মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৪ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
সোনার দেশ ডেস্ক
দিনের পিঠে চলে গেছে আরেকটা দিন। বদলে গেছে শহরের চেহারা। রদ-বদল এসেছে রীতি-নীতিতে। চোখের সামনে দেখেছেন সংঘাত- সৌহার্দ্য। কিন্তু তার রুটিন খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনের গেইট। রোজকার একটা নির্দিষ্ট চিত্র যেন আঁকা থাকে। চারুকলা অনুষদের সামনে দিয়ে যারা শাহবাগ থেকে টিএসটির দিকে হেঁটে গিয়েছেন তারা শুনে থাকবেন ‘এই ঝাল পেটিস…’। সবমিলিয়ে না হোক, ওখানকার পরিবেশ-প্রতিবেশ এই শব্দটা শুনেছে বহুবার। এই শব্দগুলো কতবার কণ্ঠনালী বেয়ে ঝরেছে তার ঠিক নেই। কিছু সময় পর এই শব্দগুলো বলে ওঠেন। এই যেন তার নিত্যদিনের গান। আর সময়ের ছন্দ।
তার নাম আব্দুল লতিফ। পেশায় পেটিস বিক্রেতা। টিনের একটি ছোট বাক্স তার সঙ্গী। ওই বাক্সটি ভরে রোজ পেটিস নিয়ে আসেন লতিফ। বিক্রি শেষ হলে খালি বক্স নিয়ে ফিরে যান নিজের ভাড়া বাসায়। আর মাত্র কয়েক মাস পরই ২০ বছর পূর্ণ হবে লতিফের এই নিয়মের।
আব্দুল লতিফের বাড়ি বরিশালে। চালের ব্যবসা-আর সংসারের কাজকর্ম নিয়ে বেশ চলে যাচ্ছিল দিন। সংসারে- দুই-ছেলে, এক মেয়ে, স্ত্রী আর নিজেকে নিয়ে ভালোই যাচ্ছিল সময়। কিন্তু ব্যবসায় বড় ধরণের লোকসানে পড়তে হয় তাকে। তারপর সংসারের ছায়ার মতো নেমে আসে দারিদ্রতা।
কিন্তু চাইলেই গ্রামে যে কোনো কাজ করতে পারছিলেন না আব্দুল লতিফ। কিন্তু চোখের সামনে সেই নিকট অতীতে ফেলে আসা স্মৃতির আনাগোনা। এই সুখ ফেরাতে চান তিনি। যে কোনো মূল্যে নয়, সঠিক পথে সঠিক উপায়ে আয় করেই কাজটি করতে চান।
এক প্রতিবেশীর পরামর্শে তার সঙ্গে ঢাকায় আসেন লতিফ। সে লতিফকে সঙ্গে নিয়ে যান চানখারপুল। সাথে নিয়ে আসা স্বল্প পুঁজিতে শুরু করেন নতুন ব্যবসা।
এক বিকেলে কথা হলো আব্দুল লতিফের সঙ্গে। কথা বলার জন্য একটু সময় চেয়ে নিলাম। একটা ঝাল পেটিস খেতে খেতে চলল গল্প। আব্দুল লতিফের গল্প নিভৃতে জীবনের বীজ বপন করে যাওয়ার গল্প। গল্পের শেষে একটা অনিশ্চয়তা আছে বলে মনে হয়। পাঠক আপনারও মনে হতে পারে। কিন্তু আব্দুল লতিফ ঠিক সারা জীবনের সঞ্চয় বলতে সন্তানদের শিক্ষিত করে তুলেছেন । এই যে শহরে দীর্ঘদিন ধরে আছেন। বিভিন্ন সময় হয়তো অসুস্থ্যও হতে হয়, কী করেন তখন?
‘অসুস্থ হবো কেন, আল্লার রহমত। আমার আল্লায় দিলি জ্বরও হয় না। এখন শরীরের বল আগের চেয়ে কমে আইছে।’ এরপর কি করবেন বলে ঠিক করেছেন?
‘বড় পোলা চাকরি পাইলেই যাবো।’ এই ব্যবসা করে তিনি যে সঞ্চয় করেছেন তার হিসাবটা টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বড় ছেলে মাস্টার্স পড়ছে। মেয়ে এইচএসসি পরীক্ষা দেবে আর ছোট ছেলে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। আব্দুল লতিফের স্বপ্ন তারা চাকরি করবে। এরপর কাজ থেকে অবসরে যাবেন তিনি।
ঝাল পেটিস বিক্রি শুরু করেছিলেন ৩টাকা করে। পড়ে ৫টাকা তারপরে ৮টাকা এখন প্রতিটি পেটিসের দাম দশ টাকা। চোখের সামনে বদলে যেতে দেখেছেন, এই শহরের চেহারা। দিনে দিনে মানুষ বেড়েছে। অপরিচিতদের ভেতরে কেউ কেউ হয়ে উঠেছেন একান্ত পরিচিত। যাদের অনেকে আব্দুল লতিফের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, যখন অস্থির হয়ে উঠেছে এই শহর। রাজপথের রাজনৈতিক সমস্যা আব্দুল লতিফকে খুব স্পর্শ করতে পারেনি। পারেনি ওই অনুষদের শিক্ষার্থীদের জন্যই। তিনি যে কারো চাচা আবার কারও দাদা।
হরতাল অবরোধের সময় তার গেইটের সামনে নয় ভেতরে বসার সুযোগ হয় আব্দুল লতিফের। অনেকের নাকি ছোট ছোট আবদারও আছে তার কাছে। এই যেমন- কেউ রিকশায় চড়ে ক্যাম্পাসে এলো কিন্তু ভাংতি টাকা নেই। এসে সোজাসুজি কথা দচাচা টাকা দেন তোদ। আর আব্দুল লতিফও দিয়ে দেন।
এই লেনদেনের সম্পর্ক আরও গভীরে। মাসে একবার বাড়িতে যান লতিফ। কখনো কখনো বাড়তি টাকার দরকার হয়। এই শিক্ষার্থীরাই নাকি পাঁচশ থেকে এক হাজার টাকা ধার দেন। সময় মতো পরিশোধ করে দেন লতিফ।
কিন্তু সব কিছুর তো আর শোধ হয় না। এখানে যারা পড়তে আসে তাদের সংখ্যা অনেক। আব্দুল লতিফ একা। তার একার পক্ষে সবার নাম-ধামতো আর মনে রাখা সম্ভব হয় না। দেখা না হওয়ার দীর্ঘ বিরতও রচনা হয় অনেকের সঙ্গে। আব্দুল লতিফ জানান, প্রতিদিন দুপুর একটায় চলে আসেন চারুকলা অনুষদের সামনে। রাত দশটা বা এগারোটা পর্যন্ত চলে পেটিস বেঁচা-কেনা।
আর জীবনের পড়ন্ত বেলায় সারা জীবনের সঞ্চয় থেকে আদর-ভালোবাসা আর বিশ্বাসের সোনারোদ পোহাতে চান। সময় বলবে কে জিতেছে! তবে আশাহত হয়ে দুঃস্বপ্নকে নিজের চিন্তায় থাকতে দিতে রাজী নন আব্দুল লতিফ। রাইজিংবিডি