সোমবার, ২০ মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ৬ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
৬ আগস্ট ১৯৯৩ সাল, না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আফছার ব্যাটলিয়ানের প্রতিষ্ঠা ও কমা-ার মেজর আফসার উদ্দিন আহামেদ। মেজর আফসার এক কিংবদন্তী বীর পুরুষ। বৃটিশ পরাধীন উপমহাদেশে তার জন্ম। পরাধীনতার শিকলের নাগ পাশ থেকে নিজের মাতৃভূমিকে মুক্ত করা অভিলাষ তার কিশোর বয়স থেকে। উপনিবেশিক বৃটিশ শাসকের অধীন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। বৃটিশরা এদেশে শাসনের নামে যে শোষণ করছে তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সেনাবাহিনীতে কাজ করা অবস্থায়। বৃটিশের প্রতি ঘৃণা শ্লেষ এবং বিদ্বেষ থেকে প্রতিবাদ করে তরুণ বয়সে বৃটিশের সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন। সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে আসেন নিজ গ্রাম ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার ধামশুর গ্রামে। বৃটিশ শোষক তা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন আর এই শোষককে বিতাড়িত করে আরেক জালিম গদিতে বসেছে তা বুঝতে মেজর আফসারের সময় লাগে নি। গণ মানুষের অধিকার আদায়ে তিনি নিজেকে ব্রত করেন। নিজ গ্রামের জনগনের সুখে দুঃখে তিনি তাদের পাশে দাঁড়ান। এলাকার মানুষ তার জনসেবায় মুগ্ধ হয়ে তাকে ইউপি মেম্বার নির্বাচিত করেন। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তিনি ছিলেন একজন বঙ্গবন্ধু ভক্ত। মেজর আফসারের মনের সুপ্ত বাসনা স্বাধীন মাতৃভূমি, সেই স্বাধীনতার স্বপ্ন তিনি দেখতে শুরু করেন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে। তিনি আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের একজন সংগঠক হিসাবে কাজ করতে শুরু করেন। ক্ষমতার মোহে নয় দেশ মাতৃকার মুক্তির লক্ষে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অংশ নেন। ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ভালুকা থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এবং ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি উজ্জীবিত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন তোমাদের যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রু মোকাবেলার জন্য প্রস্তত হও। মেজর আফসার সেইদিন বুঝতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিয়েছেন পাক হায়েনার সাথে সম্মুখ সমরে লড়তে তাই এই সমরে লড়তে একটি আগ্নেয়াস্ত্রের প্রয়োজন। তখনকার ভালুকা অঞ্চল ছিল এক নিভৃত পল্লী। এই নিভৃত পল্লী এলাকায় একটি আগ্নেয়াস্ত্র খবই দুসাধ্য ব্যাপার ছিল। তিনি সারা অঞ্চল তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকেন অবশেষে ভালুকা থানার রাজৈ গ্রামে আওয়ামীলীগ কর্মী মৌলভী মোহাম্মদ আবুল হামিদ এর কাছ থেকে একটি রাইফেল ও ৩০ রাউন্ড গুলি পেয়েছিলেন। তারপর তাকে আর পিছে ফেরে তাকাতে হয়নি। তাঁর অদম্য সাহস, দৃঢ় মনোবল দক্ষ নেতৃত্ব ও সাংগঠনিকতায় গড়ে তুলেন এক বিশাল সুশৃঙ্খল মুক্তি বাহিনী যার নাম ছিল আফসার ব্যাটেলিয়ান আর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল সাড়ে চার হাজার ।
মেজর আফসারের বাহিনীতে তার পরিবার ও নিকট আত্মীয়ের ১৯ জন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার সহধর্মীনি খায়রুন্নেছা আফসার ছিলেন যুদ্ধকালীন সময়ের তার অন্যতম সহযোদ্ধা। খায়রুন্নেছা আফসার শুধু তার পাশে থেকে অনুপ্রেরণা দেন নাই তিনি অস্ত্র হাতে লড়েছেন পাক সেনাদের বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সেদিন পুরো পরিবার নিয়ে মেজর আফসার যুদ্ধে নেমেছিলেন। মেজর আফসারের চারপুত্র সম্মুখ সমরে লড়েছিল, তাদের মধ্যে আফসার ব্যাটলিয়ানের সেকশন কমা-ার নাজিম উদ্দিন আহামেদ, কোম্পানি কমা-ার গাজী খলিলুর রহমান, সহকারী কমা-ার গাজী আলহাজ্ব খোরশেদ আলম, মো. শওকত আলী। এদের মধ্যে শহিদ হন নাজিম উদ্দিন। মুক্তিযুদ্ধে মেজর আফসারের আপন চার ভাই তার অর্ন্তভুক্ত ব্যাটেলিয়ানের যোদ্ধা হয়ে পাক হায়েনার বিরুদ্ধে লড়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন আফতাব উদ্দিন আহামেদ, আশ্রাফ উদ্দিন আহামেদ, আলা উদ্দিন আহামেদ, ইসমাইল উদ্দিন আহামেদ, মেজর আফসারের মেয়ের জামাই নুরুল আমিন ছিলেন ব্যাটলিয়ানের সহকারী কমা-ার। মেজর আফসারের সহধর্মিনী খায়রুন্নেসা আফসারে তিন ভাইও আফসার ব্যাটলিয়ানের সম্মুখ যোদ্ধা হিসাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তারা হলেন মতিউর রহমান, আব্দুর রহমান, আবুল হোসেন। মতিউর রহমান সম্মুখ যুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন। খায়রুন্নেসা আফসারের ভাইয়ের পাঁচ ছেলে আফসার ব্যাটেলিয়ানের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অংশ নেয় তারা হলেন, মো. মফিজ উদ্দিন, আশ্রাফ উদ্দিন, মো. আব্দুর রহমান , আবদুল মজিদ, আব্দুল বারেক। বাংলাদেশে এবং পরিবার বিরল যে পরিবারে সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তাদের মধ্যে দুজন শহিদ হয়েছিলেন। পিতার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু হচ্ছে নিজ পুত্রের কফিন বহন। পুত্রের কফিন বহন একজন পিতার কাছে কতটুকু বেদনা ও কষ্ট দায়ক, যিনি এই কাজটি করেছেন একমাত্র তিনি ব্যাতীত পৃথিবীর অন্য কেউ এই হৃদয় ব্যাথা উপলব্ধি করা অসম্ভব। কিন্তু এই অসম্ভবটি সাধন করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বীর সেনা মেজর আফসার উদ্দিন। ১৯৭১ এর রণাঙ্গণে মেজর আফসার এক হাতে নিজ পুত্রের লাশ কাঁধে বহন করে, অন্য হাতে তাঁর হাতিয়ার গর্জে উঠেছিল পাক হায়েনার বিরুদ্ধে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে শহিদ হন মেজর আফসার এর পুত্র শহীদ নাজিমউদ্দিন। পুত্র শোকে শোকাতুর পিতাকে সেইদিন স্তম্বিত, হতবাক, বিমুর্ষ হতে দেখা যায় নি। শোকের পাথর বুকে চেপে মেজর আফসার উদ্দিনের হাতিয়ার গর্জে উঠেছিল। পাক হায়েনার আক্রমণে শহিদ অসংখ্য পুত্রশোকাতুর পিতার প্রতিনিধি হিসাবে তাঁর শোক পরিণত হয়েছিল দ্রোহে।
মেজর আফসার ছিলেন সামরিক জ্ঞানে একজন দক্ষ যোদ্ধা। তিনি আফসার ব্যাটেলিয়ান গড়ে তুলেছিলেন সেনাবাহিনীর নিয়ম অনুযাযী, তাঁর নেতৃত্বাধীন সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ৫টি ব্যাটালিয়ানে ২৫টি কোম্পানিতে ভাগ করা হয়েছিল। আর প্রতিটি কোম্পানিতে ছিল তিনটি করে প্লাটুন, প্রত্যেক প্লাটুনে ছিল ৩টি করে সেকশান আর প্রতিটি সেকশানে ছিল ১৫জন করে মুক্তিযোদ্ধা। বিরল সুশৃঙ্খল মুক্তিবাহিনী তিনি গড়ে তুলেছিলেন নিজের মেধা, সাংগঠনিক ও দক্ষ নেতৃত্বে।
তাঁর এই বিশাল বাহিনী মুক্ত করেছিল ময়মনসিংহ জেলার দক্ষিণাঞ্চল তথা ময়মনসিংহ জেলার সদর উপজেলা, ত্রিশাল, ফুলবাড়িয়া, মুক্তাগাছা, গফরগাও, ভালুকা তৎকালীন ঢাকা দক্ষিণ বর্তমানে গাজীপুর জেলার গাজীপুর সদর, শ্রীপুর, কালিয়াকৈর, কাপাসিয়া, কালিগঞ্জ, টাঙ্গাইল জেলার সখিপুর, ঘাটাইল,মির্জাপুর উপজেলা ।
মেজর আফসার ছিলেন একজন অভিজ্ঞ সমর নেতা। তিন জনসম্পৃক্তার জন্য মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জাগ্রত বাংলা নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করে। এই এই গণমাধ্যমটি মুক্তি বাহিনীর সাফল্যের কথা জনগনের কাছে পৌঁছে দিতো। তাছাড়া তিনি একটি ভ্রাম্যমান হাসপাতাল গড়ে তুলেছিলেন। ভ্রাম্যমান হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেন করতো ১৩ জন ডাক্তার ও তিনজন নার্স। এই ভ্রাম্যমান হাসপাতালটি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন রণাঙ্গন এলাকার সাধারন মানুষদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হতো। মেজর আফসারে রণাঙ্গনের তার বাহিনীর বীরত্বের কথা ময়মনসিংহের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের অজানা নয়। এখনো ৬০ বা তৎদুর্ধ মানুষের কাছে মেজর আফসার রবিনহুড।
মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি অতি সাধারন জীবনযাপন করেছেন। পার্থিব মোহ তাঁকে তাঁর নৈতিক পথচলা থেকে বিচ্যুত করতে পারে নি কোনদিনও। মুক্তিযুদ্ধের সিংহ পুরুষটি যুদ্ধ পরবর্তী সোনার বাংলা গঠনের আত্মনিয়োগ করেছিলেন। সৌম্য, শান্ত প্রকৃতির মানুষটি মৃত্যুর পুর্বমুহুর্ত পর্যন্ত দাঁড়িছেন অসহায় মানুষের পাশে ।
১৯৭৫এর পট পরিবর্তনের পর তাকে আবারো লড়তে হয় স্বাধীনতা বিরোধী অসুরদের সাথে। ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু তৎকালীন জিয়ার সামরিক সরকার পুন:ভোট গনণার নামে প্রহসন করে তাঁকে পরাজিত এবং স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি মুসলিম লীগ প্রার্থী আফতাব উদ্দিনকে নির্বাচিত ঘোষণা করে। ১৯৯০ সালে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন বিপুল ভোটে কিন্তু বিএনপি সরকার এসে উপজেলা পরিষদ ভেঙ্গে দেয় ।
আত্ম প্রচার বিমুখ এই মহান ব্যাক্তিটি মুত্যুর পুর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত লড়েছেন স্বাধীনতা বিরোধী আলবদর আল সামস রাজাকারের বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানো এই অকুতভয় বীর কখনো তার প্রতিদান তিনি চান নি। তিনি বলতেন মাতৃভূমি মায়ের সমতুল্য তাই মাকে পাক হায়েনার হাত থেকে রক্ষা করেছি। এটা আমার দায়িত্ব। তবে ময়মনসিংহ-১১ আসনের মানুষের মণিকোঠায় মেজর আফসারের উজ্ঝল উপস্থিতি এখনো বহমান। অসাম্প্রদায়িক এই মানুষটি সকল ধর্মবর্ণের মানুষের কাছে ছিলেন প্রিয়পাত্র। ভালুকা অঞ্চলের আদিবাসীদের কাছে তিনি এখনও দেবতুল্য। রাজনৈতিক সংগঠনের বাইরে তার নিজস্ব একটি ভোট ব্যাংক ছিল যা এখনো তার পুত্র কাজিম উদ্দিন ধনুর পক্ষে রয়েছে। মেজর আফসার একজন ভয়হীন বীর। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের জীবনের প্রতি পরোয়া করে নি। নিজ পুত্র এর প্রাণ রণাঙ্গনে উৎসর্গ করে মুক্তিযুদ্ধে যে অনন্য অবদান রেখেছেন তারপরও তাকে রাষ্ট্রীয় খেতাব এ ভূষিত করা হয় নি। তিনি বলতেন খেতাবের চাইতে বড় কিছু পেয়েছি তা হলো মানুষের ভালবাসা। দক্ষিণ ময়মনসিংহের মানুষের কাছে মেজর আফসার এখনো একজন কিংবদন্তি বীর। মেজর আফসারের সহধর্মিনী খায়রুন্নেসা আফসার শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধাই নন, তিনি শহিদ জননী এবং শহিদের ভগ্নি। খায়রুন্নেসা আফসার মুক্তিযুদ্ধে তিনি হারিয়েছেন অনেক কিছু। জীবনের সায়াহ্নে এসে খায়রুন্নেসা আফসারের প্রত্যাশা জাতির জনকের কন্যা বর্তমানে সরকার প্রধান, তিনি এই আফসার মেজরের পরিবারটির মুক্তিযুদ্ধের অবদান টুকু মুল্যায়ন করবেন।
ভালুকা তথা সমগ্র দক্ষিণ ময়মনসিংহের মানুষের আশা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলটির বর্তমান সরকার মেজর আফসারের পরিবারেটির মুক্তিযুদ্ধের অবদান মুল্যায়ন করবে। লেখক: কলামিষ্ট