বৃহস্পতিবার, ২২ মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ ।
ড. ইমরুল কায়েস তপন
রাজশাহীর শিল্পকলার জগতে উজ্জ্বল এক নাম শিল্পী আশফাকুল আশেকিন (বুলু)। চিত্রকলা, প্রচ্ছদ-অলংকরণ, পোস্টার, ব্যানার, ফোল্ডার, মঞ্চ সজ্জা, কাপড়ে ব্রাশ পেইন্টিংসহ শিল্পকলার বিভিন্ন শাখায় রয়েছে তাঁর সফল বিচরণ। ছবি আঁকার পাশাপাশি তিনি সাহিত্য চর্চাও করছেন দীর্ঘদিন ধরে।
শিল্পী আশফাকুল আশেকিন ১৯৪৪ সালের ৫ নভেম্বর রাজশাহী মহানগরীর হেতেম খাঁ-এ জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মো. ইয়াসিন ও মাতা খোররামন নেছা। শৈশবে তিনি ও তাঁর যমজ ভাই আনোয়ারুল আবেদিন অধ্যাপক এবনে গোলাম সামাদের কাছে প্রথম ছবি আঁকার পাঠ গ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালে লোকনাথ হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি তৎকালীন ‘ইস্ট পাকিস্তান কলেজ অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস’-এ ভর্তি হন ( শিক্ষাবর্ষ: ১৯৬৩-৬৪) এবং সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে ১৯৬৭ সালে বাণিজ্য বিভাগ (গ্রাফিক ডিজাইন) থেকে বিএফএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
ছাত্রজীবনে সফিউদ্দিন আহমদ, হাশেম খান, কাইয়ুম চৌধুরী ও হবিবুর রহমানের মত গুণী শিল্পীদের সান্নিধ্য পেয়েছেন তিনি। কাইয়ুম চৌধুরী হাতে ধরে শিখিয়েছেন ইলাস্ট্রেশন, পোস্টার, লেটারিং সহ বিভিন্ন বিষয়৷ ১৯৬৭ সালে ‘৫ম বার্ষিকী পুষ্প প্রদর্শনী’ শিরোনামে পোস্টার চিত্র এঁকে তিনি বার্ষিক শিল্পকলা প্রদর্শনীতে মাধ্যম শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করেন। ছাত্রজীবনে করা তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য পোস্টারের শিরোনাম ‘VISIT EAST PAKISTAN’।
লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে শিল্পী আশফাকুল আশেকিন রাজশাহীতে ফিরে আসেন। এই সময় তিনি প্রায় চার মাস ‘সাইমুম আর্ট’-এ কমার্শিয়াল কাজসহ কাকলি ললিতকলা একাডেমিতে ছবি আঁকা শিখিয়েছেন। এছাড়া কাঠখোদাই মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণার কাজও করেছেন বিভিন্ন সময়। তাঁর চাকরি জীবনের সূচনা ১৯৬৯ সালে পিটিআই, রাজশাহীতে প্রশিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে। চাকরি প্রাপ্তির কয়েক মাস পরে তিনি সিভিল ডিফেন্স অফিসে লোকাল জেনারেল ইন্সট্রাক্টর হিসেবেও ট্রেনিং প্রাপ্ত হন। এরপর ১৯৭৭ সালে নওগাঁ পিটিআই-এ বদলি হন। ১৯৮১ সালে তিনি সরকারি প্রমথনাথ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে চারুকলার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং ২০০১ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
শিল্পী আশফাকুল আশেকিনের শিল্পী জীবনের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে প্রচ্ছদ ও অলংকরণচিত্র। পোস্টার রঙ, চাইনিজ ইংক, কালিকলম ও জলরঙের ছোঁয়ায় উদ্ভাসিত তাঁর গ্রন্থচিত্র। পাশাপাশি প্রচ্ছদের শিরোনাম ও অলংকরণচিত্রের হেডিং লিখতে কখনো তিনি ব্যবহার করেন নিজস্ব শৈলীর লেটারিং। শিল্পীর করা প্রচ্ছদ ও অলংকরণ সংবলিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকা ও গ্রন্থের শিরোনাম হলো-‘ধানশালিক’ ( প্রকাশক: শিশু একাডেমি, রাজশাহী, ১৯৮৯), ‘ভুবনডাঙ্গার পাখ-পাখালী’ (লেখক: শামসুল হক কোরায়শী, প্রকাশকাল: ২০০৯), ‘মা আমার ছড়ার বই’ (লেখক: মোহাম্মদ আলী, প্রকাশকাল: ২০১৬), ‘ঋত্বিক কুমার ঘটক: এক বিরলপ্রজ প্রতিভার নাম’ (লেখক : ফজলুল হক, প্রকাশকাল: ২০১৭), ‘আমিও ফড়িং তুমিও ফড়িং’ (লেখক: মাসুম আওয়াল, প্রকাশকাল: ২০১৮), দৈনিক সোনার দেশ (ইদ সংখ্যা, ২০১১-২০২৪) ইত্যাদি।
শিল্পী আশফাকুল আশেকিন জলরঙ মাধ্যমে এঁকেছেন বাংলার প্রকৃতি ও তার নানা অনুষঙ্গ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমাদের দেশের প্রকৃতি জলরঙ চর্চার পক্ষে বিশেষ উপযোগী। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বলেন, ‘বাংলাদেশ Water Colour-এর দেশ। এর মাঠে-ময়দানে, নদী-নালায়, পুকুরে-ডোবায়, প্রকৃতি আর পানিতে রঙ-এর বিচিত্র লুকোচুরি। জলের দেশে জলরঙ হবে না তো আর কোথায় হবে?’ শিল্পী আশফাকুল আশেকিন শিক্ষাগুরুর এই কথাগুলোকে গভীরভাবে আত্মস্থ করে রঙ-তুলিতে ফুটিয়ে তুলেছেন নদী-নৌকা, গাছ, ফুল, কাদা- মাটি, কর্মরত মানুষ ইত্যাদির ছবি।
২০১৭ সালে এঁকেছেন স্নানারতা দুই নারীর ছবি। ২০১৮ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাঁশি’ কবিতা অবলম্বনে আঁকা ছবির বিষয়বস্তু কয়লা চালিত রেলগাড়ি, ঘোড়াগাড়ি, ভাঙা দোতলা বাড়ি, বাঁশি বাজানোরত পুরুষ, নারী ইত্যাদি। ২০২০ সালে আঁকা একটি ছবিতে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন রাজশাহী পোস্টাল একাডেমির ‘রানার’ ভাস্কর্য ও ফুল বাগানের দৃশ্য।
শিল্পীর তেলরঙ মাধ্যমে আঁকা ছবির বিষয়বস্তু জেলেপাড়া, নারী- পুরুষ ফিগারের সমন্বয়ে করা অবসর, জড়জীবনসহ বিভিন্ন বিষয়। ২০১৯ সালে এঁকেছেন শব্দ সৈনিক ও তাঁর যমজ ভাই প্রয়াত আনোয়ারুল আবেদিনের প্রতিকৃতি চিত্র। তাঁর রঙ-তুলি কখনোবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ারও। ২০১৬ সালে বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে আঁকা নিরীক্ষাধর্মী চিত্রে ফুটিয়ে তুলেছেন শিশু নির্যাতনের করুণ কাহিনী।
শিল্পী এক্রেলিক মাধ্যমেও ছবি আঁকেন। এ প্রসঙ্গে নিসর্গ, ডালিয়া ফুল, গাঁদা ফুল, ‘বিশীর্ণ পদ্মা’,কীর্তন’সহ বিভিন্ন ছবির কথা বলা যায়। এছাড়া শাড়ি কিংবা গায়ের চাদরে এক্রামিন রঙে করা তাঁর ব্রাশ পেইন্টিংগুলো এককথায় অনবদ্য।
শিল্পী আশফাকুল আশেকিন বাস্তবধর্মী ধারায় ছবি আঁকেন এবং তাঁর ংঃুষব বা শৈলী একান্তই নিজস্ব। ছবি আঁকায় জলরঙ তাঁর বরাবরই প্রিয় মাধ্যম।শিল্পী বলেন, “জলরঙ বুঝি তাই করি, যখন তা করতে পারিনা সহজে, তখন বিমূর্ত বা বিভিন্ন রঙের ইফেক্ট নিই।”
শিল্পী ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের পূর্বে রাজশাহীতে তৎকালীন মণিবাজার টাউন হল (বর্তমানে জেলা পরিষদ মিলনায়তন)-এ অনুষ্ঠিত চিত্র প্রদর্শনীতে অংশগ্রহন করেন। উল্লেখ্য, প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। ১৯৬৯ সালে কাকলি ললিতকলা একাডেমি আয়োজিত শিল্পী এম এ কাইউমের সাথে যৌথ চিত্রপ্রদর্শনীসহ ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে বরেন্দ্র আর্ট সোসাইটি আয়োজিত চিত্র প্রদর্শনীতেও অংশগ্রহন করেন তিনি। চারুকলায় অবদানের জন্য জেলা শিল্পকলা একাডেমি, রাজশাহী তাঁকে ‘Honourable National Award Fine Arts-2013’ প্রদান করে।
শিল্পী আশফাকুল আশেকিন বেড়ে উঠেছেন শিক্ষিত, সমাজ-রাজনীতি সচেতন ও সংস্কৃতমনা পরিবারে। ফলে অল্প বয়সেই তাঁর মধ্যে দেশপ্রেম ও সাংস্কৃতিক চেতনার বোধ জাগ্রত হয়েছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মাতৃভাষার জন্য আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার উপর পুলিশ গুলি চালালে শহীদ হন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেকে। এর প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে ভাষা সৈনিক মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জীর নেতৃত্বে প্রথম প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নেন শিল্পী আশফাকুল আশেকিন। তখন তিনি তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। আবার রঙ-তুলির মাধ্যমে সামাজিক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদমুখর হয়েছেন যা ইতঃপূর্বে আলোচনায় জেনেছি। তিনি বিশ্বাস করেন, মানুষ কেবলমাত্র শুদ্ধ হতে পারে আপন সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে পরিমন্দ অবগাহন করে।
আর সেই সাংস্কৃতিক সুবাতাস ছড়িয়ে দিতেই ১৯৭৮ সালে রাজশাহী চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় (বর্তমানে চারুকলা অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮১ সালে গিটারশিল্পী শাহাদৎ আলি বাদশা ও শিল্পী এমএ কাইউমকে সাথে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘শিল্পাশ্রম ললিতকলা একাডেমি।’ তাঁর নিবিড় সান্নিধ্যে শিশুরা এখানে ছবি আঁকা শেখে। এছাড়া ২০১১ সালে উপমহাদেশের প্রখ্যাত বেহালাশিল্পী পণ্ডিত রঘুনাথ দাস স্মরণে প্রকাশিত ‘তোমার আসন শূন্য আজি’ গ্রন্থের উপদেষ্টার দায়িত্বও পালন করেন তিনি।
শিল্পী আশফাকুল আশেকিন ১৯৬৩ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন হাসনা হেনা আশেকিনের সাথে। তাঁদের তিন সন্তান-চিত্রশিল্পী ড. হাসান আশিক, রুবাইয়াৎ ই আশিক ও শারমিন আশিক। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন ড. হাসান আশিক ও শারমিন আশিক। রুবাইয়াৎ ই আশিক সচিব হিসেব কর্মরত রয়েছেন।
সুশিক্ষা ও সুস্থ শিল্পকলা চর্চার মাধ্যমে সুন্দর জীবন ও সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেন শিল্পী আশফাকুল আশেকিন। সৎ- নির্ভীক এই মানুষটি আশি বছর বয়সেও নিরলসভাবে ছবি এঁকে চলেছেন। তাঁর এই পথচলা আরো দীর্ঘ হোক, আরো সমৃদ্ধ হোক আমাদের শিল্পাঙ্গন।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক (প্রতিষ্ঠাতা প্রভাষক)
রাজশাহী চারুকলা মহাবিদ্যালয়।
আলোকচিত্র : শাহেদ হোসেন শিখন