ওয়ার সিমেট্রি, শালবনবিহার, বার্ড ভ্রমণে কুমিল্লার পথে

আপডেট: ডিসেম্বর ২, ২০১৬, ১১:০৩ অপরাহ্ণ

জনি হোসেন কাব্য


মিডটার্ম পরীক্ষা শেষে শর্ট ট্যুরের বায়না ছিল আমাদের। বোরহান স্যার প্রস্তাব করলেন কুমিল্লা ভ্রমনের। আমরা এক বাক্যে রাজি। সোমবার সকাল সাতটায় রওনা দেওয়ার পরিকল্পনা হলো।
পরিকল্পনা অনুযায়ী যথাসময়ে উপস্থিত হলাম সবাই। সকাল সাতটায় বাস ছাড়লো। ভ্রমণ পিপাসুদের হৈহল্লায় মুখরিত হয়ে উঠলো পুরো বাসটি । প্রায় দেড়ঘণ্টা জার্নি শেষে বাস এসে থামলো একটা হোটেলের সামনে। সবাই সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। রিফ্রেশ হয়ে আবার রওনা দিলাম গন্তব্যের দিকে। মোট আড়াই ঘণ্টা জার্নি শেষে বাস পৌঁছে গেল প্রথম গন্তব্যস্থল ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রিতে।
ভেতরে প্রবেশ করে ওয়ার সিমেট্রি স¤পর্কে বিস্তারিত জানতে পারলাম। এটি কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি। ১৯৪১-১৯৪৫ সালে বার্মায় সংঘটিত যুদ্ধে যে ৪৫০০০ কমনওয়েলথ সৈনিক নিহত হন, তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে সমাধিক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। এই সমাধিক্ষেত্রে ৭৩৬টি কবর আছে। এর মধ্যে অধিকাংশ হলেন সে সময়কার হাসপাতালের মৃত সৈনিকরা। তাছাড়াও যুদ্ধের পর বিভিন্ন স্থান থেকে কিছু লাশ স্থানান্তর করেও এখানে সমাহিত করা হয়েছে। বাহিনী অনুযায়ী এর মধ্যে রয়েছেন ৩ জন নাবিক, ৫৬৭ জন সৈনিক এবং ১৬৬ জন বৈমানিক। সর্বমোট ৭২৩ জন নিহতের পরিচয় জানা সম্ভব হয়েছিল।
ব্রিটিশদের এমন সুসজ্জিত সমাধি এবং ভেতরে ফুলের বাগানের সৌন্দর্য শিহরিত করলো সকল ভ্রমণপিপাসু মনকে।

২.
আধাঘণ্টা পরিদর্শন শেষে সবাই রওনা দিলাম দ্বিতীয় গন্তব্যস্থলের দিকে। প্রায় ১৫ মিনিট জার্নি শেষে বাস এসে থামলো কুমিল্লা শালবন বৌদ্ধবিহার গেইটের সামনে।
কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সবাই প্রবেশ করলাম বিহারের ভেতরে। প্রবেশ করার পথ একটিই। এই বৌদ্ধবিহারটি খননকৃত প্রতœতাত্ত্বিক আদিনিদর্শন। আকারে পুরো বিহারটি চৌকো। উত্তর বাহুর মধ্যবর্তী স্থানে বিশালাকার তোরণ এই বিহারের বিশেষ আকর্ষণ। মূল ফটকের পূর্বপাশে খননকৃত একটি প্রাচীন কূপও রয়েছে দেখার মতো ।
ঝুলন্ত সাইনবোর্ড পড়ে জানতে পারলাম, পূর্বে এই প্রতœস্থানটি শালবন ‘রাজার বাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু খননের পর ১১৫টি ভিক্ষু কক্ষবিশিষ্ট ৫৫০ ফুট বাই ৫৫০ ফুট পরিমাপের একটি বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ উন্মোচিত হওয়ায় একে ‘শালবন বিহার’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। এর আসল নাম ছিল ‘ভবদেব মহাবিহার’। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বিহারটির আশপাশে একসময় শাল-গজারির ঘন বন ছিল বলেও বিহারটির নামকরণ হয়েছে শালবন বিহার ।
শালবন বৌদ্ধবিহার ভ্রমণের সাক্ষী করে রাখতে সবাই যে যার মতো সেলফি তুলে রাখলো। সূর্যের প্রখরতা বেশি থাকার কারণে সবার চেহারা ঝকঝকরূপে ক্যামেরায় ধারণ হলো।
বিহার পরিদর্শন শেষে স্থানীয় মাঠে ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করা হলো। খেলা শেষে বিহারসংলগ্ন হোটেলে দুপুরের খাবার খেলাম সবাই, যদিও খাবারের মান অতো ভালো ছিল না!
কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে সবাই রওনা দিলাম শেষ গন্তব্যস্থলের দিকে। ১০ মিনিট জার্নি শেষে বাস এসে থামলো বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড)-এর সামনে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সবাই ভেতরে প্রবেশ করলাম।
বার্ডের প্রধান ফটকের ভিতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়লো সুসজ্জিত মসজিদ। প্রথম পদার্পণেই তার নৈসর্গিক পরিবেশ মুগ্ধ করলো। এত পরিচ্ছন্ন একটি প্রতিষ্ঠান, এত সুন্দর শৈল্পিক তার অবকাঠামো আর তারই পাশে নানান রঙের ফুলের বাগান ছিল মুগ্ধ করার মতোই। বার্ড ক্যা¤পাসে রয়েছে ব্যাংক, ডাকঘর, প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য মেডিকেল সেন্টার, ভিআইপি স্যুট, গেস্ট হাউজ, বন কুটির, রাণী কুটিরসহ ৭টি হোস্টেল। শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যাপিঠ হিসেবে রয়েছে শিশু বিতান বার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়। খেলাধুলাসহ বিনোদনের জন্য রয়েছে ক্রীড়া ও বিনোদন কেন্দ্র। রয়েছে এক গম্ভুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ এবং একটি আধুনিক গ্রন্থাগার।
বার্ডের ভেতরে পিছঢালা পথ ধরে সবাই এগুতে থাকলাম। উঁচু একটি স্থানে বসার জন্যে ঘাসবেষ্টিত জায়গার দেখা পেলাম। রোমান স্যারের বুনোজোঁক ভীতির কারণে সেখানে আর বসা হলো না। পরে নেমে এসে গেস্ট হাউজ ২-এর পাশে পাকা গোলচত্ত্বরে সবাই গোল হয়ে বসলাম। বসার উদ্দেশ্য ছিল কুমিল্লা ভ্রমণ নিয়ে মজার বক্তৃতা উপস্থাপন করা। সবাই সবার মতো করে রসাত্মক বক্তৃতা উপস্থাপন করলো। এতে উঠে এসেছে কারো কারো ছোটখাটো অভিযোগও। অভিযোগের পেক্ষিতে রোমান স্যার বললেন, একজন সুন্দর নারীর যদি একটি সুন্দর পা কেটে নেওয়া হয় তাহলে পাটাকে বিবস্ত্র মনে হবে। সুতরাং অনেক কিছুর সমন্বয়ে সৌন্দর্য তৈরি হয়। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের ভ্রমণটাও ছিল সৌন্দর্যে ভরা।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। ক্লান্ত সূর্য লুকিয়ে গেল গোধূলির খামে। আমাদেরও তাড়া বাড়লো নিজ গন্তব্যে ফেরার। সবাই বাসে এসে বসলো। মাগরিবের পর বাস ছাড়লো। আমরা গান উল্লাসে মেতে উঠলাম পুরোটি পথ।
অদম্য উচ্ছ্বাস আর মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে এলাম যে যার বাসায়।