একুশে ফেব্রুয়ারির আত্মসমীক্ষা

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭, ১:০৪ পূর্বাহ্ণ

সুজিত সরকার


প্রতিটি জাতির মতো বাঙালিও সহ¯্রাধিক বছর ধরে অনেক ধর্ম-সম্প্রদায়ের পরিচয়ের বাঙালিত্বের ঐতিহ্য ও শক্তি নিয়ে এই ভূ-খ-ে বসবাস করছে। অতীতে ব্রাহ্মণেরা অর্থাৎ উচ্চবর্ণের হিসেবে দাবিদারেরা এই জাতিকে ম্লেচ্ছ, অস্পৃশ্য, অচ্ছ্যুত, বিদ্যা-বুদ্ধিহীন বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে। আজো করে। বিশেষ করে যারা নিজের  অপরাধ আর ভুলটাকে আড়াল করতে সিদ্ধহস্ত, তারা এ রকমও বলে, ‘বাঙালি তো তাই সময়জ্ঞান নেই। এরা ঘুসখোর-দুর্নীতিবাজ হবে না তো কে হবে?’ কোনো একটি ভুলের জন্যে বা অভ্যেসবশত যথাবিধি কোনো কাজ সম্পন্ন না করায় বলে থাকে, ‘বাঙালি তো তাই এমনটা করেছে। অমুক দেশে এমনটা হয় না। ওরা ভীষণ সকল কাজে পারদর্শী, কর্তব্যজ্ঞানসম্পন্ন।’ যে এ রকম বলে, সে কিন্তু নির্ভেজাল বাঙালি নয়। নিজেকে ভাবে মধ্যপ্রাচ্য ও য়্যুরোপের নাগরিক হিসেবে। তাই এরা নিজের জাতি-গোষ্ঠি সম্পর্কে এমন কূট শব্দ এবং আত্মঘাতী বক্তব্য উচ্চারণ করে। এরা কি জানে না, এদের এই বক্তব্যগুলো আত্ম-অপমানকর। বিশ্বের অন্য কোনো জাতি বোধ হয় নিজেদে সম্পর্কে এমন আত্মঘাতী বাক্য উচ্চরণ করে না। লিখেও না। যারা এমন উচ্চারণ করে না, তারা তো কোনো জাতি-গোষ্ঠির ওপর দমন-নিপীড়ন করেনি। করেনি কোনো দেশ দখল। মানবতাকে অপহরণ। যারা করে তারা দেশে দেশে মন্বন্তর সৃষ্টি করে মানুষ হত্যা করে। শান্তিকে করে পদদলিত। সে কারণে বাঙালির নিশ্চয়ই আত্মশ্লাাঘায় ভোগা সমীচীন নয়। বরং তাদের দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত হওয়া প্রত্যাশিত। কেনো অপকথা উচ্চারণ করে তারা নিজেকে ছোট করবে! তারা কেনো হবে আগ্রাসন আর প্রভূত্ববাদীরদের সমতুল্য হিসেবে নিজের পরিচয়কে কালো বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ করে সমগ্র জাতিকে অসম্মান করবে? যারা নিজেকে অপমান-অসম্মান করে আত্মগ্লানিতে ভোগে না, অন্যের দুর্বলতা, দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়ায়, তারা আরো বেশি অচ্ছ্যুত-ম্লেচ্ছ আর নি¤œবর্গের অধিবাসী। যে নিজের ভাই-বোনদের আচরণ এবং জীবনাচারের স্বাতন্ত্র্য আর চলমান গতির সঙ্গে মিললে নিজের সবকিছু অপহরণের আতঙ্কে ভোগে। জানতে-বুঝতে পারে না অপকথা উচ্চারণ করে সে সত্যিই দুর্ভাগা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের অধিকারী হয়। তার অপকথায় আগ্রাসনবাদীরা সুযোগ নেয়। লুটপাট করে একটি ভূ-খ-ের সম্পদ। যে সব বিদেশি বাংলাদেশ শাসন করেছে, তারা কি জানে না বাঙালি কতোটা শৌর্য-বীর্যের অধিকারী? স¤্রাট আকবর পর্যন্ত বাংলা দখল করে নিরাপদবোধ করেননি। তাকে বার বার বাংলা অভিযানে অংশ নিয়ে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। সেই বাঙালির উত্তর পুরুষ কেউ যখন বাঙালির ভাষা-শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, কোন্টা হিন্দু আর কোন্টা মুসলিম কবির রচনা সে বিবেচনায় শিশুপাঠ্যসূচিভুক্ত করে। এরা বাংলা ভাষার ওপর সব সময়ই অসহিষ্ণু আর বিমাতাসুলভ আচরণ করে থাকে। এবারের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠ্যবইয়ে তার আরেকটি নির্বোধ ও  ন্যক্কারজনক আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
যে বাঙালিকে নিয়ে স্বদেশি-বিদেশি এতো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, তারা একবারও নিজের চেহারা আয়নায় দেখে না। দেখলে তার বিকৃত রূপ দেখে সে-ই লজ্জা পেতো। তাদের সবিনয়ে নিজেরা চেহারাটা একবার দেখতে অনুরোধ জানাই। একই সঙ্গে আত্মজিজ্ঞাসার একটা খতিয়ানও তৈরি করতে বিনীত আহ্বান জানাই। দেখলে তারা দেখতে পাবেন, সেখানে কতো ক্লেদ, কতো আবর্জনা জমে আছে।
বাঙালি ঘুসখোর-দুর্নীতিবাজ বলে অনেক সংস্থা অঙ্ক কষে জানান দেয়, এবার বাংলাদেশের স্থান ১৯ কিংবা ২০ তম। এ অঙ্কেই মেলে বাঙালি প্রথম নয়। অর্থাৎ তার আগেরগুলো থেকে তো মোটেই খারাপ নয়। তার ওপরে বা নিচে আরো আছে। আমার এ লেখা যারা পড়বেন, তারা দয়া করে বলবেন কী বিশ্বের কোন্ দেশে ঘুস-দুর্নীতি হয় না? জানি সবাই উত্তরে বলবেন, কম-বেশি সব দেশেই ঘুস-দুর্নীতির বাণিজ্য চলে। সম্পদে একচ্ছত্র মালিকানা প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ অপরাধের সঙ্গে মনুষ্যসমাজ নানাভাবে যুক্ত। একবার বলবেন, সেই সভ্য-সংস্কৃতিবানেরা কি কখনো মাতৃভাষার মর্যাদার জন্যে আত্মদান করেছে? তারা কি স্বাধীনতার জন্যে এতো স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ত্রিশ লক্ষ জীবন দান করেছেন? দিয়েছেন কি তাদের সাড়ে চার লক্ষ মা-বোন সম্মান-সম্ভ্রমতা বিসর্জন? আমি জানি, এমন রক্তাক্ত খতিয়ান কোনো জাতির ইতিহাসে নেই। তাহলে তারপর কেনো বাঙালি জাতিকে এমন অসম্মানের রূঢ় ভাষা শুনতে এবং মেনে নিতে হয়? তার কারণ বাঙালি সহনশীল এবং ইতরদের ইতরামির জবাব ইতর ভাষায় দিতে শেখেনি। পছন্দও করে না। সেটাও ভদ্রতার পরিচয় নয়। আর করে না সেটা বলে কারো বাড়া ভাতে ছাইও দেয় না। এটাই বাঙালির সমন্বয়-বন্ধুত্ব সৃষ্টির দৃষ্টান্ত। এটা কি তাহলে কোনো গুণ নয়? নাকি কোনো সংস্কৃতির স্বাক্ষর?
বাঙালি প্রতিবেশী আর দূর কোনো মানব বসতিতে আক্রমণাত্মক ভূমিকা পালন করে সেখানের মানবতা ও শান্তিকে পদদলিত করেনি। পারসি-তুর্কি-মোগল-ইংরেজ-পাকিস্তান এই বাংলাদেশের ওপর বারংবার চড়াও হয়েছে, করেছ লুটপাট, উৎপীড়ন। এই ভাষার ওপর শাসকদের ভাষা চাপিয়ে দেয়ার নানা ষড়যন্ত্রেও লিপ্ত হয়নি। সে ইতিহাসের বিবরণ দিতে গেলে মহাভরতের আকার ধারণ করবে। পাল-সেন আমলে বাংলাভাষা এবং বাঙালিকে ম্লেচ্ছ-অচ্ছ্যুত বলে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। বাংলাভাষায় সাহিত্যানুশীলন করা যাবে না বলে নিষধাজ্ঞা জারি করেছে। করলে বিদ্যার দেবীকে অসম্মান-অবজ্ঞা করা হবে বলে ভয় দেখিয়ে বলেছে, দেবী তাদের হাতের আঙুল কেটে দেবে, চোখ তপ্ত লৌহ শলাকা দিয়ে উৎপাটন করবে। ইত্যাদি আরো অনেক ভয়-আতঙ্ক শাসককূল সৃষ্টি করেছে। দু’চারজনকে বাংলাভাষায় কবিতা রচনার অভিযোগে বসতভিটে ছাড়া করেছে।  আত্মরক্ষার জন্যে কবি-শিল্পীরা বনে-জঙ্গলে নয়তো প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু মাতৃভাষায় সাহিত্য রচনায় কোনো কবি দুঃশাসকদের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। সত্যিকারের কবি সাহসী এবং দিব্যজ্ঞানসম্পন্ন। দিকনির্দেশক এবং অশুভর প্রতিপক্ষ। তার নিদর্শন ‘চর্যাপদ’। এই ‘চর্যাপদ’ নেপালের রয়েল লাইব্রেরি থেকে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কার করেন। বাঙালির আদি সাহিত্য নির্দশনের অন্যতম। অন্যতম এ জন্যে যে, এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত সবচেয়ে প্রাচীন সাহিত্য নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ তাই। তাহলে যে জাতির হাজার বছরের সাহিত্য নিদর্শন আছে, সে জাতি মাতৃভাষার ওপর যখনই আক্রমণ হয়েছে, তখনই মেরুদ- সোজা করে আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে রাজপথে দাঁড়িয়েছে। লড়াই-সংগ্রাম করেছে আদিকাল থেকে। এখনো সে লড়াই শেষ হয়নি।
এখন সরাসরি কোনো দুঃশাসক বা কোনো জাতি বাঙালি ও বাংলাভাষা-সংস্কৃতির ওপর খড়গহস্ত হচ্ছে না। দখল করছে না ভূমি। এখন বেনিয়া পুঁজি তার খাদ্য এবং অন্যান্য পণ্য আমাদের ওপর চাপিয়ে মাঠ দখলে নিয়ে তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত। আজকের শিশুরা দুধ পান করে না। পান করে ঠা-া পানীয়। খায় ফাস্ট ফুড, বাঙালির ভূ-খ-ে উৎপাদিত মাছ-তরকারি নয়। অধিকাংশ পরিবারের চিত্র এমন। সেই সঙ্গে ফাস্ট ফুড ও অন্যান্য পণ্যের যে নাম তারা আয়ত্ব করছে, মানে তারা মনে রাখছে বিদেশি শব্দ। তার সঙ্গে একাত্ম হতে বেশি স্বচ্ছন্দ্যবোধ করছে। জাতির অতীত গৌরব, গৌরবময় অর্জন তারা কতোটা ধারণ করছে, এ নিয়ে সচেতন অভিভাবককূল দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত। তারা স্বাজাত্যবোধের সরল পথে নিজেদের প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে দেশপ্রেমিক নাগরিকে গড়েও তুলছে কি? বরং তার সন্তান কতোটা ইংরেজিতে পারদর্শীতা অর্জন করবে আদা-জল খেয়ে সে চেষ্টায় নিমগ্ন থাকছে। এটা ওই নিজের জাতি সম্পর্কে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে থাকে যারা তাদের গোত্রভুক্ত হওয়ার সমতুল্য।
অনেকেই মনে করেন, তিনি এবং তার পরিবার বিদেশি ভাষা-সংস্কৃতি রপ্ত ও অনুশীলন করছেন না বলে বোধ করি তিনি এবং তার পরিবার পিছিয়ে পড়ছেন। এমন ভাবনাও আত্মঘাতী। আমার যা আছে, সেটা নিয়ে এগোনোই বোধ করি বেশ সম্মানজনক। রাষ্ট্রেরও সে উদ্যোগ ও আয়োজনে গুরুত্ব দেয়া অনিবার্য। কয়েকদিন আগে সংবাদপত্রে পড়লাম, এ দেশে চাকরির একটি বিজ্ঞাপনও নাকি ভালো বাংলা যারা জানে এমন কোনো পদপ্রার্থীর খোঁজ করেনি। কেবল ইংরেজি আর অন্য কোনো ভাষা ভালো জানলেই নাকি যোগ্য প্রার্থী হওয়া যায়। এটা কাদের আয়োজন? আয়োজন সেই ব্যক্তিদের যারা নিজেরা দাসানুদাস ভাবতে পরম সৌভাগ্যবান ভাবে, তারা। ইংরেজিতে ফাইলে ভালো একটা নোট শতকরা নিরানব্বই জন দিতে পারে না। তবুও বিদেশি  ভাষার প্রতি এমন অনুরক্ত নিঃসন্দেহে দাসবৃত্তিকেই উৎসাহিত করে। যে নিজে দাস, সে তার পাল্লা ভারি করার উদ্দেশ্যে এমন দাসানুদাসের সন্ধান করে। স্বাজাত্যবোধ আর মাতৃভাষা সে কারণে উপেক্ষিত হয়। এটা লজ্জার। এটা নিঃসন্দেহে নিজের কবর নিজে খোঁড়ার সমতুল্য।
আমাদের সন্তানেরা মাতৃভাষা ভালো জানবে কী করে? শিক্ষার শুরুতে তার ওপর তিনটে ভাষা চাপানো হয়। এক মাতৃভাষা, দুই কলোনিয়ান ভাষা, তিন ধর্মের ভাষা। এই তিন ভাষা বোঝা নিয়ে বেড়ে উঠতে উঠতে শিশু বিভ্রান্ত হয়ে যায়। ফলে সে কোনো ভাষাই আয়ত্ত্ব করতে পারে না। তাইতো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক-কর্মকর্তা আছেন যিনি একটা নৈমিত্তিক ছুটির আবেদনে অসংখ্য ভুল বানান লিখেন। আবেদনের আঙ্গিকটাকে শুদ্ধ করে লিখতে জানেন না। শিক্ষিত হিসেবে সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিতরাই যদি এমন অর্ধেক শিক্ষিতর মতো আচরণ করেন তাহলে ভাষার শ্রীবৃদ্ধি এবং গৌরব কীসে বিকশিত হবে? কেবল কি কবি-সাহিত্যিকরাই সে দায় বহন করবেন? সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্তের কাজ কি কেবল অনুশাসন জারি করা? আর এখানেই যতো দু’নম্বরী কথার উদ্ভব। বাঙালি চোর, মিথ্যুক, সময়জ্ঞান নেই, ঘুসখোর ইত্যাদি। যারা এ সব হামেশাই বলছে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তারা দেশের স্বাধীনতাকেও মানে না। একাত্তরে দুই ধরনের অবস্থানে তারা ছিলো। কখনো রাজাকারি কখনো বা মুক্তিযোদ্ধা। হালে যে বাতাস যখন প্রবাহিত হয়েছে, তখন সেদিকে বৈঠা মেরেছে। আর এ কারণে দেশে প্রতি বছর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই আত্মগ্লানি নিয়ে আমাদের চিন্তা খুব কম। অনেকেই ভাবছে, মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হয়ে দেশের কোষাগার থেকে মাসে মাসে দশ হাজার টাকা পেয়ে বেশ আরামে আছে। অনেক শিক্ষিত মানুষ, সংসদ সদস্য পর্যন্ত এই মিথ্যে পরিচয়ে নিজেকে কলুষিত করতে নানা আয়োজন করছেন, যা সত্যি বেদনাদায়ক। তারা এমনটি না করলেও পারতেন। কেনো না, মুক্তিযোদ্ধা না হলেও ওই শিক্ষিত ব্যক্তি, রাজনীতিক নেতা সমাজে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত তো হয়েছেন। তাকে সেখান থেকে নামাবে কে? নামাচ্ছেন তিনি নিজেই। যিনি যখনই মিথ্যে পরিচয়ে পরিচিত হতে উদ্যত তখনই তার সততা, প্রজ্ঞা আর স্বচ্ছ ব্যক্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়। মনে হয় এদের কারণেই বাঙালিকে অচ্ছ্যুত-অস্পৃশ্য বলেছে। সেন শাসকের আমলা কিংবা সিরাজের মন্ত্রী-পরামর্শক তো তুর্কি বিজয়ীর হালে বাতাস দিয়েছে। ইংরেজ সমর্থক হয়ে বাংলা-বিহার ওড়িষ্যায় মহামারী-দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। দ্রুততম সময়ে মাসকের ভাষা আয়ত্ত্ব করে তাদের বিশ্বস্ত দাসে পরিণত হয়েছে। সেই তারাই আবার বাঙালির কর্ম ও চরিত্র নিয়ে কটাক্ষ করে আনন্দ উপভোগ করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং হত্যা পর সামরিক দুঃশাসন, অগণতান্ত্রিক এবং সাম্প্রদায়িক অপ-শক্তির উত্থান ঘটেছিলো, এদের অযোগ্যতা এবং আপোসকামীতা দুঃশাসনের কালো অধ্যায় স্থাপন তার অন্যতম কারণ। না হলে স্বাধীনতার স্থপতিকে হত্যার পর দেশময় কেনো গভীর নীরবতা বিরাজ করছিলো? জানি না আমার মতের সঙ্গে পাঠক সহমত পোষণ করবেন কি না। না করলে লিখে জানাবেন। আমার সীমাবদ্ধ ধারণা আরো শাণিত হবে।
আমাদের মাতৃভাষার নিবিড় চর্চা করা জরুরি। আগ্রাসন তো একই আঙ্গিকে হয় না। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে যেমন জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে, ভাষার ঘটছে। তা নিয়ে গবেষণা অতীতে হয়েছে, এখনো হচ্ছে। ভবিষ্যতেও হবে। আমরা প্রত্যেকে যদি প্রতিদিন যা উচ্চারণ করি, তার প্রতি সচেতন দৃষ্টি রাখি, উচ্চারণের শব্দাবলির ওপর গুরুত্ব দিই, উত্তরপ্রজন্মকে সে বিষয়ে উৎসাহ ও কৌতূহল জাগাতে পারি, তাহলেও বিদেশি পণ্য, তাদের সংস্কৃতি, জীবনবোধহীন কৃত্রিম আচরণের দুয়ারে আমাদের উৎসর্গ করতে হবে না। আমরাই তখন পণ্য উৎপাদন করে, আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে বিশ্বের নানা দেশে সরব উপস্থিতি জানাতে পারবো। রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ সে পরিচয়কে আরো গর্বিত করেছে। এখন আমাদের শ্রমজীবী দক্ষ মানুষ অন্য দেশকে সমৃদ্ধ করছে। তাদের শ্রম এবং বুদ্ধি যদি আমরা যথাযথভাবে নিজ দেশে ব্যবহার করতে পারতাম, তাহলে এ দেশ, এ দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি আজকে বিশ্বনন্দিত হতো। আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিও আক্রান্ত হতো না। অপকথারও পরিসমাপ্তি ঘটতো। যেমন হয়েছে আমাদের ‘চর্যাগান ও কবিতা’ এবং একুশের সাহসিকতা, আত্মদান আর অনুকরণীয় লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। আমাদের আত্ম সমীক্ষণে এ সব অবধারিত হওয়াটাই কাম্য। রাষ্ট্রই পারে জাতিকে নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির আলোকে গড়ে তুলতে। যেমন অনেকের বিরোধিতা পরও রাষ্ট্র যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে তার অবিনশ্বর ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা আবশ্যিক।