মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৮ মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
শহীদ স্মৃতস্তম্ভ
সোনার দেশ ডেস্ক :
দিনাজপুর মহারাজা স্কুল মাইন ট্র্যাজেডি দিবস ছিল গতকাল। ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি মহারাজা গিরিজানাথ হাইস্কুলের ট্রানজিট ক্যাম্পে ভয়াবহ মাইন বিস্ফোরণে ৫ শতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সদ্য বিজয়ী দেশে যখন মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ নিচ্ছিলেন, মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিচ্ছিলেন তখনই ঘটে এমন রক্তক্ষয়ী ঘটনা। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ভয়াবহ এই মাইন বিস্ফোরণে একসঙ্গে ৫ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নিহত হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে এটিই প্রথম ও একমাত্র।
ইতিহাসের এই ভয়াবহ ও মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের এই দিনটি এখনও অনেকেরই অজানা। বিভিন্ন স্থানে পুঁতে রাখা মাইন ও গোলাবারুদ উদ্ধার করতে গিয়ে বিস্ফোরণে নিহত হয়েছিলেন এসব মুক্তিযোদ্ধা। তাদের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদ প্রতিবছরই নানা কর্মসূচি পালন করে। এবারও তারা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন। তাদের দাবি, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই ঘটনাটিকে পাঠ্যপুস্তকে অর্ন্তভুক্ত করার। যাতে করে আগামী প্রজন্ম দেশের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারে।
৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদের নেতৃবৃন্দ জানান, ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীন দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর পুঁতে রাখা মাইন উদ্ধারের কার্যক্রম শুরু করেন মুক্তিযোদ্ধারা। দিনাজপুর শহরের উত্তর বালুবাড়ীর মহারাজা হাইস্কুলে স্থাপন করা হয় মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্প।
বিজয় অর্জনের পর ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ক্যাম্পে এসে সমবেত হন দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়সহ আশপাশের জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধারা। সেই সময় ভারতের পতিরাম, হামজাপুর , বাঙ্গালপুর, তরঙ্গপুর, বাংলাদেশের নবাবগঞ্জ, ঘোড়ঘাট, ফুলবাড়ি, হাকিমপুর, দিনাজপুর সদর, ঠাকুরগাঁও, পীরগঞ্জ, রাণীশকৈল ও হরিহরপুর এলাকা থেকে সংগ্রহ করা মাইন, গোলা বারুদগুলো সংগ্রহ করে ট্রাকে করে এই ট্রানজিট ক্যাম্পে নিয়ে আসতেন এবং জমা করতেন।
এখানে সমবেত হওয়া ৮ শতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীন বাংলাদেশকে পুঁতে রাখা মাইনমুক্ত করতে কাজ করছিলেন। ক্যাম্প থেকে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা বেরিয়ে পড়তেন পাক সেনাদের ফেলে যাওয়া, লুকিয়ে রাখা ও পুঁতে রাখা মাইন ও অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদের সন্ধানে। সন্ধ্যার দিকে উদ্ধার মাইন ও অস্ত্র জমা করা হতো মহারাজা স্কুলের দক্ষিণাংশে খনন করা বাংকারে।
১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি মাগরিবের নামাজের সময়ে উদ্ধার অস্ত্র বাংকারে নামানোর সময় একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার হাত থেকে একটি মাইন পড়ে যায়। এতে করে মাইনটি বিস্ফোরিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে বাংকারের পুরো অস্ত্রভান্ডার বিস্ফোরিত হয়। বিকট বিস্ফোরণে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি হয় মহারাজা স্কুল প্রাঙ্গণসহ এর আশপাশের এলাকায়। এতে পাঁচ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং বহুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
পরে ঘটনাস্থল থেকে আহতাবস্থায় অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে উদ্ধার করে দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতাল ও সেন্ট ভিসেন্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নিহতদের উদ্ধার করে এবং তাদের শরীরের খণ্ডিত হাত, পা, মাথাসহ বিভিন্ন অংশ জমা করা হয় মাঠের এককোণে। নিহতদের শরীরের বিভিন্ন অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। অনেককেই চেনা যাচ্ছিল না।
পরের দিন সাড়ে ৪০০-এর বেশি শহীদ মুক্তিযোদ্ধার জানাজা অনুষ্ঠিত হয় দিনাজপুর গোর-এ শহীদ ময়দানে। পরে নিহতদের সকলকে একসঙ্গে চেহেলগাজী মাজারসংলগ্ন এলাকায় গণকবর দেওয়া হয়। পরে আহতদের মধ্যে আরও ২৯ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। দিবসটিকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদ ও দিনাজপুর প্রেসক্লাব বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে আসছে।
এতবড় দুর্ঘটনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে অর্ন্তভুক্ত করা ও জাতীয়ভাবে দিবসটি পালন করার দাবি জানিয়ে আসছেন ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদের নেতৃবৃন্দ।
দিনাজপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা সফিকুল হক ছুটু বলেন, ‘সেদিন বিকট শব্দে পুরো শহর কেঁপে ওঠে। দুর্ঘটনার পর আমি ছুটে যাই ঘটনাস্থলে। সেখানে জীবিত ও নিহতদের উদ্ধার করেছিলাম সকলে মিলে।
পরে আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করি। সেদিন মাইন বিস্ফোরণে কতজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায়নি। তবে সকালের রোলকলে উপস্থিত ছিলেন ৭৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা। দুর্ঘটনার আগে ৫০ থেকে ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছুটি নিয়ে ক্যাম্প ত্যাগ করেছিলেন। অনুমান করা হয় যে সেদিনের ঘটনায় সাড়ে ৪ শতাধিক এবং পরে আহতাবস্থায় যারা হাসপাতালে ছিলেন তাদের মধ্যেও অনেকেই মারা গিয়েছিলেন।
সেই হিসেবে সেদিনের ঘটনায় ৫ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু হয়েছিল। এ ছাড়াও ওই এলাকায় বসবাসরত ১৫ জন মানুষও মারা গিয়েছিলেন।’
৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক আজহারুল আজাদ জুয়েল বলেন, ‘দিবসটি পালন করা হয় যথাযোগ্য মর্যাদায়।
শহীদদের স্মৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। দীর্ঘদিন ধরেই আমরা একটা দাবি জানিয়ে আসছি যে, ইতিহাসের এতবড় একটি ঘটনা অবশ্যই যাতে করে পাঠ্যপুস্তকে অর্ন্তভুক্ত করা হয়। এতে করে আগামী প্রজন্ম মুক্তিযোদ্ধাদের এত বড় আত্মত্যাগের কথা জানতে পারবে। একই সঙ্গে দিবসটি যাতে জাতীয়ভাবেও পালন করা হয় সেই দাবিও করেছি আমরা।’
তথ্যসূত্র: বাংলাট্রিবিউন