মঙ্গলবার, ৮ জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৪ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ ।
সামসুল ইসলাম টুকু:
যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মায় না। গুরুত্বপপূর্ণ এই বাক্যটি আমাদের দেশের প্রখ্যাত ভাষাবিদ ও গবেষক ড, মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলে গিয়েছেন। আজকের সমাজে সেই বাক্য বা উক্তিটি ভীষণ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। আমাদের সমাজ থেকে নীতি নৈতিকতা এবং সামাজিক মূল্যবোধ ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। গুণিজনদের আমরা বিভিন্ন কৌশলে, বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বিতর্কিত করছি, একইসাথে নিজেদের বিভক্ত করছি। এটাই হচ্ছে বর্তমানে আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য।
গুণী মানেই এই নয় যে, তাকে সর্বগুসম্পন্ন হতে হবে। গুণিজনদের কী কী বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে? সমাজে এর ব্যাকরণ কী? আমার জানা নেই। তবে আমার ধারণা, একজন মানুষ ভালো লেখক হতে পারেন, ভালো গায়ক হতে পারেন, নাট্যকার হতে পারেন, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী হতে পারেন, দানশীল, পরপোকারী হতে পারেন, নির্ভিক, সত্যবাদী, প্রতিবাদী হতে পারেন। এমন অসংখ্য গুণের মধ্যে যদি কারো মাত্র একটি গুণ থাকে তাকে তো গুণিজন বলাই যেতে পারে। তাকে অন্ততপক্ষে ওই সম্মানটুকুই দেই। কিন্তু আমারা সেটাও মানতে রাজি নই। আমার মনের মত হতে হবে তাহলেই গুণিজন বলবো, অন্যথায় বলবো না। এ দ্বন্দ্ব আমাদের সমাজে চালু আছে। জানিনা অন্য দেশে চালু আছে কিনা। তবে পাশ্চাত্য দেশগুলোতে যোগ্যতাকে, গুণকে সম্মান করে, যথাযোগ্য স্থানে আসীন করে। আমরা কোনো গুণকেই সম্মান দিতে জানি না।
কোনো প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিতে রাজি নই। এমনকি তার ত্রুটিগুলির সমালোচনা করে গুণটুকুর প্রশংসা করি। সেটা করতেও আমরা প্রস্তুত নই। শুধু তাই নয়, অনেকগুণের অধিকারী হলেও তাকে সম্মান শ্রদ্ধা জানাতে চাই না, যাই না। আর যদি জানাতে চাইও তাহলে তার মৃত্যুর পরে। এই সংস্কৃতি হয়তো আমাদের বদলে দিতে পাওে, তাই সাম্প্রতিককালের একটি ছোট্ট ও ব্যতিক্রমি ঘটনা তুলে ধরি। তাহলে আমাদের বিদেশে যেতে হবে না। গত জুন/২৫ মাসে ফেনী সেন্ট্রাল হাইস্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের অবসরপ্রাপ্ত পরিচ্ছন্ন কর্মী শ্রী সন্তোষলালকে এক রাজকীয় বিদায় জানিয়েছেন। উপহার হিসেবে নগদ ৪ লাখ টাকা এবং আসবাবপত্রসহ কিছু উপহার দেওয়া হয়েছে। তাকে কারে করে শহরে ঘোরানো হয়েছে। এতে সন্তোষলাল যেমন সম্মানিতবোধ করেছেন, তেমনি যারা বিদায় জানিয়েছেন তারাও হৃদয় থেকে অনুভব করেছেন অন্তত একটা মহান কাজ করেছেন।
একজন গুণী তার জীবদ্দশায় সম্মান আশা করে। মৃত্যুর পরে তা অর্থহীন। তবে সমাজ রক্ষা হয়। সমাজকে জানানো হয়,” আমরা ভুলি নাই “। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা না দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে আমাদের দেশে। এর অর্থ এই নয় যে গ্ণুীর মৃত্যুর পর তাকে স্মরণ করা যাবে না। যে কোনো সময়েই তাকে স্মরণ করা যেতে পাওে, তার কীর্তিকে মানুষের কাছে তুলে ধরা যেতে পারে। তবে মৃত ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা বা সম্মান জানানো যায় কিনা তা আমার জিজ্ঞাসা। আর একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে যেন গুণিজনের অর্থনৈতিক অবস্থা, জন্মপরিচয় ও ধর্ম পরিচয় বিবেচনায় না আনি। এছাড়া তিনি আন্তর্জাতিক বা জাতীয় ব্যক্তি হবেন এমন নয়, তিনি আঞ্চলিক এমনকি গ্রাম পর্যায়ের মানুষ হতে পারেন। এই শ্রদ্ধা সম্মান দেওয়া স্মরণ করার দায়িত্ব পালন করেন দেশের বুদ্ধিজীবীরা। খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষদের কাজ নয় এটি। যখন গুণিজনের স্থানটা শূন্য হয় তখনই বুদ্ধিজীবীদের হুঁশ হয়, মূল্যায়ন করতে বসি। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গুণিজনের মৃত্যুর পরে। একজন গুণী তার জীবদ্দশায় শ্রদ্ধা, সম্মান, সমাদর পায় তাহলে তিনি নিজেকে গর্বিত মনে করতে পারেন, আত্মসুখ অনুভব করতে পারেন, প্রফুল্ল থাকতে পারেন, সমাজের কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে পারেন এবং আমৃত্যু স্মরণ রাখতে পারেন।
অন্যদিকে যারা শ্রদ্ধা সম্মান দিবেন তারাও আত্মসুখ অনুভব করতে পারেন। আক্ষেপ ুক্ত থাকতে পারেন এবং একটি ভালো কাজ করেছেন বলে দাবিও করতে পারেন। আর এ চর্চা অব্যাহত রাখলে পরবর্তী প্রজন্ম তা অনুসরণ করবে, রপ্ত করবে। এই সম্মাবোধ যত বিকশিত হবে, তত হীনমন্যতা দূর হবে আমাদের মন থেকে, সামাজিক ঐক্য সুদৃঢ় হবে, সম্পর্কগুলো মধুর থেকে মধুরতর হবে। আসুন, আমরা ভেদাভেদ না করে গুণী মানুষকে সমাদর করি, সম্মান জানাই এবং এই চর্চসাকে অব্যাহত রাখি। অন্যকে প্রভাবিত করি- এই চর্চাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। এজন্য বিশাল অডিটরিয়ামে আলোচনা সভার আয়োজন করতে হবে তা জরুরি নয়। সেটা ছোট্ট ঘরে হতে পারে, খোলা মাঠে হতে পারে। প্রয়োজন শুধু সব শ্রেণির বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতি। যেন বিষয়টা সমাজ জানতে পারে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ একটি সীমান্তবর্তী পশ্চাদপদ জেলা শহর হলেও গুণী মানুষ রয়েছে অগনিত। নাম বলে শেষ করা যাবে না। তারা শিক্ষা দীক্ষা ও জ্ঞানে সমৃদ্ধ, তারা চাপাইনবাবগঞ্জের সম্মান, সম্পদ, গর্ব। তারা যেমন আছেন জাতীয় পর্যায়ে তেমনি আছেন জেলা পর্যায়ে। তাদের ত্যাগ পরিশ্রম অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। এমন একজন গুণী ব্যক্তি গোলাম রাব্বানী তোতা। বর্তমান বয়স ৭৬ বছর। অসুখ বিসুখ ও বার্ধক্য নিয়ে গৃহবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। বাইরে তেমন আসেন না। ফর্সা, লম্বা, নায়োকচিত চেহারা, গম্ভীর কন্ঠস্বর নিয়ে সবার চাইতে আলাদা। দূর থেকেই তাকে চেনা যায়। আপদমস্তক তিনি একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। জ্ঞান হওয়া অবধি তাকে সেভাবেই দেখে আসছি। স্বাধীনতার আগে ও পরে অন্ততপক্ষে ৩০টি নাটক লিখেছেন, মঞ্চস্থ করেছেন বিডি হলে, নিজে অভিনয় করেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন। খুশি করেছেন হাজারো দর্শককে।
স্বাধীনতার পরে একটি নাটক মঞ্চস্থ করার পর বিডিআর ক্যাম্প থেকে ডেকে পাঠানো হয়। তিনি মনে করেছিলেন, উইং কমান্ডার নাটক দেখে মুগ্ধ হয়েছেন তাই ডেকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু কমান্ডারের অকথ্য ভাষায় গালাগালি ও একইসাথে বেঁতের বাড়ি খেয়ে বুঝতে পারলেন নাটক দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। ভাগ্যে তার অনেক মারই হয়তো ছিল কিন্তু জনৈক জনপ্রতিনিধির উপস্থিতি তাকে বাঁচিয়ে দেয়। সেদিনের সেই বিভৎস স্মৃতি আজও তিনি ভুলতে পারেননি। সেদিনের এই চরম অন্যায়ের প্রতিকার তিনি পাননি। কারণ, আমাদের দেশের রাজনীতি, সমাজ অন্ধ বধির এক্ষেত্রে। দেশে মঞ্চ নাটকের সুনাম ও খ্যাতি থাকলেও রাজনৈতিক কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। তার আসর পড়ে চাপাইনবাবগঞ্জেও। ফলে, তোতা নাটকের জগত ছাড়তে বাধ্য হন। পরে বেশ কিছুদিন তিনি জেলা শিল্পকলা একাডেমির নাটক প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি কিছুদিন হার্ডওয়ারের ব্যবসা করেন। কিন্তু ব্যবসা তাকে ধরে রাখতে পারেনি। ব্যবসা ছেড়ে তিনি পূনরায় সাংস্কৃতিক জগতে ফিরে আসেন। তবে একটু ভিন্ন পরিসরে। সাহিত্য জগতে। ভাবলেন, সাহিত্য বলয় তৈরি করি। লেখার মাধ্যমে লেখক সৃষ্টি করি। যোগাযোগ শুরু করলেন নতুন নতুন মানুষের সাথে। উৎসাহিত করেন বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষদের।
যারা কোনোদিন লেখেননি তাদের সাথেও। স্কুল কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা এগিয়ে এলো। লেখা সংগ্রহ হলো।প্রুফ দেখলেন, সম্পাদনা করলেন, ২/৪ জন লেখককে সাথে নিয়ে দ্বারে দ্বারে গিয়ে অর্থ সংগ্রহ করলেন। বই ছাপানো হলো। এবার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করতে হবে, সেদিন লেখকদের আপ্যায়ন করতে হবে, শিশুদের জন্য লটারি করে উপহার দিতে হবে, আমন্ত্রণপত্র পৌছাতে হবে, লেখকদের বই পৌঁছে দিতে হবে। এসব তিনি একাহাতে করতেন। তাকে ক্লান্ত হতে দেখিনি কখনো। প্রতিটি মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে কমপক্ষে ২৫/৩০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা জানাতেন। একইভাবে ২২/২৩ বছরে ৬৫ টি সম্পাদনা করেন।
অর্থ সংগ্রহ ছিল সবচেয়ে কঠিন কাজ। কিন্তু সেটাও তিনি করেছেন প্রচন্ড ধৈর্যের সাথে, লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে বার বার একই লোকের কাছে গিয়ে। কোনো ক্লেশ বোধ করেননি। সবগুলো বই ছিল মানসম্মত, পড়ার মত। এভাবে তিনি শতাধিক লেখক সৃষ্টি করেছন তা বলাই যায়। সর্বশেষ প্রফেসর এলতাস উদ্দিনকে নিয়ে স্মরনীয় গ্রন্থটি তিনি সম্পাদনা করেন। মফস্বল শহরে এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমি ও প্রশংসনীয়। আর একক ব্যক্তি কর্তৃক এতগুলো বই সম্পাদনার কথা আমার জানা নেই। এত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি নিজের ৭টি বই লিখেছেন ইতিহাস ভিত্তিক। রোজার তাৎপর্য নিয়ে তিনি একটি শর্ট ফিল্ম তৈরি করেন। শুটিং করেন নিজে থেকে। যা স্থানীয়ভাবে প্রশংসিত হয় । তার লেখা নাটকও বেতারে প্রচারিত হয়।
এমন একজন গুণী প্রতিভাধর ব্যক্তির আজও কোনো মূল্যায়ন হয়নি। তার কোনো সংগঠন ছিল না, তিনি একাই সংগঠন। তার অসুস্থজনিত কারণে গত দুবছর যাবৎ কোনো বই প্রকাশ হচ্ছে না। অন্য কোনো সংগঠন এমন উদ্যোগই নিতে পারেনি অদ্যবধি। আগামিতে পারবে কিনা বলা যায় না। এ সংকট কাটবে বলে মনে হয় না। তোতার অনুপস্থিতিতে অদূর ভবিষ্যে লেখার এই অঙ্গনটি আদৌ গতি পাবে কিনা তাতে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ, কাজটি বড় কঠিন। এখানে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য সংগঠন রয়েছে তারাই এতদিন পারেনি আগামিতেও পারবে না। তোতার মত গুণী ও গতিশীল মানুষ আগামী কয়েক যুগেও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বলিষ্ঠ অবদান রাখার জন্য তার জীবদ্দশায় তিনি সম্মান, যথার্থ মূল্যায়ন ও পুরস্কৃত হওয়ার দাবি রাখেন ।
লেখক -সাংবাদিক