শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১১ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
প্রফেসর ড. আবদুল খালেক
সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার খবর প্রচারিত হবার সাথে সাথে অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের মত রাজশাহীর জনসাধারণও প্রচ- ক্ষোভে ফেটে পড়ে। পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য স্থানীয় প্রশাসন রাজশাহী শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত ছাত্র-ছাত্রী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আইউব খানের দালাল হিসেবে পরিচিত রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষের বাসার সামনে সমবেত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। পুলিশের সাথে এক পর্যায়ে ছাত্রদের সংঘর্ষ বাধে। ড. জোহা খবর পেয়ে গাড়ি নিয়ে দ্রুত ছুটে যান ঘটনাস্থলে। পুলিশের সাথে সংঘর্ষে কয়েকজন ছাত্র তখন আহত। খবরটি ক্যাম্পাসে প্রচারিত হবার সাথে সাথে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালিন বিভাগীয় প্রধান তথা এস.এম. হলের প্রোভোস্ট ড. মযহারুল ইসলামও ঘটনা স্থলে চলে যান। আহত ছাত্রদেরকে ড. জোহা এবং ড. মযহারুল ইসলাম গাড়িতে তুলে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান চিকিৎসার জন্য। আহত ছাত্রদের ফোটা ফোটা রক্তে শিক্ষকদের জামা ভিজে ওঠে। এ ছিল ১৭ ফের্রুয়ারি বিকেল ৫ টার ঘটনা। ১৯-২-৬৯ তারিখে ইত্তেফাকে প্রকাশিত খবর- “গতকাল রাজশাহী গবর্নমেন্ট কলেজের অধ্যক্ষের বাসভবনের নিকট ছাত্রদের এক মিছিলের উপর পুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপের ফলে ১০ জন ছাত্র আহত হয়। ইহাদের মধ্যে ৪ জনের অবস্থা গুরুতর। .. মিছিলকারীরা গবর্নমেন্ট কলেজের অধ্যক্ষের বাসভবনের দিকে অগ্রসর হইতে থাকিলে একদল পুলিশ তাহাদের গতি রোধ করে। ইহাতে মিছিলকারীরা বিক্ষুব্ধ হইয়া পুলিশের উপর ইট পাটকেল ছুড়িতে থাকিলে পুলিশ তাহাদের উপর লাঠিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করিতে থাকে। ইহার ফলে ১০ জন আহত হয়। তাহাদের মধ্যে ১০ জনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আহত সকল ছাত্রকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ও গ্রেফতার করা হইয়াছে” আহত ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য -জনাব শামসুল হক টুকু ( সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) জনাব মু. আজহার আলী (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রফেসর) তিনি বলেছেন “ মিছিলটি দ্রুত রাজশাহী কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল আবদুল হাই সাহেবের বাসার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মিছিল স্টার স্টুডিও অতিক্রম করার পূর্বেই বেশ কিছু দাঙ্গা পুলিশ আমাদের পিছু নেয়। এ সময় সকলের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্ররা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। এ সময় পিছন থেকে প্রায় শতাধিক দাঙ্গা পুলিশ মিছিলে লাঠি চার্জ করে।। পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে । আমরাও পুলিশের প্রতি ইট পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকি। প্রায় ২০ মিনিটব্যাপী ধাওয়া ও ইট পাটকেল নিক্ষেপ চলার পর আমরা কজন পুলিশের হাতে ধরা পড়ি। পুলিশ নির্মমভাবে আমাদের প্রহার করে। আমাদেরকে পুলিশ ভ্যানে উঠানোর পর একজন পুলিশ রাইফেলের বাঁট দিয়ে শামসুর রহমানের চোয়ালে খুব জোরে আঘাত করলে তার মুখ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। ঠিক এই মুহূর্তে সাদা সার্ট ও সাদা প্যান্ট পরিহিত ড. শামসুজ্জোহা ঘটনাস্থলে পৌঁছেন। ড. জোহা দ্রুত তাঁর গাড়ি থেকে নেমে পুলিশের মুখোমুখি হন এবং অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন,‘ ইউ ব্রুট, ভ্যানে তুলেও তোমরা ছেলেদের মারছো’। আমাদের ভ্যানটি যখন থানার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে তখন ড. জোহা পুলিশ ভ্যানে উঠে পড়েন। বেঞ্চে বসার জায়গা না থাকায় ড. জোহা পুলিশ ভ্যানের বেঞ্চে বসে পড়েন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৬৯ সালে একুশের অনুষ্ঠান পালন উপলক্ষে এক সপ্তাহের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় শহীদুলাহ কলা ভবনের সামনে তৎকালীন শহিদ মিনারের পাদদেশে। ১৭ ফের্রুয়ারি সন্ধ্যা রাতে বাংলা বিভাগ আয়োজিত সেমিনারে যে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল, শহরে ছাত্রদের আহত হবার খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে বাংলা বিভাগের আলোচনা সভা শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদ সভায় রূপান্তরিত হয়। ড. মযহারুল ইসলামের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন নেতৃস্থানীয় প্রায় সকল শিক্ষকই (ড. জোহা, অধ্যাপক হবিবুর রহমান (শহিদ), অধ্যাপক কাজী আব্দুল মান্নান, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, প্রমুখ) ছাত্রদের প্রতি নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন এবং কঠোর ভাষায় তৎকালীন সরকারের সমালোচনা করনে। ড. জোহা এই সভায় তাঁর শার্টে ছাত্রদের রক্তের দাগ দেখিয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে উচ্চারণ করেন-‘আহত ছাত্রদের পবিত্র রক্তের স্পর্শে আজ আমি গৌরবান্বিত। এর পর থেকে শুধু ছাত্রদের রক্ত নয়, প্রয়োজনবোধে আমাদেরকেও রক্ত দিতে হবে।’ বাংলা বিভাগ আয়োজিত সেই প্রতিবাদ সভায় ড. জোহা আরও ঘোষণা করেন-‘এর পর আর যদি কোন গুলি করা হয়, কোন ছাত্রের গায়ে লাগার আগে সে গুলি আমার বুকে লাগবে।’ ড. জোহা সে কথা রেখেছেন। ১৮ ফের্রুয়ারি তারিখে তাঁর সে ওয়াদা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন।
ড. জোহাকে যখন হত্যা করা হয়, তখন তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। আমি ছিলাম তাঁর সহকারী প্রক্টর। এ কারণে আমি তাঁর খুব কাছাকাছি আসতে পেরেছিলাম। তাঁর সাথে আন্তরিক একটি সম্পর্ক পারিবারিকভাবে গড়ে উঠেছিল। আমরা একে অপরের বাসায় ঘন ঘন যাতায়াত করতাম। মিসেস নীলুফার জোহার ব্যক্তিত্ব ছিল আকর্ষণীয় এবং মধুর। মুখে সব সময় তাঁর হাসি লেগেই থাকতো। বাসায় গেলেই আন্তরিকতার স্পর্শ অনুভব করা যেতো। তাঁদের হাসি-খুশি দাম্পত্য জীবন নিয়ে আমরা মাঝে মাঝে রসিকতা করতাম। ড. জোহা আমাকে গভীরভাবে ¯েœহ করতেন, আমি তাঁকে অন্তর দিয়ে শ্রদ্ধা করতাম। আমার প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ¯েœহ ১৮ ফের্রুয়ারির করুণ ঘটনার অন্যতম কারণ কিনা, তা আমার কাছে এখনও এক বড় প্রশ্ন। মাঝে মাঝে মনে হয় ঘটনাস্থল থেকে আহত আমাদেরকে উদ্ধার করতে না গেলে ড. জোহা হয়তো বেঁচে যেতেন। কিন্তু যাঁর রক্ত দেশে একটি গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেবে, যাঁর আত্মদান একটি দেশকে স্বাধীন করবে, ঘটনাস্থলে তাঁকে যেতেই হবে, নিয়তির এ ছিল অমোঘ বিধান।
১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারির যে করুণ স্মৃতি আমাদের বুকের মধ্যে জমাট হয়ে আছে। সে স্মৃতি কখনও ভুলবার নয়। সকালে শীত যেমন থাকবার কথা, সে বছর শীত তেমন ছিল না। সে কারণে সকালে সোয়েটার গায়ে দেয়ার প্রয়োজন হয়নি। শার্ট গায়ে বিভাগীয় কাজে চলে যাই। সার্জেন্ট জহুরুল হকের নিমর্ম হত্যার প্রতিবাদে ছাত্রদের একটি বিক্ষোভ মিছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শহরের দিকে এগিয়ে যাবে এমন কথা আমাদের কানে এসেছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ এত বেশি বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছিল যে, সেখানে প্রক্টর বা সহকারী প্রক্টর হিসেবে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করবার কিছু ছিল না। ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মরণে বাংলা বিভাগ আয়োজিত পুস্তক প্রদর্শনীর কাজে আমি ১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে খুব ব্যস্ত ছিলাম। বর্তমান শহীদুলাহ কলা ভবনের ১৫০ নম্বর কক্ষে বাংলা একাডেমীর বই-সাজিয়ে-গুছিয়ে নেয়া হচ্ছিল, এমন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ছাত্র-ছাত্রীরা প্রাণের ভয়ে এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করছে। বেলা তখন আনুমানিক সাড়ে নয়টা।
ছাত্র-ছাত্রীদের বিপদের কথা ভেবে সব কাজ ফেলে রেখে এগিয়ে গেলাম বিশ্ববিদ্যালয় গেটের দিকে। নাটোর রোডে পা দিয়েই বুঝতে পারলাম সেনাবাহিনীর জওয়ানেরা ছাত্রদেরকে গুলি করার জন্য রাইফেল তাক করে বসে আছে। ড. জোহা এবং তাঁর সাথে বেশ কয়েকজন শিক্ষক যেমন-ড. মযহারুল ইসলাম, ড. এম.আর সরকার, অধ্যাপক হবিবুর রহমান (পরবর্তীতে শহিদ) ড. কাজী আবদুল মান্নান, ড. কছিম উদ্দিন মোল্লা, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ বিক্ষুদ্ধ ছাত্রদেরকে নাটোর রোড থেকে সরিয়ে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচেছন। ড. জোহা কর্মরত সামরিক অফিসারকে বলছিলেন ‘প্লিজ ডোন্ট ফায়ার, আমার ছেলেরা এখনই চলে যাবে ক্যাম্পাসের মধ্যে।’ কিন্তু সামরিক অফিসারটি কোন কথা শুনতে রাজি নন। তিনি সামরিক বাহিনীর জওয়ানদেরকে গুলি করার জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। বিশ্ববিদ্যালয় গেটে সামরিক বাহিনীর জওয়ানদের উপস্থিতি আমাদের ছাত্রদেরকে উত্তেজিত করে তুলছিল। সামরিক বাহিনীর সাথে ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে কর্মরত ছিলেন জনাব মো. নাছিম। আমরা তখন ঘটনাস্থলে কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেট নাছিম সাহেবকে অনুরোধ জানিয়ে বললাম বিশ্ববিদ্যালয় গেটে সেনাবাহিনীর লোকজনের উপস্থিতি আমাদের ছাত্রদেরকে উত্তেজিত করে তুলছে, জওয়ানদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেট থেকে সরিয়ে নিলেই আমরা ছাত্রদেরকে ক্যাম্পাসের ভিতরে সরিয়ে নিতে পারবো। আমাদের কথায় ম্যাজিস্ট্রেট নাছিম সাহেব জওয়ানদেরকে রেডিওর গেটের দিকে সরিয়ে নিতে সম্মত হন এবং সেই মোতাবেক নাছিম সাহেব একটা জিপে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেট ছেড়ে বেশ খানিকটা পূর্বে রেডিওর গেটের নিকে এগিয়ে যান। জওয়ানেরাও ধীর পায়ে রেডিওর গেটের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
এই ব্যবস্থায় পরিস্থিতি অনেকটা আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। সমবেত শিক্ষকগণ তখন দু’দলে বিভক্ত। একদল শিক্ষক ছাত্রদেরকে নাটোর রোড থেকে মেইন গেট দিয়ে ক্যাম্পাসের ভিতরে নিয়ে আসবার কাজে ব্যস্ত। এই দলে ছিলেন ড. জোহা এবং আরো অনেক শিক্ষক। আমি, ড. মান্নান এবং ড. মোল্লা জওয়ানদের পিছে পিছে রেডিওর গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের অবস্থান ছিল ছাত্র এবং জওয়ানদের মাঝামাঝি। উদ্দেশ্য, যাতে জওয়ানেরা আমাদেরকে মাঝখানে রেখে ছাত্রদেরকে গুলি করতে না পারে। ছাত্ররা নাটোর রোড ছেড়ে ক্যাম্পাসের মধ্যে ঢুকে পড়ছে দেখে আমরা স্বস্তি অনুভব করতে থাকি। পায়ে পায়ে আমরা যখন নাটোর রোড পার হয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণ পাশে চলে এসেছি, এমন সময় আকস্মিকভাবে আমাদের উপর গুলি বর্ষিত হয়। গুলির আঘাতে আমরা ছিটকে পড়ে যাই নাটোর রোড সংলগ্ন দক্ষিণ দিকের খাদে। একই সাথে ছিটকে পড়ে যান শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. কাজী আবদুল মান্নান এবং বন্ধু ড. কছিম উদ্দিন মোল্লা। খড়ের গাদার মধ্যে পড়ে বুঝতে পারলাম ড. মান্নান এবং আমি কাছাকাছি আছি। আমার মাথা এবং ড. মান্নানের মাথা পাশাপাশি। ফিস ফিস করে আমরা কথা বলতে পারছিলাম। মুহূর্তের মধ্যে একটা গুলির আওয়াজ কানে এলো। তারপর একটি তীব্র আর্তনাদ। বুঝতে পারলাম হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে পাশের করুণ আর্তনাদ আরও তীব্র হয়ে উঠলো। আমি উঠে দাঁড়ালাম, ড. মান্নানও আমার সাথে উঠে এলেন। দু’পা এগুতেই একজন সামরিক অফিসারের হাতে ধরা পড়লাম। রিভলবার দিয়ে গুলি করতে উদ্যত হলো। ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটনাস্থলে সদ্য আগত জনৈক উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার আমাদেরকে ‘আন্ডার অ্যারেস্ট’ বলে ঘোষণা করলেন। আমরা বেঁচে গেলাম। আমাদেরকে বন্দী করে মিলিটারি ভ্যানে তুলে নেওয়া হলো। মাটিতে লুটিয়ে পড়া দেহটির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ড. জোহার সাদা জামা রক্তে লাল হয়ে উঠেছে, তিনি তখন গোঙাচেছন। আহত ড. জোহার কাছে আমরা যেতে চাইলাম, কিন্তু যেতে দেয়া হলো না। জওয়ানদের হাতে ড. মান্নান, ড. মোল্লা, এবং আমি তখন বন্দী। জওয়ানেরা আমাদেরকে হিড়হিড় করে টেনে খোলা মিলিটারি ভ্যানে তুলে নিল। ম্যাজিস্ট্রেট ‘নাসিম’ সাহেবকে ডেকে আমরা চিৎকার করে বললাম, “ড. জোহা মরে যাচেছন, তাঁকে অবিলম্বে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক” কিন্তু আমাদের কথাকে তারা কানে তোলেনি।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কতিপয় শিক্ষককে বন্দী করে খোলা মিলিটারি ভ্যানে নিয়ে যাওয়া হচেছ। এ খবর শহরে রটে গিয়েছিল, ফলে পথের মোড়ে মোড়ে বিক্ষুদ্ধ ছাত্র-জনতার হাতে মিলেটারি ভ্যান বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল। সেনাবাহিনীর লোকজনকে লক্ষ্য করে ছাত্ররা আড়াল থেকে ইট-পাটকেল ছুড়ে মারছিল। রাজশাহী শহরের সোনাদিঘির মোড়ে টাউন লন্ড্রির পাশ থেকে এক দল ছাত্র আমাদের মুক্তির দাবিতে জওয়ানদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এই সংঘর্ষেই সিটি কলেজের ছাত্র ‘নূরুল ইসলাম’ শাহাদৎ বরণ করেন। মিলিটারি ভ্যান আমাদেরকে নিয়ে মিউনিসিপ্যাল অফিসের সামনে গিয়ে থামে। পাশেই রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল। দেয়ালের ওপার থেকে কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্ররা মিলিটারি ভ্যান লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল মারতে থাকে। এই সময় ড. মোল্লা সংজ্ঞা হারায়। তাঁকে একটি স্ট্রেচারে করে মিউনিসিপাল অফিসে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে আমরা শুশ্রুষা করতে থাকি। মিউনিসিপাল অফিসের একটি ঘরের মেঝেতে আমরা অনেকগুলো আহত মানুষের আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিলাম। আহত লোকজনকে একটি ঘরে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। শুনেছি আহতদের মধ্যে ড. জোহাও ছিলেন। কিন্তু আমাদেরকে দেখতে দেয়া হয়নি। বেলা ১২ টার দিকে মিউনিসিপাল অফিসের উপর তলায় আমাদেরকে একটি ছোট কুঠুরিতে (সাময়িক হাজত ঘর) আটকিয়ে রাখা হয়। প্রায় ঘণ্টা তিনেক হাজত ঘরে কাটানোর পর দেখা গেল মেডিকেল কলেজের একদল ছাত্র বেলা ৩ টার দিকে আমাদের অবস্থা জানতে এসেছে। ড. মান্নান এর মধ্যে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন, আমিও ক্ষুধায় খুব ক্লান্ত। মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা আমাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে অবিলম্বে হাসপাতালে পাঠানোর প্রস্তাব দেয়, কিন্ত কর্তৃপক্ষ তাতে রাজি নয়। কিন্তু সেই মুহূর্তে আকস্মিক একটি খবরে সবাই বিচলিত হয়ে ওঠে। জানা যায়, বুলেট এবং বেওনেটের প্রচ- আঘাতে জর্জরিত ড. জোহা শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ড. জোহার মৃত্যুর খবর জানবার সাথে সাথে তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খানও প্রমাদ গুণতে থাকে। আমাদেরকে জেল হাজত থেকে অমিলম্বে মুক্ত করে দেয়ার নির্দেশ আসে।
লেখক: উপাচার্য, নর্থবেঙ্গল উন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি