এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ

আপডেট: ডিসেম্বর ৯, ২০১৬, ১২:০১ পূর্বাহ্ণ

ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম


(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
৬০০ কোটি ডলারের মাইলফলক ছুঁয়েছে দেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল বা ইপিজেডগুলোর রপ্তানি আয়। ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে আট ইপিজেড থেকে মোট আয় এসেছে ৬৬৮ কোটি ডলার। এ আয় গত অর্থ বছরের তুলনায় ৯ শতাংশের বেশি। মোট জাতীয় আয়ে এসব অঞ্চলের অবদান এখন ২০ শতাংশ। রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) সূত্র জানায়, ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে চট্টগ্রাম ইপিজেডের রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি ২৪২ কোটি ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২১৮ কোটি ডলার আয় এসেছে ঢাকা ইপিজেড থেকে। কর্ণফুলী থেকে ৮২ কোটি ডলার, আদমজী থেকে ৫৬ কোটি, কুমিল্লা থেকে ৩১ কোটি, মংলা থেকে ৭ কোটি ৫০ লাখ, ঈশ্বরদী থেকে ১১ কেটি ৫০ লাখ ও উত্তরা ইপিজেড থেকে আয়ের পরিমাণ ছিল ১৯ কোটি ডলার। গত অর্থ বছরের তুলনায় ইপিজেডেই রপ্তানি বেড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরোর পরিচালক ড. শফিক উজ জামান এক প্রতিবেদনে (সমকাল ০২.১১.২০১৬) বলেছেন সদ্য সমাপ্ত ২০১৫-১৬ আর্থিক বছরে রপ্তানি আয়ের ৩৪.১৪ বিলিয়ন ডলারের ২৮ বিলিয়ন অর্থাৎ প্রায় ৮৩ শতাংশই অর্জন পোষাক শিল্প থেকে। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অর্থাৎ ১৯৭৩-৭৮  কালপর্বে জিডিপিতে রপ্তানি আয়ের অবদান ছিল গড়ে ৬ শতাংশের কাছাকাছি। এর মধ্যে কাঁচাপাট ও পাটজাত দ্রব্যের অবদান ছিল যথাক্রমে ৩২ ও ৫৪ দশমিক, যা একত্রে ৮৬ শতাংশ। ১৯৯০ সালেই রপ্তানিতে পোশাক শিল্পের অংশ ৫০ শতাংশ অতিক্রম করে এবং পাটজাতের অবদান ২২ শতাংশে নেমে আসে। গত এক দশক ধরে রপ্তানি খাতে পোশাকের অংশ ৭৫ শতাংশ এবং গত ৫ বছরে ৮০ শতাংশের উর্ধ্বে এবং পাট খাতের ৩ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করছে। জিডিপিতে রপ্তানি খাতের অবদান ক্রমেই বাড়ছে, যা বর্তমানে জিডিপির প্রায় এক পঞ্চমাংশের কাছাকাছি।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে পোশাক রপ্তানি সম্ভাবনা খাত হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। সত্তর দশকে রপ্তানি পণ্যের (পাটজাত দ্রব্যের) মূল্য সংযোজন ছিল প্রায় ৮৫ শতাংশ, আজ পোশাকের ওডেন ও নিটিংয়ের গড়ে ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ। তাছাড়া সত্তর দশকে মোট রপ্তানির প্রায় ৪০ শতাংশই আসতো কাঁচামাল থেকে। বিশেষ করে কাঁচাপাট থেকে। রপ্তানি খাত বলতে এখন শুধুই পোশাক শিল্প। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, শ্রীলংকা, ভারত, পাকিস্তান, ইথিওপিয়া আজ বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী। বর্তমানে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে। ভিয়েতনাম ও মিয়ানমারের গত বছর বিদেশি বিনিয়োগ যথাক্রমে ১৪ ও ৯ বিলিয়ন। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের মাত্র দুই বিলিয়ন, যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ। রফতানি প্রায় ৫৫ শতাংশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ২৫ শতাংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার কেন্দ্রিক। অর্থনীতিবিদদের মতে গত বছর তৈরি পোশাক খাতে শতকরা ১০ ভাগ প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। পাশাপাশি এ শিল্পখাতে শতকরা ৪০ ভাগ মূল্য সংযোজন হচ্ছে।
পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অংশ বাড়ছে। আগের বছরের ৫ দশমিক ১ শতাশ থেকে বেড়ে এ হার ২০১৫ সালে হয়েছে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। এতে করে তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় রপ্তানিকারক দেশের মর্যাদা অক্ষুণœ রয়েছে। তৈরি পোশাকের ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের বিশ্ব বাজারে বরাবরের মতো প্রধান রপ্তানিকারক এখন চিন। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডাব্লিউটিও) ‘বিশ্ব বাণিজ্য পরিসংখ্যান পর্যালোচনা-২০১৬’ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৫ সালে তৈরি পোশাকের বাজারে বাংলাদেশের অংশ আগের বছরের চেয়ে দশমিক ৮ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। তবে দীর্ঘদিনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম ও ভারতে অংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় তা হুমকি হয়েছে উঠেছে। ৪ শতাংশ থেকে ভিয়েতনামের অংশ বেড়ে হয়েছে ৪ দশমিক ১ শতাংশ। তবে মৌলিক মানের তৈরি পোশাক উৎপাদন থেকে কিছুটা সরে এলেও চিনের অংশ গ্রহণ আরও বেড়েছে। ৩৮ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে এ হার বেড়ে এখন ৩৯ দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গত মাসে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) চূড়ান্ত হিসেবে গত অর্থ বছরে বাংলাদেশে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। যা বিবিএস এর আগের হিসাবের চেয়ে বেশি। ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ৯ মাসের (জুলাই-মার্চ) তথ্য বিশ্লেষণ করে ব্যুরো বলেছিলো, বাংলাদেশে ৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ জিডিবি প্রবৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে। কিন্তু বিবিএস এর সর্বশেষ হিসেবে প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে ৭ দশকি ১১ শতাংশ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। চূড়ান্ত হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ১৭ লক্ষ ৩২ হাজার কোটি টাকা বা ২২১ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে খাদ্য নিরাপত্তা, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার, নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গ বৈষম্যদূরীকরণ, পোশাক ও রেমিটেন্স খাতে সাফল্য, কৃষি বিপ্লব, শিক্ষা ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য এখন বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে রীতিমত রহস্য। ঈর্ষান্বিত অনেক উন্নত দেশও। সামাজিক ও জীবনমানের সূচকে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। এটি শুধু আমরাই বলি না, বিশ্ব বরেণ্য ভারতীয় অর্থনীতিবিদ নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনও বলেন।
চলতি অর্থ বছরের প্রথম মাসে (জুলাই) রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে বলে জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থার তথ্যানুসারে, জুলাইয়ে আয়কর, শুল্ক, ও ভ্যাট খাতে মোট ৯ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৯ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮৮ কোটি টাকা বেশি সংগ্রহ হয়েছে। চলতি অর্থ বছরে এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এত বেশি প্রবৃদ্ধি অতীতে কখনোই ধরা হয়নি। এনবিআর বলেছে, চলতি অর্থ বছরের জুলাই মাসে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হার ১০০ দশমিক ৯২ শতাংশ, যা ২০১৫-১৬ অর্থ বছরের একই সময়ের রাজস্ব সংগ্রহের তুলনায় ১০ গুণ বেশি।
স্বাস্থ্য বিশেষ করে মাতৃমৃত্যু, শিশু মৃত্যু হার প্রসূতি সেবা খাতে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে রোল মডেল। বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী ‘ল্যানসেট’ তার সাম্প্রতিক সংখ্যায় বলেছেন, স্বাস্থ্য সেবায় বাংলাদেশের সাফল্য রহস্যময়। স্বাস্থ্য সেবায় কম বরাদ্দ, দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, পুষ্টিমানের দুর্বল কাঠামো সত্ত্বেও বিগত বছরগুলোতে স্বাস্থ্যখাতে বাংলাদেশের অর্জন ব্যতিক্রমি। শিশুর জীবন রক্ষা, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, টিকাদান, কিশোরী, প্রসূতি ও প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা, সার্বজনীন টিকাদানের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য আকাশচুম্বী।
খাদ্য নিরাপত্তায় বাংলাদেশ এ মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সব থেকে সফল রাষ্ট্র। এমডিজিতে বিশ্বব্যাপী ২০১৫ সাল নাগাদ ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছিল সে তালিকায় সাফল্যের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের ১১তম স্থানে। বাংলাদেশ এখন ফল উৎপাদনে সমগ্রবিশ্বের ১ম, সবজি উৎপাদনে ৩য়, সাধু পানির মাছ উৎপাদনে ৪র্থ, ধান উৎপাদনে ৪র্থ। শুধু ফল, সবজি, মাছ বা ধান নয় গম, ভুট্টা ও পোল্ট্রি শিল্পেও বাংলাদেশ এখন বৈশ্বিক গড় উৎপাদনকে পিছনে ফেলতে সক্ষম হয়েছে।
মেঘনা গ্রুপকে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের (ইপিজেড) চূড়ান্ত লাইসেন্স দিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) শুরুতেই বিনিয়োগ চূড়ান্ত হয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকার। এ বিনিয়োগ করছে চিনের এক প্রতিষ্ঠান ও মেঘনা গ্রুপ। এছাড়া ও দুটি চিনা প্রতিষ্ঠান ও চারটি দেশি প্রতিষ্ঠানকে কারখানা স্থাপনের জন্য আগামী সপ্তাহে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হবে। বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, মেঘনা গ্রুপ এরই মধ্যে সেখানে বিনিয়োগ করেছে। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি অঞ্চলগুলিকে সবধরনের সহযোগিতা করবে বেপজা। মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বলেন, চিনা প্রতিষ্ঠান চং কিং মিন মেটাল মেঘনা অর্থনৈতিক অঞ্চলে পিডিসি উৎপাদন কারখানায় ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। এ ছাড়া মেঘলা গ্রুপের পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলে ৮০০ কোটি, এমপিপি পাওয়ার প্লান্টেট ৩২০ কোটি ও মেঘলা এডিবল ওয়েলস্ রিফাইনারিতে ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে। এ তিনটি শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ এ অঞ্চলের উন্নয়নে তারা বিনিয়োগ করছেন ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক ও ইউনেস্কোর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে রীতিমতো শিক্ষা বিপ্লব ঘটে গেছে। সার্বজনিন গণসাক্ষরতা বিদ্যালয়, ছাত্র বৃদ্ধির হার, ড্রপ আউটের হার প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা, ছাত্র-ছাত্রীর সমতাসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ সূচকেই বাংলাদেশ এখন বিশ্বের জন্য দৃষ্টান্ত। ইউনেস্কোর হিসেব মতে, বিগত বছরে ৯৬% শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এখনকার বয়স্ক শিক্ষার হার ৫৯%। এবং এই সূচক ক্রমশ উর্ধ্বগামী। বছরের প্রথম দিনে কোটি শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই আজ শুধু বাংলাদেশেই নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য জ্বলজ্বলে একটি এগিয়ে যাওয়ার ফটোফ্রেম। বিশ্বে বাংলাদেশকে পরিচিত করার ক্ষেত্রে এক সময় সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিশ্ব দরবারে এখন বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রতিষ্ঠিত। ওয়ানডে, টেস্ট এবং টি-২০ তে বাংলাদেশের অবস্থান যথাক্রমে ৭ম, ৯ম ও ১০ম। মাত্র কয়েক বছরেই বিশ্বক্রিকেটে বাংলাদেশে সাফল্য অভাবনীয়।
সম্প্রতি পায়রা বন্দরসহ ৫ প্রকল্পের উদ্বোধন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন দেশকে শতভাগ বিদ্যুতায়িত করতে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। দেশের ৪৬৫টি উপজেলাকে খুব শিগগিরই শতভাগ বিদ্যুৎ দেয়া হবে। ১৩ আগস্ট ২০১৬ তারিখ গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পায়রা বন্দরের বহির্নোঙর থেকে পণ্য খালাসের মাধ্যমে বন্দরটির অপারেশান কার্র্যক্রমের উদ্বোধন সহ ৫টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধনকালে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি পায়রা বন্দরকে ঘিরে দেশের দক্ষিণঞ্চালে সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘ফুরচুন’ জাহাজ আমাদের জন্য ফরচুন নিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশের শিল্প ক্রমশ বিকশিত হচ্ছেন। যার পুরোভাগে রয়েছে গার্মেন্ট শিল্প। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদেশগুলোতে বাংলাদেশের গার্মেন্টস রপ্তানির গড় প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশের উপর। গার্মেন্টস রপ্তানিতে চিন, ভিয়েতনামের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। প্রবৃদ্ধির হার বিবেচনায় আশা করা যায় আগামী দশকেই বাংলাদেশ অন্তত ভিয়েতনামকে ছাড়িয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে চলে যাবে। বর্তমানে এ খাত থেকে বাংলাদেশ আয় করছে বার্ষিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালের লক্ষ্যমাত্রা ৫০ বিলিয়ন ডলার। গার্মেন্টস এর পিছু পিছু এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ, জাহাজ নির্মাণের মতো কয়েকটি খাত। বাংলাদেশের ওষুধ এখন রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়ার ৮০টি দেশে। মোট দেশজ চাহিদার প্রায় ৯৭% ওষুধ এখন বাংলাদেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। আশা করা যায়, এ খাত আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের অন্যতম প্রধান খাতে পরিণত হবে। বাংলাদেশের তৈরি জাহাজ এখন যাচ্ছে বিশ্বের অন্য প্রান্তরেও।
সরকারের গৃহীত নীতি ও লক্ষ্য মাত্রার কারণে খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে তথ্য প্রযুক্তি খাত। এ মুহুর্তে এ পেশায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়োজিত আছে কমবেশি ৩০ লাখ তরুণ-তরুণী। আশা করা যায় অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এ খাতে আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশ ভারতের পিছু নিবে। এতে করে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব কমবে এবং অর্থনৈতিক খাতের পাশাপাশি সামাজিক ও জীবনমানের সূচকেও ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। একেই বলা হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ। একেই বলা হচ্ছে পজিটিভ বাংলাদেশ। বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। ১৯৮৯ তে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ৩৯টি দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তার জন্য কাজ করে দেশের জন্য অসীম সুনাম ও প্রশংসা কুড়িয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বিশ্বের ১১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১ম।
বিদেশের সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত গত অর্থ বছরে বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাময়িক হিসাবে ২০১৫-১৬ অর্থ বছর শেষে চলতি হিসাবে ৩৭০ কোটি ৬০ লাখ ডলারের উদ্বৃত্ত রয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থ বছরের যা ছিল ২৮৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আমদানির তুলনায় রফতানি প্রবৃদ্ধি বেশি থাকায় এ উদ্বৃত্ত বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত অর্থবছরে এফওবি (পরিবহন এবং জাহাজীকরণ ব্যয় ছাড়া) ভিত্তিতে আমদানি ব্যয় হয়েছে ও হাজার ৯৭১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আগের অর্থ বছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি। রফতানি উন্নয়ন বুরে‌্যার (ইপিবি) হিসাবে গত অর্থ বছরে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩ হাজার ৪২৪ কোটি ১৮ লাখ ডলার। রপ্তানি আয় বেড়েছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ।
অথচ ইউরোপের প্রধান তিন অর্থনীতির দেশের চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমেছে। সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে ইতালি ও ফ্রান্সে। জার্মানিতেও প্রবৃদ্ধি হার কমেছে। এ সময়ে এ অঞ্চলের ২৮ দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রথম প্রান্তিকে যা ছিল শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল থেকে জুলাইয়ে ইতালি ও ফ্রান্সের প্রবৃদ্ধির হার ছিল শূন্য। প্রথম প্রান্তিকে ইতালিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিলো শূণ্য দশমিক ৩ শতাংশ এবং ফ্রান্সের ছিল শূণ্য দশমিক ৭ শতাংশ। প্রথম প্রান্তিকে ফ্রান্সের ভালো প্রবৃদ্ধির মূল কারণ ইউরো ফুটবলের চূড়ান্ত পর্ব। দ্বিতীয় প্রান্তিকে এ অঞ্চলে সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ জার্মানির প্রবৃদ্ধি কমে হয়েছে শূণ্য দশমিক ৪ শতাংশ, প্রথম প্রান্তিকে যা ছিল শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে, ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে প্রবৃদ্ধির গতি সবচেয়ে বেশি ছিল গ্রীসে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছে শূণ্য দশমিক ৩ শতাংশ। তুরস্কে অস্থিরতার কারণে পর্যটকদের আগ্রহ এখন গ্রীসের দিকে।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী আগস্টে মোট আয় হয়েছে ৩৩০ কোটি ৩৫ লাখ ডলার। আগের বছরের আগস্টে এর পরিমাণ ছিল ২৭৫ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। নতুন অর্থ বছরের গত দুই মাসে আয় এসেছে ৫৮৪ কোটি ডলার। আগের অর্থ বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৫৩৮ কোটি ডলার। এর মধ্যে নিট পোশাক রফতানি ২৪৭ কোটি ডলার ও ওভেন থেকে এসেছে ২৩৭ কোটি ডলার। পোশাকের বাইরে চিংড়িসহ হিমায়িত মাছের আয় বেড়েছে ২১ শতাংশে বেশি। কাঁচা পাটসহ সব ধরনের পাটপণ্যের আয় বেড়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ। চামড়া ও চামড়া পণ্য বেড়েছে ১৫ শতাংশের বেশি। ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান মাফরুহা সুলতানী বলেন, এ বছর প্রথম দিকে থেকেই আরো ইতিবাচক প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। রফতানি খাতকে বহুমুখী করার জন্য কাজ করছে সরকার।
সম্প্রতি জন কেরি ঘুরে গেছেন বাংলাদেশ। যে আমেরিকার হেনরি কিসিঞ্জার একদিন বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলেন সেই দেশেই জন কেরি আমাদের উন্নয়ন দেখে মুগ্ধ। আর এর নাম ইতিহাস। সময় আর প্রকৃতির কাছে কেউ না। সে সত্যের হাত ধরেই জন কেরি সম্মান জানালেন আমাদের জাতির জনককে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। ৩০ আগস্ট ২০১৬ প্রথম বারের মতো ঢাকায় আসেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী বাংলাদেশের অভূতপূর্ব অগ্রগতি, জাতিসংঘ বাহিনীতে অবদান ও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করেন।
কার্ডের মাধ্যমে গ্রাহকদের লেনদেনের পরিমাণ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে (জানুয়ারি-জুন) দেশের ব্যাংকগুলোর ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহকরা ৬৪ হাজা ২৩৭ কোটি টাকার লেনদেন করেছেন, যা ২০১৫ সালের প্রথম ৬ মাসের তুলনায় ১৫ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা বা ৩২ শতাংশ বেশি। গত বছরের ওই সময়ে কার্ডের লেনদেন ছিল ৪৮ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে ডেবিট কার্ডে লেনদেন হয়েছে ৬০ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা। ক্রেডিট কার্ডে হয়েছে ৩ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে জানুয়ারি-জুন মাস পর্যন্ত ডেবিট কার্ডে লেনদেন হয়েছিল ৪৫ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা, ক্রেডিট কার্ডে হয়েছিলো ৩ হাজার ৭৪ কোটি টাকা।
জাতিসংঘের সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে (এমডিজি) বাংলাদেশের সাফল্য বিষ্ময়কর। এমডিজির ৮টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ৭টি বাংলাদেশ অর্জন করেছে নির্ধারিত সময়ের আগেই। অন্যটিও অর্জনের দ্বারা প্রান্তে বাংলাদেশ। এ কৃতিত্ব সরকারের পাশাপাশি দেশবাসীরও।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। ভারতের সাথে দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভুত সীমান্ত চুক্তির সফল বাস্তবায়ন, ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সমুদ্র সীমানা সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান, পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশ অহিংস নীতিতে বিভিন্ন আঞ্চলিক সমস্যায় রাজনৈতিক ও আইনি সমাধানের ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল নাম। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা, জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় ও তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে বাংলাদেশের উদ্যোগ আজ দেশিয় পরিম-ল ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হচ্ছে। এর স্বীকৃতিস্বরূপ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার আইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরুস্কার (ওঈঞ রহ ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ অধিৎফ) এবং চ্যাম্পিয়নস অব দি আর্থ (ঈযধসঢ়রড়হং ড়ভ ঃযব ঊধৎঃয অধিৎফ ২০১৫) পুরুস্কারে ভূষিত হয়েছেন। জাতি হিসেবে এটি আমাদের বিরাট অর্জন।
বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আর্থ সামাজিকসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যায় উন্নয়নের ছোঁয়া। এ উন্নয়নে মানুষের জীবনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। আর্থিকভাবে প্রতিটি পরিবারই এখন স্বচ্ছল। বাংলাদেশের এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। উন্নয়নের এ ধারা যেন কিছুতেই ব্যহত না হয় । একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশকে জানাই ‘স্যালুট’। সাবাস বাংলাদেশ।
লেখক: পুলিশ কর্মকর্তা (অব.), (আই.জি ব্যাজ, জাতিসংঘ ও রাষ্ট্রপতি পদক প্রাপ্ত)