একটু মূল্যায়নের আশায় রামচন্দ্র রাজোয়ার

আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৪, ৭:৪৯ অপরাহ্ণ

মমতাজ বেগম



দেশের আনাচে কানাচে কত প্রতিভা লুকিয়ে আছে শুধু সহযোগিতা আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বিকাশিত হতে পাওে না। প্রতিভাগুলো গুমরে গুমরে মরে। নিজেকে প্রকাশের সূযোগ পায় না অভাব আর দরিদ্রতার কারণে। প্রতিভার সামান্যতম বিচার পাওয়ার আশায় দিন গুনতে গুনতে জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছায়। অতৃপ্ত হৃদয় নিয়ে একদিন বিদায় নিতে হয় এ ধরা থেকে। এটাই হয়তো নিয়তি। এটাই আমাদের সমাজ। এমনই মূল্যায়ন পাওয়ার আশায় অপেক্ষমান প্রত্যন্ত এক গ্রামের ৭০ বছরের বৃদ্ধ রামচন্দ্র রাজোয়ার। রাজোয়ার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির একটি গোত্র। এরা সাঁওতালও নয়, রাজবংশীও ন্য়।

‘রাজোয়ার’ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। মুসলমান খোট্টা বা জোলাহদের ভাষায় কথা বলে; উর্দু হিন্দি আর বাংলার সংমিশ্রণে। অর্থাৎ রাজোয়ার ভাষা আর খোট্টা ভাষার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। রামচন্দ্রের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, তারা একসময় ভারতের বিহার রাজ্য এবং আধুনা ঝাড়খন্ড রাজ্যের দুমকা জেলার বাসিন্দা ছিল। ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পূর্বেই রামচন্দ্রের বাবা প্রথমে তৎকালিন রাজশাহী জেলার ভোলাহাট থানায় স্থানান্তরিত হয়ে আসেন। তারপরে একই জেলার গোমস্তাপুর থানাধীন নিঝুম গ্রাম পূনর চানপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। যা রহনপুর কলেজ মোড় থেকে ৪ কি.মি. দূরে। ভ্যান গাড়িতে অ্থবা অটোতে যেতে হয়। রামচন্দ্রের বাবার কিছু জমিজমা হয়তো ছিল কিন্তু রামচন্দ্র ভোগ করতে পারেন নি। তার বাবা বেঁচে থাকতেই সব বিক্রি করে দেন।

এই রামচন্দ্র রাজোয়ার ১৯৭২ সালে এসএসসি পাশ করেন। অর্থাভাবে লেখাপড়া তার এগোয়নি। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া না করতে পারলেও তার লেখাপড়া থেমে থাকেনি। গ্রামের ছেলে মেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজন অনুভব করে তিনি ১৯৮৫ সালে বাড়ির পাশেই একটি স্কুল খুলেন। গ্রামবাসির সহযোগিতায় একটি স্কুল ঘর নির্মাণ করেন এবং তার এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে বিনা বেতনে পাঠদান করতে থাকেন। বহু সাধনা আর তদবির করার পর ২০১৩ সালে স্কুলটি সরকারিকরণ করা হয়। রামচন্দ্র কিছুটা আলোর মুখ দেখেন , সরকারী বেতন পান । কিন্তু সেই সুখ বেশীদিন স্থায়ী হয়নি । ২০১৪ সালে তাকে অবসরে যেতে হয় । এই স্কুলের জন্য তাকে বহু অবহেলিত হতে হয়েছে, এমনকি তার গরিবী পোশাক-পরিচ্ছদের জন্য জনৈক সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা তাকে অপমানিত করেন। বর্তমানে তিনি পেনসন বাবদ নয় হাজার টাকা পান প্রতিমাসে।

শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি লেখালেখি অব্যাহত রাখেন। প্রচুর লিখেছেন। কবিতা, গান, পল্লীগীতি, নাটক, তর্যা গান বা কবি গান। প্রায় ১৮০০ টি গান ও কবিতা রয়েছে তার লেখা। ‘নিতি’ নামে একটি নাটক লিখেন। বিবি খাদিজাকে নিয়েও একটি নাটক লিখেছেন। এতসব কিছুর পান্ডুলিপি তার প্রাণ। আজও তিনি আগলে রেখেছেন তার জীবনের মূল্যবান সম্পদ মনে করে। সযতনে রাখা পান্ডূলিপিগুলো টেবিলে এনে দেখালেন। কিছু কিছু পড়ে দেখলাম। সত্যই মানসম্মত। ভাষা অত্যন্ত সাবলিল। মুক্তিযুদ্ধের একটি কবিতা লিখেছেন অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায়। ভুগোল কাকে বলে তা একটি ছোট কবিতায় প্রকাশ করেছেন চমৎকারভাবে। বহুদিন আগে তার লেখা ২৫ টি পল্লীগীতি সংবলিত একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন, সেগুলোও বেশ চমৎকার। কোন মেঘে কেমন বৃষ্টি হয় সেটাও কবিতায় প্রকাশ করেছেন সুনিপুনভাবে। প্রতিদিন ৪ কি.মি. পথ হেঁটে রহনপুর বাজারে গিয়ে তার লেখাগুলো কম্পিউটারে কম্পোজ করিয়ে নেন।

তার জীবনের যত লেখা তা কম্পোজ করার মত অর্থ তার নেই। তার লেখা গানগুলোর সুর দিয়েছেন এবং গেয়েছেন তার ভাতিজা মুক্তেশ্বর। শুধু তাই নয়, সেই গান রেডিও মহানন্দা থেকে প্রচারিত হয়েছে। দৈনিক গৌড় বাংলাকে তার লেখা কিছু পান্ডুলিপি দিয়ে রেখেছেন। গৌড় বাংলা প্রথমদিকে ২/৪ টি কবিতা পত্রস্থ করলেও এখন আর করে না। কিন্তু তিনি আশা ছাড়েননি। হয়তো আগামীকাল প্রকাশ হবে এই প্রত্যাশায় প্রতিদিন তিনি রহনপুর বাজারে যান গৌড় বাংলা পত্রিকা দেখতে। কিন্তু আশাহত হন। এ দুঃখ তার হৃদয়ে বাজে । তার সবগুলো লেখা নিয়ে একটি বই প্রকাশ করার ইচ্ছে পোষন করেন মনে মনে । কিন্তু অর্থনৈতিক দৈন্যতার কারণে তা পারেন না। এটাও তাকে পীড়া দেয়। কষ্ট হয় এই শেষ বয়সে এসেও তার কোনো মূল্যায়ন হলোনা, কেউ জানলো না তার প্রতিভাকে।

লেখক: সহকারী শিক্ষক, প্রাথমিক বিদ্যালয়