এবার আম রফতানির লক্ষ্যপূরণ হচ্ছে না লোকসানের মুখে চাষিরা

আপডেট: জুন ১৯, ২০২৫, ১:১০ পূর্বাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক ও বাঘা প্রতিনিধি:


প্রতি বছর রাজশাহী অঞ্চল থেকে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে আম। রাজশাহী থেকে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে ৭০ শতাংশ আম রফতানি করা হয়। কিন্তু এবছরে আম রফতানি হচ্ছে না। রফতানির জন্য আম প্রস্তুত করেও চাষিরা পারছেন না পাঠাতে। এতে তারা লোকসানের মুখে পড়ছেন। রফতানিতেও আছে নানা সংকট। গেল তিন বছরে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২২ দশমিক ১১ শতাংশ আম রফতানি হয়েছে।

রাজশাহী অঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, রাজশাহী অঞ্চলে গত তিন বছরে রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন হয়েছে চার হাজার ৬৪৮ মেট্রিক টন। এর মধ্যে রফতানি হয়েছে এক হাজার ২৭ দশমিক ৮৮ মেট্রিক টন, যা উৎপাদনের মাত্র ২২ দশমিক ১১ শতাংশ। রাজশাহী অঞ্চলে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন হয়েছিল ৫৫০ মেট্রিক টন। ওইবছর আম রফতানি করা হয় ২২২ দশমিক ৮৮ মেট্রিক টন, যা উৎপানের ৪০ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ৫২৮ মেট্রিক টন। ওইবছর রপ্তানি করা হয় ৬০৬ মেট্রিক টন, যা উৎপাদনের মাত্র ২৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে রফতানিযোগ্য আম কমে উৎপাদন হয় এক হাজার ৫৭০ মেট্রিক টন। এসময় রফতানি হয় ১৯৯ মেট্রিক টন, যা মোট উৎপাদনের মাত্র ১২ দশমিক ৬৮ শতাংশ।

চলতি বছর রাজশাহী অঞ্চলের রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন হয়েছে ছয় হাজার ৭২০ মেট্রিক টন। এরমধ্যে রাজশাহীতে ২০০ মেট্রিক টন, চাঁপাইবানাবগঞ্জে ৬ হাজার, নওগাঁয় ৫০৫ এবং নাটোরে উৎপাদন হয়েছে ১৫ মেট্রিক টন। চলতি বছরে আমের রফতানি মৌসুম শুরু হলেও রফতানি করতে পারেনি রাজশাহী অঞ্চল থেকে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ১৭ মেট্রিক টন। আর নওগাঁ থেকে রফতানির পরিমাণ মাত্র ৪ দশমিক ৮ মেট্রিক টন। অর্থাৎ চলতি বছরে আম রফতানি হয়েছে মাত্র ২১ দশমিক ৮ মেট্রিক টন। ফলে বিপুল পরিমাণ আম এবারও থেকে যাবে রফতানির বাইরে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আম রফতানিতে সরকারিভাবে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য মানসম্মত আম উৎপাদন করে বিদেশে রফতানি করা। এই প্রকল্পের অধীনে কৃষকদের উন্নত কৃষি পদ্ধতি, রোগ ও পোকা-মাকড়ের ব্যবস্থাপনা এবং ভালো জাতের আম চাষের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে আমের ফলন বৃদ্ধি, প্রক্রিয়াকরণ এবং বাজারজাতকরণে সহায়তা করা হয়। যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৬২ কোটি টাকা। এত পরিমাণে খরচের পরও দেখা মিলছে না সাফল্যের।

কৃষি বিভাগ ও চাষিদের সঙ্গে কথা বলে যানা গেছে, রাজশাহীর আমের প্রধান সমস্যা হলো ফাইটোস্যানিটারি সনদ জটিলতা। বিদেশে আম রফতানির জন্য স্বাস্থ্য সনদ (ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেট) প্রয়োজন হয়। অনেক সময় এসব সনদ প্রক্রিয়ায় জটিলতা ও বিলম্ব হয়। পর্যাপ্ত হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট না থাকাও একটা বড় সমস্যা। ইউরোপসহ অনেক দেশ আমদানি করার আগে হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট চায়, যা বাংলাদেশে শুধুমাত্র ঢাকাতেই রয়েছে।

শুধু তাই নয়, আম সংরক্ষণের সঠিক ব্যবস্থা নেই। শীতলীকরণ সুবিধার অভাব রয়েছে। পর্যাপ্ত প্যাকেজিং এবং গ্রেডিং ব্যবস্থা নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে মান অনুযায়ী প্যাকেট ও গ্রেডিং না থাকায় দাম কমে যায়। পরিবহন ও রফতানি খরচ বেশি। বিমানভাড়া এবং অন্যান্য ব্যয় বেশি হওয়ায় লাভজনকভাবে আম রফতানি করা কঠিন হয়। বাজার সংযোগেও রয়েছে দুর্বলতা। বিদেশে ভালো বাজার থাকলেও সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে সে বাজারের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তোলা হয় না।

গেল বছরে বাঘা থেকে ১০৫ মেট্রিকটন আম ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে, পর্তুগাল, ফ্রান্স, রাশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হয়েছে। কিন্তু এবার ২০০ মেট্রিকটন আম পাঠানোর কথা থাকলেও এবার ১ মেট্রিকটনও পাঠানো হয়নি। কারণ হিসেবে চাষিরা বলছেন, বৃষ্টির কারণে আমের রঙ ভাল না হওয়ায় রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো আম নিতে আগ্রহী না। ফলে এবার এই উপজেলার আম রফতানি হচ্ছে না। এ কারণে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা হতাশার মধ্যে পড়েছেন।

রাজশাহী জেলার ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর আমবাগানের মধ্যে বাঘা উপজেলায় আট হাজার ৫৭০ হেক্টর জমিতে আমবাগান রয়েছে। উপজেলায় উল্লেখযোগ্যে আমের মধ্যে গোপালভোগ, হিমসাগর, আ¤্রপালি, ল্যাংড়া, তোতাপরি, ফজলি, লখনা। এই আম ১৪ বছর ধরে রফতানি করা হয়েছে ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে, পর্তুগাল, ফ্রান্স, রাশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।

আম ব্যবসায়ী আশরাফু-দৌলা বলেন, উপজেলা কৃষি অফিসের সহযোগিতায় শাহী মসজিদের শিলালিপিতে আমের টেরাকোটা অংকিত ছবি সংবলিত মোড়ক তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেই মোড়কে আমের প্যাকেটজাত করে বিদেশে আম রফতানি করা হয়েছে। কিন্তু এবার রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান আম নেয়নি। এতে চাষি ও ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন।
বাঘা উপজেলা কৃষি অফিসার শফিউল্লাহ সুলতান বলেন, বাঘার আম দেশে পরিচিতি অর্জন করে বিদেশে রফতানি করা হয়। কিন্তু এবার অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে আমের রঙ রপ্তানিযোগ্য না হওয়ায় তারা গ্রহণ করেনি।

রাজশাহীর বিপন এগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেডের মালিক হাফিজুর রহমান খান বলেন, আম এক্সপোর্ট লেভেলের কয়েকটি ধাপ আছে। তবে নিরাপদ স্থান, প্যাকিং, গ্রেডিং, কার্গো বিমান ইত্যাদি সমস্যার কারণেই আমরা আম উৎপাদন থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি। আমাদের আগে আমের চাহিদা বেশি ছিল, তখন কৃষক ছিল না। এখন কৃষক আছে কিন্তু দক্ষ লোক ও সরকারি সহায়তা খুব একটা নেই। এজন্যই আমাদের আম রফতানি কমে গেছে।

তিনি বলেন, ‘আম রফতানিতে সমস্যার কথা বারবার সরকারকে লিখিত ও মৌখিকভাবে বলেছি। তারা শুধু আশ্বাস দেন কিন্তু সমাধান করেন না। প্রতিবছর আম বাড়তি থেকে যায়। এসব আম কৃষকদের ঘাড়ে পড়ে। আম রফতানির জন্য যখন চুক্তি করা হয়, তখন কিন্তু বলা হয় না এই আম রপ্তানি হবে কিংবা এর গ্যারান্টি ক্লজও নেই যে, সব আমই বিদেশে রপ্তানি হবে।

রাজ চাঁপাই এগ্রো ফুড প্রোডিউসারের সভাপতি আনোয়ারুল হক বলেন, আগে আমরা ৩-৪ হাজার মেট্রিক টন আম পাঠিয়েছি, এবার মাত্র ৫০০ মেট্রিক টন বিদেশে যাবে। তবে এবছর আম রফতানি এখনো শুরু হয়নি। রফতানির কারণে আমাদের সীমাহীন ক্ষতি হচ্ছে। সরকারের কাছে বারবার আবেদন করেছি প্যাকেজিং হাউজ রাজশাহীতে দেওয়া হোক। আমরা ১০ বছর ধরে দাবি জানিয়ে আসছি। প্রতি বছরই রাজশাহীতে করা হবে বলা হয় কিন্তু সেটি ওই বলা পর্যন্ত। আম যতই উৎপাদন হোক, ঢাকার শ্যামপুরে প্যাকেজিং হাউজ করে বিদেশে এতে আম পাঠানো যাবে না। হাতেগোনা কিছু যাবে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসরণ অধিদফতরের উপপরিচালক ড. ইয়াছিন আলী বলেন, রাজশাহী অঞ্চলের সবচেয়ে বেশি রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন করা হয়েছে এই জেলায়। প্রায় ছয় হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদন করা হয়েছে। এরইমধ্যে আম রফতানি শুরু হয়েছে। আমরা ১৭ মেট্রিক টন আম রফতানি করেছি। এরপর ইদের ছুটিতে রপ্তানি হয়নি। এখন আবারও শুরু হবে। যে পরিমাণ আম উৎপাদন হয়েছে মনে হয় না আবার রফতানি করতে পারবো। গতবছর ৩৩০ মেট্রিক টন আম রফতানি করেছি। এবার ৫০০-৭০০ মেট্রিক টন চেষ্টা করবো।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক উম্মে সালমা বলেন, রাজশাহী থেকে বিদেশে আম রফতানি এখনো শুরু হয়নি। ইদ ও অনিয়মিত বৃষ্টির কারণে দেরি হচ্ছে। তবে এবার চীনে আম রফতানি হবে। তিনি বলেন, রাজশাহী থেকে আম রফতানির পরিমাণ খুবই কম। এর কারণ নিজস্ব কার্গো বিমান নেই। এককেজি আম পাঠাতে ৫০০ টাকা পরিবহন খরচ পড়ে যায়। পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে পাঠাতে এই খরচ কম। এ কারণে তারা বেশি পাঠাচ্ছেন।
রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক অরিফুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ আম রফতানি করা হয়, এর ৭০ শতাংশই যায় রাজশাহী অঞ্চল থেকে। এবার পাঁচ হাজার মেট্রিক টন আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আম উৎপাদন বেশি হলে সবটাই রফতানি হবে এমনটি নয়। আম রফতানির কয়েকটি ধাপ আছে। এরমধ্যে রাজশাহী থেকে ঢাকায় আম যেতেই ১০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। এর পাশাপাশি কার্গো ভাড়াও বেশি। কার্গোতে স্থান না পাওয়াসহ বেশ কিছু সমস্যাও আছে। তবে এসব সমস্যা সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে।

Exit mobile version