এমন একটা মা দেনা

আপডেট: মে ১২, ২০২৪, ১২:০৮ পূর্বাহ্ণ


মজিবুর রহমান


বিশ্বসেরা একটি শব্দের নাম ‘মা’। ‘মা’ কে ভাষা ভেদে মাম্মি, মাদার ইত্যাদি নামেও ডাকা যায়। সবথেকে সুন্দর ও মধুর শব্দের নাম ‘মা’। এত সুমধুর, টইটুম্বর শব্দ আর দ্বিতীয়টি নেই। আপনার আমার যাদের মা বেঁচে নেই, তারা দুর্ভাগা ও হতভাগা। তারা এতিম। তাদের কেউ আর আদর করতে আসবে না, না খেয়ে থাকলে খাওয়াবে না।

তাদের আর কেউ বলবে না, আমার সন্তানটা কোথায় গেল, কী খেল, সুস্থ আছে কী না। মা হারা সন্তানদের ‘মা’ ডাকার আর কোনো সুযোগ নেই। মায়ের সেবা করারও কোনো সুযোগ নেই। সৃষ্টিকর্তার নিকট মায়ের জন্য পরপারের ভালো চাওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। সেটা করেই আমরা আমাদের মনকে প্রবোধ দেব। মন্দের ভালো, আমরা তাই করবো।

আর যাদের মমতাময়ী মা বেঁচে আছেন, তারা অনেক সৌভাগ্যবান ব্যক্তি। গোটা দুনিয়া তাদের, আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বর তাদের। এজন্য যে, তারা তাদের মায়ের সেবা করে পৃথিবী জয় করতে পারে, স্বর্গ জয় করতে পারে। এই মা-ই আমাদের অন্ধকার থেকে পৃথিবীর আলোর মুখ দেখিয়েছেন।

‘মা’ তার বুকের কাছে রেখে, হৃদয়ের কাছে রেখে কলিজার ধন বলে আদর করেছেন। খাইয়ে, পড়িয়ে, শিক্ষা দিয়ে আপদ-বিপদ থেকে রক্ষা করে মানুষ বানিয়েছেন। নিজে না খেয়ে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন। বন্যার পানিতে ডুবতে লাগলে নিজে ডুবে জীবন দিয়ে সন্তানকে ভাসিয়ে রেখেছেন। ইদের পোশাক নিজে না পড়ে সন্তানকে পড়িয়েছেন।

নিজের চিকিৎসা না করে সন্তানের চিকিৎসা করিয়েছেন। অসুস্থ হলে বিধাতাকে বলেছেন আমার জীবনের পরিবর্তে আমার সন্তানকে সুস্থ করেদিন। ‘মা’ বৃদ্ধা হলে চলতে না পারলেও তাঁর সন্তান কিখেলো, কোথায় গেল, শরীর খারাপ হলো

কিনা খোঁজ নেন। সে মাকে আমরা কেমন ভাবি, কেমন দেখি-
৫ বছর বয়সে ভাবি, আমার মা সবপারে।
৮ বছর বয়সে ভাবি, আমার মা সবজানে।

১২ বছর বয়স হলে ভাবতে শুরু করি, মনে হয় আমার মা সবকিছু ঠিকমত জানে না।
১৪ বছর বয়সে ভাবি, মা আসলেই এটাসেটা অনেককিছু জানে না।

১৬ বছর বয়সে ভাবি, মা আসলে সেকেলে লোক।
১৮ বছর বয়সে ভাবি, একালে এসে আমার মা অচল, একেবারেই বাতিল।

২৫ বছর বয়সে ভাবি, হ্যাঁ আমার মা এ সম্পর্কে কিছুটা জানে।
৩৫ বছর বয়সে ভাবি, কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে মায়ের মতামত জেনে নেয়া উচিত।

৪৫ বছর বয়সে ভাবি এবং বিস্মিত হই, মা আগেই এসব কিভাবে জেনেছিল।
৬০ বছর বয়সে ভাবি, মা পার্শ্বে থাকলে অনেক ভালো হতো।
৬৫ বছর বয়সে ভাবি, আহা ! আরেকবার যদি মায়ের সেবা করতে পারতাম, তার সঙ্গে যদি কথা বলতে পারতাম। কিন্তু …।

কিন্তু সেই মাকে ‘ঐশিরা’ সাতটি চাকু মেরে মেরে ফেলে। সেই মাকে না জানিয়ে ‘তিশারা’ ১৮ বছর বয়সে বাপের বয়সী ‘মোস্তাক’কে স্বামী হিসেবে বেছে নেই। সেই মায়ের সন্তান ইমন, সুমনরা ১৩ বছর বয়সে কিশোর গ্যাং-এর সদস্য হয়। ১৫ বছর বয়সে ইভটিজিং করে আনন্দ উল্লাস করে। ১৮ বছর বয়সে মেয়ে ও শিশু পাচারকারী দলের সদস্য হয়। ২৫ বছর বয়সে অবৈধ কিডনি বেচা-কেনার দলে জড়িয়ে পড়ে।

কিন্তু না, আপনি জন্মদাতা মা, আপনার সন্তান এমন করলে চলবে না। আপনার সন্তান এগুলো করে সমাজকে কলুষিত করুক, সেটা আপনি নিজে অবশ্যই চান না। আপনি চান নিয়ম ভাঙ্গা নিয়মে চলা দুর্দমনীয় সন্তান বেনজীর ভুট্টো, ইন্দিরা গান্ধী, বেগম রোকেয়ার মা হতে। আপনার ভেতরে থাকা উত্তম অংশগুলো জাগিয়ে তুলতে আপনি হবেন শেখ হাসিনা, রাণী ভিক্টোরিয়ার মা।

আপনি হবেন আদর্শিক, যত্নশীল, দয়াশীল, উৎসাহদাতা, বাস্তববাদী শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, অড্রে হেপবার্ণের মা। হবেন বেগম সুফিয়া কামাল, মার্গারেট থ্যাচার, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শেক্সপীয়র, জীবনানন্দ দাস, আলফ্রেড নোবেল, টমাস আলফা এডিসনের মা। আপনি হবেন রত্নগর্ভা মা এবং তা আপনাকে হতেই হবে। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, তা-কি সম্ভব ? হ্যাঁ অবশ্যই সম্ভব।

কোনো না কোনো ‘মা’-তো তা করে দেখিয়েছে, তবে আপনি কেন নন। বলবেন কাজটি অনেক কঠিন, হ্যাঁ কঠিন তবে অসম্ভবও নয়।

প্রথমে আপনার ইচ্ছা শক্তিকে জাগিয়ে তুলুন। আপনার শিশুটিকে নিয়ে আপনি নতুন স্বপ্ন দেখুন। যে স্বপ্নটি অনেকেই দেখে না বা দেখতে পারে না। এই স্বপ্নের ডাল-পালা ছড়িয়ে দিন। বাস্তবায়নে মনোযোগী হন এবং প্রচেষ্টা চালান। আপনি ঠিকই আপনার লক্ষ্যে পৌঁছে যাবেন। আপনার সন্তানকে প্রথমে ধর্মীয় এবং নৈতিক শিক্ষা দিন, মানবতার শিক্ষা দিন, দুঃখীজনে সহৃদয় হতে শিখান। শিখান, কারো অন্যায় করা যাবে না, ক্ষতিকরা যাবে না, অন্যের উপকার করতে হবে।

তোমার দ্বারা কেউ কোনোভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হোক, এটা করা যাবে না। মিথ্যা বলা মোটেই শিখবে না। সর্বজীবে দয়া করতে শিখান। বড় হতে উৎসাহ দিন, বড়দের উদাহরণ দিন, বড়দের সম্মান করতে শিখান। বলুন কর্মই ধর্ম। কর্মছাড়া কেউ উপরে উঠেনি এবং উঠতে পারে না। তার কর্মস্পৃহা সৃষ্টি করুন এবং জাগ্রত করুন। বড় হবার স্বপ্ন দেখান।

তারপর আপনি ক, খ, গ, অ, ই, ঈ, উ, ইত্যাদি আপনার ইচ্ছামত শেখাতে স্কুলে পাঠান। নজরদারি এবং তদারকি করতে থাকুন। দেখবেন, সমাজ কলুষিত হোক এ-কাজ আপনার সন্তান করবে না। সে অনেক বড় হবে এবং আপনি রত্নগর্ভা ‘মা’ হবেনই, হবেন।

লেখক: প্রবন্ধকার ও সাবেক অধ্যক্ষ, বখতিয়ারপুর ডিগ্রি কলেজ