‘কট্টরপন্থী বাংলাদেশী’দের ভিড়, হিন্দুরা ছাড়ছে পশ্চিমবঙ্গ: সিনেমার ট্রেলার বিতর্ক

আপডেট: মে ২৮, ২০২৩, ১২:৪৬ অপরাহ্ণ

‘দ্য ডায়েরি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’ ছবির ট্রেলারে আনা হয়েছে নানা বিতর্কিত বিষয়

সোনার দেশ ডেস্ক :


‘দ্য ডায়েরি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’ নামে একটি নির্মীয়মাণ হিন্দি সিনেমার ট্রেলারে বলা হয়েছে যে, সেখানে সরকারী মদতে রোহিঙ্গা এবং কট্টরপন্থী বাংলাদেশীদের বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়।
ট্রেলারের এক জায়গায় বলা হয়েছে ‘অসংগঠিত হিন্দুদের কাছে বাংলা এখন দ্বিতীয় কাশ্মীর হয়ে গেছে’।
পশ্চিমবঙ্গের ভাবমূর্তি নষ্ট করা হয়েছে ওই সিনেমার ট্রেলারে, কলকাতা পুলিশের কাছে এই অভিযোগ দায়ের হয়েছে। ত্রিশে মের মধ্যে পরিচালক সানোজ মিশ্রকে হাজির হতে হবে কলকাতা আমহার্স্ট স্ট্রিট থানায়।

তবে ওই পরিচালক বলছেন তিনি সত্য ঘটনা অবলম্বনে যথেষ্ট গবেষণা করেই ছবিটি বানাচ্ছেন।
ছবিটি প্রযোজনা করেছেন জিতেন্দ্র নারায়ণ সিং ত্যাগী যিনি ২০২১ সালের ৬ই ডিসেম্বর খুব ধূমধাম করে ইসলাম ধর্ম পরিবর্তন করে হিন্দু হয়েছেন।
তার ইসলামি নাম ছিল ওয়াসিম রিজভি। দীর্ঘ সময় তিনি উত্তরপ্রদেশের শিয়া সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন।
একসময়ে তিনি সমাজবাদী পার্টির নেতা ছিলেন, তবে দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে তিনি বিজেপি ঘনিষ্ঠ।

রোহিঙ্গা, ‘কট্টর বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী, ‘দ্বিতীয় কাশ্মীর’এর মতো বিষয় আনা হয়েছে সিনেমার ট্রেলারে
ট্রেলারের শুরুর দিকে বলা হয়েছে “গণতন্ত্রের অর্থ হল জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার। কিন্তু এর একটা দ্বিতীয় দিকও আছে: জনমত যদি মুসলমানদের হয়, তাহলে সেখানে শরিয়তি আইন চলে।“

এর কিছুটা পরেই বলা হয়েছে , “একসময়ে যে পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের ম্যাঞ্চেস্টার বলা হত, তা এখন গণতন্ত্রের ওই দ্বিতীয় পথেই হাঁটছে।“ যার অর্থ করা যেতেই পারে যে পশ্চিমবঙ্গে শরিয়তি আইন চলে।
“সীমান্তবর্তী এলাকাগুলি পুরোপুরি হিন্দুহীন হয়ে গেছে এবং সেখান দিয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা আর কট্টরপন্থী বাংলাদেশীরা ভারতে প্রবেশ করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে”, এমনটা বলা হয়েছে ওই সিনেমাটির ট্রেলারের নেপথ্য ভাষণে।

আবার আরেকটি দৃশ্যে দেখানো হয়েছে এক অভিনেতাকে যিনি কোনও এক গুরুত্বপূর্ণ হিন্দুত্ববাদী নেতার চরিত্রে অভিনয় করছেন বলে স্পষ্টই মনে হচ্ছে। তার মুখ দিয়ে এরকম সংলাপ বলানো হয়েছে, “মমতার এই রোহিঙ্গাদের প্রতি প্রেম হিন্দুদের বাধ্য করছে ঘর ছেড়ে চলে যেতে।“
যদিও ছবিটির পরিচালক সানোজ মিশ্র সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছেন যে ছবিটি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর সম্বন্ধে নয়।

ওই একই অভিনেতার আরেকটি দৃশ্যে তাকে এক নারীর সামনে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে আর তাকে দিয়ে এরকম সংলাপ বলানো হয়েছে যে “আপনি মেয়েকে নিয়ে দ্রুত ওখান থেকে বেরিয়ে যান। পশ্চিমবঙ্গে এখন কাশ্মীরের থেকেও খারাপ পরিস্থিতি।“
ট্রেলার শুরুর আগে লেখা হয়েছে যে সিনেমাটিতে দেখানো প্রতিটা ঘটনা এবং তথ্য সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত।

পুলিশের তলব পরিচালককে
দুই মিনিট ১২ সেকেন্ড দীর্ঘ ট্রেলারটি মাসখানেক আগে ইউটিউবে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কলকাতা পুলিশের কাছে এক ব্যক্তি ওই সিনেমার পরিচালক-প্রযোজকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করায় বিষয়টি জানাজানি হয়েছে।
ছবিটির পরিচালক সানোজ মিশ্র বলিউডে খুব পরিচিত নাম নয়।

তিনি সংবাদ সংস্থা এএনআইকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, “আমাদের ছবিটার ভিত্তিই হল তোষনের রাজনীতি। যে রাজনীতির ফলে ভোট ব্যাঙ্কের জন্য যা কিছু দরকার সেসবই করা হয় ওখানে। প্রতিটা ঘটনাই সত্য, গবেষণা করেই ছবিটা বানিয়েছি আমি। সব তথ্য আমার কাছে রাখা আছে।

“১১ মে আমার বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়। এরকম সব ধারা দেওয়া হয়েছে, যেন আমি একজন বড় ক্রিমিনাল।“
কলকাতায় পুলিশের সামনে এলে তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন মি. মিশ্র।
জেলে গেলে সেখান থেকে হয়তো তিনি নাও ফিরে আসতে পারেন, এমন মন্তব্যও করেছেন মি. মিশ্র। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি।

হিন্দুরা কি সত্যিই পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে পালাচ্ছে?
সিনেমার ট্রেলারে যেমনভাবে বলা হয়েছে যে পশ্চিমবঙ্গ দ্বিতীয় কাশ্মীর হয়ে গেছে, সেখান থেকে হিন্দুরা পালিয়ে যাচ্ছে, রোহিঙ্গা আর ‘কট্টরপন্থী বাংলাদেশী’দের সরকারী সহায়তায় বসবাসের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, সীমান্ত অঞ্চল পুরোপুরি হিন্দু শূন্য হয়ে গেছে বা হিন্দু উৎসব বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে – এর সঙ্গে বাস্তবের কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।

লেখক ও প্রাবন্ধিক রন্তিদেব সেনগুপ্ত বলছিলেন, এটা সম্পূর্ণভাবেই একটা প্রচারমূলক ছবি।
তার কথায়, “হিন্দুরা যদি পশ্চিমবঙ্গে এতটাই অসুরক্ষিত থাকত, তাদের এখান থেকে বিতারণ করা হয়, তাহলে প্রতিবছর হাজার হাজার রামনবমীর মিছিল কী করে করছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা বজরং দল? কীভাবে হিন্দুরা তলোয়ার সহ নানা অস্ত্র নিয়ে মিছিল করছে এই রাজ্যে?

“ওই উদগ্র মিছিলগুলো দেখলেই বোঝা যায় যে হিন্দুরা এখানে অসুরক্ষিত নয়, যেমনটা ওই সিনেমার ট্রেলারে বলা হয়েছে,” বলছিলেন মি. সেনগুপ্ত।
তিনি আরও বলছিলেন, “ট্রেলারে দেখলাম বলা হয়েছে যে এখানে নাকি দুর্গা পুজোয় বাধা দেওয়া হচ্ছে। সারা রাজ্যে যত দুর্গা পুজো হয়, তত সংখ্যায় উত্তরপ্রদেশ বা গুজরাত বা মহারাষ্ট্রে কোনও ধর্মীয় উৎসব হয় না।

এখানকার দুর্গা পুজো ইউনেস্কোর হেরিটেজ তকমা পেয়েছে। এধরনের ছবি সামাজিক হিংসা ছড়াতে পারে। নিষিদ্ধ করা উচিত এসব সিনেমা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নাম করে জাতিগত দাঙ্গা বাধিয়ে দেওয়ার অধিকার কারও নেই।“
সিনেমার ছাড়পত্র এখনও নেই, তবুও বিদ্বেষমূলক ট্রেলার?
সিনেমাটির পরিচালক সানোজ মিশ্র বলছেন যে তার ছবির ৬০ শতাংশ শুটিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে, তাই সেটি এখনও কেন্দ্রীয় ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের

ছাড়পত্র পাওয়ার পর্যায়ে যায় নি।
সবকিছু ঠিকঠাক চললে আগামী মাসে সেন্সর বোর্ডে ছবিটি যেতে পারে বলে তার আশা।
তবে সিনেমার ট্রেলারের জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। পুলিশ ওই প্ল্যাটফর্মের মালিককেও ডেকে পাঠিয়েছে।
সানোজ মিশ্র বলছেন, “ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ট্রেলার প্রকাশের জন্য কোনও অনুমতির প্রয়োজন হয় না।

কত মৌলানাদের উস্কানিমূলক ভাষণের ভিডিও-তো পাওয়া যায় অনলাইনে। কই তাদের বিরুদ্ধে তো এই পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয় না!”
দলের অন্যতম মুখপাত্র অরূপ চক্রবর্তী বলছেন, “ছবির পরিচালক গবেষণা করে পাওয়া তথ্যের কথা বলছেন, কিন্তু এখন তো হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির গবেষণাটাই বেশি চলে!”

ভারতে হিন্দুত্ববাদী ‘ইকো সিস্টেম’ হোয়াটস্অ্যাপের মাধ্যমে বিকৃত তথ্য ছড়িয়ে দেয়, এই অভিযোগ করে সেই ব্যবস্থাকেই ‘হোয়াটস্অ্যাপ ইউনিভার্সিটির তথ্য’ বলে ব্যঙ্গ করে থাকে বিরোধীরা।
মি. চক্রবর্তী আরও বলছিলেন, “একটা জনপ্রিয় বাংলা কবিতার লাইন মনে পড়ছে, যখনই জনতা চায় বস্ত্র ও খাদ্য, সীমান্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের বাদ্য। আসলে ভারতের মানুষ সিনেমা তো দেখছেন সেই ২০১৪ সাল থেকেই।

সবথেকে প্রান্তিক মানুষরা, যাদের ভরসা কেরোসিন তেল, তার দাম ১৪ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১০০ টাকারও বেশি। প্রান্তিক মানুষের না আছে খাদ্য, না আছে বস্ত্র না আছে কর্মসংস্থান। তাই যত লোকসভা নির্বাচন এগিয়ে আসবে, ততই মানুষের দৃষ্টি অর্থনৈতিক বিষয়গুলো থেকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হবে।“

বিজেপি যদিও বলছে যে তারা এই ছবির নির্মাণের সঙ্গে কোনও ভাবেই যুক্ত নয়।
তবে দলের তরফে মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য এটাও বলছেন যে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের নাম জড়িয়ে গেছে।

এখান থেকে জঙ্গি ধরা পড়েছে। সেটা কতটা সত্য, কতটা আংশিক সত্য, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু সিনেমাটিকে নিষিদ্ধ করে দেওয়ার প্রসঙ্গ চরম অগণতান্ত্রিক এবং স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতার প্রকাশ।
বিজেপি একথা বললেও ইউটিউব এবং টুইটারে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, তাহলে গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে বিবিসির তথ্যচিত্রটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল কেন!
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ