একুশ ও একটি ভাবনা

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭, ১:০৪ পূর্বাহ্ণ

পুতুল রহমান


মা, মাতৃভাষা, মাতৃভূমি এই ত্রয়ী সত্তার সম্মিলনে আমার পরিচয়। কারণ মা আমাকে এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন, মাতৃভাষা আমায় নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ করে দিয়েছে, মাতৃভূমি দিয়েছে একটি আশ্রয়স্থল যেখানটায় দাঁড়িয়ে আমি স্বাধীন, সার্বভৌম ইচ্ছার এবং মুক্তচেতনার বিকাশ ঘটাতে পারছি। তাই একুশ আমার অহংকার, আমার গৌরবময় সত্তা। একুশের অনুভব আমার চেতনায়, মননে, হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত। তাই তো কবি অতুল প্রসাদ বলেছেন-
মোদের গরর মোদের আশা
আ’মরি বাংলা ভাষা
ওমা তোমার কোলে, তোমার বোলে
কতই শান্তি, ভালবাসা।”
কিন্তু কোথায় সেই শান্তি, কোথায় সেই ভালবাসা? কবি আলাউদ্দিন আল-আজাদের সেই বিখ্যাত  চরণ-
“স্মৃতির মিনার ভেঙ্গেছে তোমার?
ভয় কী বন্ধু
আমরা এখনও চার কোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো!”
ভাষা আন্দোলনের পঁয়ষট্টি বছর পর সেই চার কোটি পরিবার এখন প্রায় সতেরো কোটিতে উন্নীত হয়েছে। আমরা কি পেরেছি মাতৃভাষার প্রতি, ভাষা শহিদদের প্রতি সঠিক মূল্যায়ন করতে? পৃথিবীতে একটি মাত্র জাতি যাঁরা ভাষার জন্য রক্ত ঝরিয়েছে, অকাতরে প্রাণ দিয়েছে, তাঁরা ‘বীর বাঙালি’। আজ তাঁদের পরিচয় বাংলাদেশি। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অধিবাসী।
ভাষা শহিদদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাংলাকে আমরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পেয়েছি। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতি হিসেবে আমাদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। ভাষার চেতনা ও স্বাধিকার বোধের চেতনায় বিকশিত হয়ে আমরা ১৯৭১ সালে অর্জন করেছি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।
আজ স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। অথচ আমরা এখনও একটি আলোকিত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারিনি।
একজন শিক্ষক হিসেবে আমি খুব মর্মাহত হই, যখন দেখি ভাষার প্রতি অবহেলা, অবজ্ঞা, ইংরেজি স্টাইলে বাংলা উচ্চারণ, অশুদ্ধ উচ্চারণ, অজ¯্র বানান ভুলের প্রবণতা। তখন মনে পড়ে যায় মধ্যযুগের এক প্রতিবাদী  ও সংগ্রামী কবি আবদুল হাকিমের কবিতার কথা-
“যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।”
ভাষা শহিদদের স্মৃতিতে বাঁচিয়ে রাখতে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে শহিদ মিনার। ইতিহাস বিশ্লেষণে আমরা জানতে পারি যে, ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহিদ মিনারটি নির্মিত হয়েছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজশাহী কলেজ হোস্টেলের মেইন গেটে  ‘শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ” নাম্ েপরের দিন সকালে পুলিশ এসে সেটা ভেঙ্গে দেয়। গর্বে আমার হৃদয়টা স্ফীত হয়ে ওঠে যখন জানতে পারি সেই আন্দোলনে এবং প্রথম শহিদ মিনারটি নির্মাণে আমার মামা শ্বশুর ড এস.এম. এ গাফফার এর সক্রিয় ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। সে সময় তিনি ছিলেন তৎকালীন রাজশাহী মেডিকেল স্কুলের ছাত্র। সেই সময় আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্বদানও ছিল বিশেষভাবে স্মরণীয়। যদিও বিভিন্ন লেখায় বা আলোচনায় সেগুলো তেমন পরিস্ফুট হয়ে ওঠেনি। প্রসঙ্গক্রমে জানতে পারি ডা. গাফফার সাহেব যখন কারারুদ্ধ ছিলেন তখন একসময় বাড়ি থেকে তাঁকে খাবার পরিবেশনের অনুমতি পাওয়া যায়। তাঁর ছোট বোন ডা. কুলসুম বারী, (সে সময়ে তিনিও রাজশাহী মেডিকেল স্কুলের ছাত্রী ছিলেন) রুটির মধ্যে চিরকুটে আন্দোলনের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে পাঠাতেন। সেসময় নিঃসন্দেহে এটি ছিল একটি দুঃসাহসী ভূমিকা।
আমি আনন্দে বিমোহিত হয়ে পড়ি, অশ্রুসজল হয়ে ওঠে আমার চোখের কোণ। ভালোলাগে যখন দেখি রাজশাহীর ভুবনমোহন পার্কে ভাষা শহিদদের স্মৃতিস্তম্ভে এই শ্রদ্ধেয় দুজনের নামও অংকিত আছে। নিজেকে খুব অহংকারী মনে হয় যখন ভাবি আমি এরকম একটি সংগ্রামী পরিবারের সদস্য। কিন্তু পরক্ষণেই স্তিমিত হয়ে আসে আমার অহংকার। আমি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। এ কোন সময়ের মুখোমুখি আমরা? আমরা কি পারছি মাতৃভাষা, মাতৃভূমি, ভাষা শহিদ ও ভাষা সৈনিকদের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জানাতে, সঠিক মূল্যায়ন করতে?
হয়তো বা নয়।
ভাষা আন্দোলনের ষাট বছরে আমাদের অর্জন আছে অনেক। তবে তা রাজনৈতিকভাবে যতটা বেশি, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগতভাবে ততোটা নয়। রাজনৈতিকভাবে একুশ আমাদের একতাবদ্ধ করেছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের আলাদা একটি সত্তা দিয়েছে।
সারা পৃথিবীতে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য একটি বড় অর্জন। এ প্রসঙ্গে একটু উল্লেখ করতে চাই-আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশি ভাইয়েরা আমাদের দেশের মান এবং ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রেখে চলেছে। ‘২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে প্রবাসী দুজন বাংলাদেশির আন্তরিক উদ্যোগ এবং প্রয়াস। আমাদের দেশের জনগণের পক্ষ থেকে আমি তাঁদের জানাই হৃদয় নিংড়ানো শুভেচ্ছা। বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে আমরা একটি প্রতিষ্ঠান পেয়েছি- বাংলা একাডেমি। কিন্তু বাংলা ভাষার চর্চা, ভাষার মান বৃদ্ধিতে প্রতিষ্ঠানটি তেমন খুব বেশি এগুতে পারেনি। ভাষাভাষীর দিক থেকে পৃথিবীতে বাংলার স্থান চতুর্থ, কারও মতে পঞ্চম। কিন্তু শব্দ গণনার দিক থেকে বিচার করলে বাংলা ভাষার স্থান হবে ১৫০টি ভাষার পরে। কারণ বাংলা একাডেমির অভিধান অনুযায়ী বাংলা ভাষার শব্দ আছে মাত্র ৮০ থেকে ৮৬ হাজার। তবে বাংলা ভাষার শব্দ সংখ্যা কিন্তু এতো কম নয়। আমরা তা বাড়াতে পারিনি। যেহেতু মাতৃভাষার চর্চা নেই তাই এ শব্দসংখ্যা বাড়ানোর কোন উদ্যোগও চোখে পড়ে না।
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ এলেই অনেক বড় বড় বক্তৃতার ফুলঝুরি ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ব্যাপক আকারে গবেষণাধর্মী কোন ভাষা ইন্সিটিউট বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়নি। এ ব্যাপারে আমাদের সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, সরকার সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকতে হবে। বিশ্বায়নের যুগে সবাই এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদেরকে এগুতে হলে বাংলা ভাষাচর্চা সহ অবশ্যই ইংরেজি এবং অন্যান্য ভাষা জানতে হবে। তার মানে এই নয় যে, আমরা নিজেদের স্বকীয়তা ভুলে যাব। আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আমাদের ভাষাকে সামনে রেখে আমরা বিশ্বায়নের সাথে এগিয়ে যাব। আমরা যখন বাংলা ভাষায় কথা বলবো তখন যেন শুদ্ধ উচ্চারণে সুন্দরভাবে বলতে পারি সেদিকে নজর রাখবো। এ কাজটি আমরা পরিবার থেকেই করতে পারি। কোমলমতি শিশুরা যখন কথা বলে, কথা শুনতে চায় তখন পরিবারের সদস্যরা তাদের সাথে শুদ্ধ উচ্চারণে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলবে। আঞ্চলিকতা পরিহার করে প্রমিত চলিত রীতি অনুসরণ করতে হবে। বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়ে আমরা আর ভুলে ভরা পাঠ্যবই দেখতে চাই না। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনকে সতর্ক হতে হবে। বই পড়ার প্রতি শিশুদের আগ্রহ বাড়াতে হবে। আকর্ষণীয় মলটি এবং রঙ্গিন ছবি, দৃশ্য ইত্যাদি ব্যবহার করে শিশুতোষ বইয়ের সংখ্যা বাড়াতে হবে। সহজ, সাবলীল শব্দচয়নের মাধ্যমে রচনাকে সমৃদ্ধ করতে হবে। বাংলা ভাষার প্রচলন বাড়াতে হবে। তবে তা হতে হবে শুদ্ধ চর্চার মাধ্যমে। প্রয়োজন অনুযায়ী আঞ্চলিক ভাষা থেকে শব্দ চয়ন করে, বিদেশি ভাষা থেকে শব্দ সংগ্রহ করে আমাদের শব্দ ভা-ার বাড়াতে হবে। আমাদের দেশে অনেক উপজাতি গোষ্ঠী রয়েছে তাদের ভাষা যাচাই বাছাই করে শব্দ সংগ্রহ করতে হবে।
একুশের অর্জনকে একদিনের আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ না রেখে ছড়িয়ে দিতে হবে প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি দিবসে। আমাদের যাপিত জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত নিরূপিত হোক শুদ্ধ শব্দ উচ্চারণে পরম মমতায় ভাষার চর্চায়।
আলো চাই আলো। এক চিলতে আলো থেকে বেরিয়ে আসুক সোনালি সকাল। সম্প্রীতির মলাটে, সৌহার্দ্যরে বর্ণমালায়, সহাবস্থানের শব্দ চয়নে রচিত হোক সম্ভাবনার বাংলাদেশ। এবারের একুশের কাছে রইল এমন প্রত্যাশা।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক বাংলা বিভাগ, শহিদ মামুন মাহমুদ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, পুলিশ লাইন্স, রাজশাহী।