান থেকে পরিবর্তন করতে তিনি নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে কাজ করে আসছেন।

তিনি ২০১৯ সালে অপরাজিতা প্রকল্পের সাথে যুক্ত হন। অপরাজিতা প্রকল্পের সংস্পর্শে এসে প্রশিক্ষণে পাওয়া জ্ঞান-দক্ষতাকে পুঁজি করে পিছিয়ে পড়া নারীদের ভাগ্যোন্নয়নের স্বপ্ন দেখেছেন। তিনি জেলার যুব মহিলালীগের সাধারন সম্পাদক হিসেবে প্রতিটি উপজেলা ও ইউনিয়নে যুব মহিলা লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে গিয়ে তিন হাজারের অধিক নারীকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করেছেন এবং ২০০ নারীকে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সহায়তায় ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে বাংলাদেশ আ’লীগের মূল কমিটিতে অর্ন্তভুক্ত করেছেন।

অপরাজিতা প্রকল্পের সাথে যুক্ত হওয়ার পরে রাজনৈতিক ক্ষেত্র ছাড়াও সামাজিক কর্মকাণ্ডে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। সমাজের সব স্তরের মানুষের জন্য সর্বদা কাজ করে চলেছেন তিনি। বিশেষ করে অসহায়, দুস্থ ও পিছিয়ে পড়া নারীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বদলগাছী উপজেলার ভাতসাইল গ্রামে একটি বেসরকারি কমিউনিটি ক্লিনিকে কমিউনিটি হেল্থকেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) পদে কর্মরত আছেন। সেখানে প্রতিদিন প্রায় ১০০-১৫০জন মানুষ সেবা নিয়ে থাকেন। গর্ভবতী দরিদ্র নারী, শিশুসহ সকল ধরনের মানুষ সেখানে স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে থাকেন। এছাড়াও কদমগাছী নারী জাগরন মহিলা সমিতির সভাপতি, বহুমুখি নারী উন্নয়ন যুব মহিলা সমিতির সভাপতি এবং মথুরাপুর বিটিএম উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।।

অপরাজিতা প্রকল্পের সাথে যুক্ত হওয়ার পরে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে, তার জ্ঞান-দক্ষতার প্রসার ঘটে আগের তুলনায় অনেক বেশি। জনগনের মাঝে সম্পৃক্ততা বাড়াতে বাল্য বিবাহ বন্ধ, নারী নির্যাতন প্রতিরোধসহ বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক সমাজ সেবামূলক কাজের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। তার যোগ্যতা ও দক্ষতার জন্য তিনি ইউনিয়ন উপজেলা নেটওয়ার্কের সভাপতি ও জেলা অপরাজিতা নেটওয়ার্কের সাংগাঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন।

রাজনৈতিক জীবনে অনেক পদচারণা থাকলেও নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তার পদচারণা একাবারে ছিল না বললেই চলে। রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং, প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের চাপ, পদ-পদবি হারানোর ভয় প্রভৃতি কারণে তিনি কখনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। কিন্তু অপরাজিতা প্রকল্পের সংস্পর্শে এসে প্রশিক্ষণে পাওয়া জ্ঞান-দক্ষতাকে পুঁজি করে তার আত্মবিশ^াসের জায়গা আরো দৃঢ় হওয়ায় তিনি প্রথমে ইউপি চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করার জন্য প্রচার-প্রচারণা করেন।

কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের চাপে সেখানেও থেমে গেলেও আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করার জন্য প্রচার-প্রচারণা ইতোমধ্যেই শুরু করেছেন। বিভিন্ন ইউনিয়ন ওয়ার্ড পর্যায়ে উঠান বৈঠক করছেন। রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে অ্যাডভোকেসি করে চলেছেন। তিনি একটি সমতার সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেন। তিনি নারী বান্ধব উপজেলা পরিষদ গঠন করতে চান যেখানে নারীরা সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা পাবেন। সরবার সার্বিক সহযোগিতা নিয়ে এভাবেই ফেন্সি বানু সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের এগিয়ে নিতে শেষ জীবন পর্যন্ত কাজ করে যেতে চান বলে ইচ্ছা পোষণ করেছেন।