বৃহস্পতিবার, ৮ জুন, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ২৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
সালীমা সারোয়ার
‘সকাল সাড়ে ৯টা। রসায়ন প্রাইভেট শেষে বাড়ি ফিরছিল দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগে পড়–য়া চার মেধাবী শিক্ষার্থী কণিকা, তারিন, তানজিমা আর মরিয়ম আক্তার।
একটু এগুতেই পিছন থেকে তাদের ওপর হাঁসুয়া নিয়ে অতর্কিত হামলা করে আব্দুল মালেক নামের এক মাদকাসক্ত বখাটে যুবক। বখাটের এলোপাথারি কোপে কণিকা ঘটনাস্থলেই মারা যায়, মরিয়মের ডান হাত কাধ থেকে প্রায় আলাদা হয় এবং অন্য দু’জনও মারাত্মক আহত হয়।’ এটি কোন গল্প বা সিনেমার কাহিনী নয়। গত ২৭ মে শুক্রবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার মহিপুর এলাকায় ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা। এভাবেই সম্প্রতিক সময়ে সামজব্যবস্থার নানা ক্রটি, নিরাপত্তাহীনতা ও নানারূপ বৈষম্যের কারণে কণিকা, রিশা, ডালিয়াদের মত দেশের কন্যা শিশুরা নানাভাবে নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে। বর্বর কিছু ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও অধিকাংশই অপ্রকাশিত থাকে, দোষীদের বিরুদ্ধে তেমন কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গৃহীত হয় না। ফলে দেশে কন্যা শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে জনগণ উদ্বিগ্ন।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী পালিত হলো ১৬তম জাতীয় কন্যা শিশু দিবস। কন্যা শিশুর প্রতি লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য রোধে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুষ্ঠু বিকাশের বিষয়টিকে বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেয়ার লক্ষ্যে সরকার ২০০০ সালে ৩০ সেপ্টেম্বরকে ‘জাতীয় কন্যা শিশু দিবস’ ঘোষণা করে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার নানারূপ ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটলেও কন্যা শিশুদের অবস্থা ভালো হয়নি। সমাজ ব্যবস্থার নানা ক্রটি, নিরাপত্তাহীনতা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা ইত্যাদি নানা কারণে দিন দিন তাদের অবস্থা উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। এমনকী সন্তান জন্মদানে নারীর ভূমিকা না থাকলেও কন্যা সন্তান জন্মদানকারী মাকে নানারূপ দায় চাপানোর পাশাপাশি মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন ভোগ করতে হয়। তাই ভারতীয় কবি পাওনি মাধুরের বিখ্যাত উক্তি ‘ঝযব ধিং ঃযব শববঢ়বৎ ড়ভ ঃযব যড়ঁংব, নঁঃ ঃযব যড়ঁংব ধিং হড়ঃ যবৎ শববঢ়বৎ’ -কে অলীক সত্য মনে হয়।
বর্তমানে বাইরের নানা রকম বৈষম্য, নির্যাতন ও সহিংসতার ঝুঁকিতে থাকা কন্যা শিশুরা ঘরের মধ্যেও নানা রকম অন্যায় ও বৈষম্যের শিকার হয়। সমাজের পাশাপাশি পরিবারেও কন্যা শিশুর প্রতি অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। ফলে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দরিদ্রতার প্রথম শিকার হয়। কিছু সামাজিক কথিত নীতির কারণে শিশুকাল থেকেই তাদের অপ্রতিবাদী হতে শেখানো হয়। তাদের প্রতি করা সকল অন্যায়-অত্যাচার ও বৈষম্যকে সহজাত ও সমঝোতার সঙ্গে গ্রহণ করতে শেখানো হয়Ñ যা পরবর্তী সময়ে নারীর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতার পথটিকে প্রশস্ত করে।
সর্বশেষ আদমশুমারী-২০১৬ অনুযায়ী দেশে কন্যা শিশুর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৯১ লাখ ৮১ হাজার। এ বিপুল পরিমাণ সম্ভাবনাময় জনগোষ্ঠি সঠিকভাবে বিকশিত হতে পারলে দেশের সামগ্রিক ইতিবাচকতা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু নানা কারণে কন্যা শিশুরা পরিবার, সমাজ, কর্মজীবনসহ সর্বক্ষেত্রেই নানা প্রকার অন্যায়-অত্যাচার, নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে। প্রায় পরিবারে একটি মেয়ের জন্ম সুসংবাদের হয় না। জন্মের পর থেকেই পরিবারে শুরু হয় নানা প্রকার বৈষম্য। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান- এ পাঁচ মৌলিক চাহিদাসহ সকল চাহিদা পূরণে বৈষম্যের শিকার হতে হয়। কোন প্রতিবাদ করলে হতে হয় নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার। একটু বড় হলেই সর্বত্রই শারীরিক, মানসিক নির্যাতনসহ নানা ধরনের যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়। অথচ এজন্য প্রায়ই ভিকটিমকে দায়ী করা। আমাদের দেশের কন্যা শিশুরা প্রতিনিয়ত অপুষ্টি ও বাল্যবিয়ের শিকার হয়। আইসিডিডিআরবি ও প্লান বাংলাদেশ পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, এসএসসি ও এইচএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করা ২৬ শতাংশ নারীর বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়স হওয়ার পূর্বে। নিরক্ষর নারীদের বেলায় এ হার ৮৬ শতাংশ। যা তাদের ওপর পরিবার থেকে অব্যাহত থাকা আধিপত্য ও হয়রানির মাত্রাকে আরো প্রসারিত করতে থাকে।
সরকারি- বেসরকারি নানা উদ্যোগের ফলে নানা ক্ষেত্রে কন্যা শিশুদেও অগ্রগতি হলেও নারী শিক্ষার প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, পারিবারিক নানা কাজ ও চাপের দায়ভার, নিরাপত্তাহীনতা, বাল্যবিয়ে ও অপুষ্টির কারণে তারা নানা প্রকার সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। গত দেড় বছরে ২৪ জন কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যাদের বয়স তিন বছরের নিচে।
আমরা মনে করি যে, কন্যা শিশুদের এমন অবস্থা দেশের সার্বিক ইতিবাচকতার পথে অন্যতম প্রধান অন্তরায়। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে কন্যা শিশুদের জন্য সামাজিক দায়বদ্ধতা ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যে কোন প্রকার অব্যবস্থাপনার সাথে জড়িতদের কার্যকর শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে কন্যা শিশুদের প্রতি হওয়া নির্যাতন ও সহিংসতা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। বাল্যবিয়ে, যৌতুক প্রথা, যৌন হয়রানিসহ সকল প্রকার অনাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। সরাকারের পাশাপাশি জনগণের মধ্যে জনসচেতনতা তৈরিতে সকল গণমাধ্যমকে কার্যকরি ভূমিকা পালন করতে হবে বলে আমরা মনে করি।
*সালীমা সারোয়ার, উন্নয়ন ও মানবাধিকার কর্মী।