কন্যা শিশুর বিয়ের বয়স ১৮’র কম নয়

আপডেট: ডিসেম্বর ২৬, ২০১৬, ১২:৩১ পূর্বাহ্ণ

সালীমা সারোয়ার


নিপা (১৭)। পুরো নাম শারমিন আক্তার। জেলা শহরের অর্ধশিক্ষিত বাবা-মায়ের জেএসসি ও পিএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া নিপার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হয়ে জনসেবা করা। কিন্তু পাড়ার বখাটেরা বাধ সাধে। বখাটেদের অব্যাহত উত্ত্যক্তের জেরে বাধ্য হয়েই বাবা-মা দুই বছর আগে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই নিপার বিয়ে দেয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেকটা বাধ্য হয়েই সব স্বপ্ন বির্সজন দিয়ে নিপা সংসার করতে স্বামীর ঘরে যায়। কিছুদিন পরেই যৌতুকের জন্য তার উপর শুরু হয় অত্যাচার ও নির্যাতন। একই সাথে শুরু হয় পেঁট ও মাথায় প্রচ- ব্যথাসহ নানা রোগ। শারীরিক অসুস্থতা ও যৌতুকের টাকা দিতে না পারায় নিপাকে তালাক দেয় তার স্বামী। এখন অসুস্থ নিপা বাবার বাড়িতে। গত দুই বছর আগে হওয়া বাল্যবিয়ে তার জীবন, স্বপ্ন ও পরিবারকে শেষ করেছে। এভাবেই বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে লাখ লাখ মেয়েকে বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে জীবনের নির্মমতায় পড়তে হয়। এতে শুধু তাদের জীবন নয় বরং পুরো সমাজকে নেতিবাচকতায় পড়তে হয়। বাল্যবিয়ের সর্বোচ্চ হারের দিক থেকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম এবং বিশ্বে তৃতীয়। এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সামাজিক সমস্যা।
এতকিছু সত্ত্বেও সম্প্রতি দেশে বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত নতুন খসড়া আইন তৈরি হয়েছে। নতুন খসড়া আইনের মূলভাব হলো ‘ছেলেদের বিয়ের বয়স ২১ বছর এবং মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর। তবে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে ‘সর্বোত্তম স্বার্থে’ আদালতের নির্দেশে মা-বাবা’র সম্মতিতে ১৮ বছর বয়সের আগেই মেয়েদের বিয়ে দেয়া যাবে।’ দেশের অন্যান্য মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠনের মতো আমরাও বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত নতুন এ খসড়া আইনের ধারা ১৯ এর বিশেষ ধারাটির বিরোধিতা করি এবং মেয়েদের বিয়ের বয়স শর্তহীনভাবে ১৮ বছর রাখার দাবি জানাই।
কারণ জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) ২০১৬ সালের তথ্যানুযায়ী বাল্যবিয়ের পরোক্ষ প্রভাবে দেশে প্রতি বছর ২৩ হাজার শিশু মারা যায়। আইসিডিডিআরবি ও প্লান বাংলাদেশের এক গবেষণায় দেখা যায় যে, দেশে প্রতি বছর ২৩ লক্ষ ৫৯ হাজার মেয়ে বিয়ে দেয়া হয়। এখানে প্রতি দশ জন মেয়ের মধ্যে সাত জনের বিয়ে ১৮ বছর বয়সের আগে হয়। বিবাহিত মেয়েদের মধ্যে শতকরা ৬৬ ভাগের বিয়ে ১৫ বছর বয়সের আগে হয়। আবার তাদের মধ্যে শতকরা ২৯ ভাগে মেয়ের বিয়ে ১৪ বছর বয়সের আগে হয়। এ দুই প্রতিষ্ঠানের ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের উপর করা এক যৌথ সমীক্ষা অনুযায়ী, এখানে প্রতি তিনজন মেয়ের মধ্যে দু’জনের বিয়ে ১৮ বছর বয়সের আগে হয়। পারিবারিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যু হওয়া নারীদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগের বয়স ১৮ বছরের নিচে। সন্তান জন্মদানকালে এরূপ মা ও তাদের সন্তানের মৃত্যুঝুঁকির মাত্রা পরিণত বয়সী মায়ের তুলনায় শতকরা ৫ ভাগ বেশি। সেভ দ্য চিলড্রেন’র সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বস্তির ৮০ শতাংশ কন্যাশিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয়। বাল্যবিয়ে শিশুদের বিকাশে একটি বড় বাধা। এর ফলে নারী সমাজের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও স্বাস্থ্যসহ সকল ক্ষেত্রে আমরা যতই উন্নতি করি না কেন, বাল্যবিয়ের কারণে তা নড়বড়ে হয়ে উঠতে পারে। বাল্যবিয়ের শিকার কিশোর-কিশোরীদের ওপর অল্প বয়সে সংসার-সন্তানের ভার এসে পড়ে। এতে তারা দিশাহীন হয়ে পড়ে। যৌতুক, সাংসারিক কাজকর্ম, বোঝাপড়া অভাব ইত্যাদি নানা কারণে পারিবারিক অশান্তি তৈরি হয়, অনেকে আত্মহত্যা করে। ফলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়। বাল্যবিয়ের ফলে কিশোর-কিশোরীরা নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়ে। যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরিপূর্ণ জ্ঞান না থাকায় নানা রকম স্বাস্থ্য সংকট তৈরি হয়। কিশোরীরা অল্প বয়সে গর্ভধারণ করায় তাদের স্বাস্থ্য বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। তাদের জন্ম দেয়া সন্তানেরও নানা সমস্যা নিয়ে বাঁচে। এসব শিশুরা অপুষ্টি, ওজনহীনতা ও মানসিক-শারীরিক বিকলাঙ্গের শিকার হয়, অনেক মা-শিশু মারাও যায়। এক গবেষণার তথ্যানুযায়ী, দেশে প্রতিবছর গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবকালীন সমস্যার কারণে ৬০ হাজার বাল্যবধূ মারা যায়। বাংলাদেশ জনমিতিক ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস)-২০১৪ অনুযায়ী, কিশোরীদের জীবিত সন্তান জন্মদানের হার প্রতি হাজারে ১১৩, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। আর, বিবাহিত কিশোরীদের জন্ম নিরোধক সামগ্রী ব্যবহারের হার (সিপিআর) ৪৭ শতাংশ, যা জাতীয় সিপিআরের চেয়ে কম। বাল্যবিয়ের ফলে কিশোর-কিশোরীদের নানা স্বাস্থ্য জটিলতা তৈরি হয়। এতে তাদের সার্বিক বিকাশ ব্যাহত হয়। যা দীর্ঘমেয়াদী দুর্ভোগ তৈরি করে। এক গবেষণায় দেখা যায়, শিশু বয়সে বিবাহিত নারীদের পাঁচ বছরের কম বয়সী সন্তানের মৃত্যুহার শতকরা ১৬ ভাগ, যা প্রাপ্ত বয়সে বিবাহিতদের ক্ষেত্রে মাত্র শতকরা ১০ ভাগ। একইভাবে শিশু বয়সে বিবাহিত নারীদের সন্তানের জন্মের ২৭ দিনের মধ্যেই মৃত্যুরহার সবচেয়ে বেশি (৭০%)। এক গবেষণায় দেখা যায়, শিশু বিয়ে প্রভাবে ৮৬ শতাংশ শিশু স্কুল থেকে ঝরে পড়ে, যা প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে মাত্র ৫৪ শতাংশ। এভাবে বাল্যবিয়ের প্রভাবে কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষাজীবন অপূর্ণ থাকছে এবং অনিশ্চয়তার পড়ছে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ।
আমরা মনে করি যে, ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ে দেয়ার অর্থ হলো- মেয়েদের অবরুদ্ধ করার ক্ষেত্র তৈরি করা। নারী শিক্ষার হার কমানো এবং স্কুলে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার বাড়ানো। সমাজে অশিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত নারীর সংখ্যা বাড়িয়ে পশ্চাদপদ অবৈজ্ঞানিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। মেয়েদের ব্যক্তিত্ব ও মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে বাধা প্রদান করা। অল্প বয়সে বিয়ের ফলে স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে পারিবারিক সাংসারিক অবকাঠামোতে জীবনের শিক্ষার সময়টা কাটিয়ে দেবার ফলে সমাজ, রাষ্ট্র, পৃথিবী ও মহাবিশ্ব সংক্রান্ত জ্ঞান অর্জন থেকে বঞ্চিত করা। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী ও কন্যা শিশু। তাই কন্যা শিশুদের অল্প বয়সে বিয়ে মানেই তাদের সুশিক্ষিত ও সুনাগরিক  হবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা। যা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। জ্ঞান, বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা কম থাকা অপ্রাপ্ত বয়স্ক একটি মেয়ে পারিবারিক ঝামেলা সামলাতে না পারার কারণে পারিবারিক কলহ-বিবাদ তৈরি হয়। এতে সমাজে নারীর প্রতি পারিবারিক নির্যাতন ও সহিংসতা, আত্মহত্যা, হত্যা ও হত্যার চেষ্টাসহ নানা প্রকার নির্যাতন ও অত্যাচার বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। সম্প্রতি এমনি একটি ঘটনা ঘটেছে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার বেতকাপা ইউনিয়নের মাঠেরহাট হরিপুর গ্রামে। ওই গ্রামের আব্দুল গোফফার মিয়ার অষ্টম শ্রেণি পড়–য়া মেয়ে সুমি আকতার (১৪) প্রেমের টানে পরিবারের অমতে আট মাস আগে ১৩ বছর ৪ মাস বয়সে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। বিয়ের কিছুদিন পরই দাম্পত্য কলহে তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। অবশেষে বাবার বাড়িতে ফিরে আসে। কিন্তু অল্প বয়সের প্রেম ও বিয়ে তাকে অনেক বদলে দেয়। পরে গত ১৭ ডিসেম্বর দুপুরে সে আত্মহত্যা করে।
মেয়েদের বিয়ের বয়স হ্রাস করার অর্থ হলো পরিবারে অর্থনৈতিক উপার্জনে নারীর অংশগ্রহণে বাধা তৈরি করা। এর ফলে অর্থনীতিতে নারীর অবদান হ্রাসের সাথে পারিবারিক দরিদ্রতা ও জাতীয় আয় হ্রাস পাবে। মা যদি অল্প শিক্ষিত ও অশিক্ষিত থেকে যায় তাহলে তার সন্তানকে সুশিক্ষিত করে তোলা সম্ভব হবে না। ফলে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারে পতিত হবে। আমরা জানি বিয়ের উদ্দেশ্য শুধু বাচ্চা উৎপাদনই নয় বরং সুশৃঙ্খল, শান্তিপূর্ণ  ও নিরাপদ জীবন পরিক্রমা। কিন্তু অল্প বয়স্কা নারীর পক্ষে এর কোনটি সম্ভব? এ আইন পাস হলে আমরা লন্ডনের গার্ল সামিটে গিয়ে কী করব? জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার দলিল কিংবা বেইজিং সম্মেলন দিয়ে কী হবে? বাল্যবিয়ের মাধ্যমে তাদের জীবন পরিক্রমায় দেয়াল দিয়ে বিকাশ-বিস্তারে বাধা তৈরি করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কীভাবে সম্ভব? আমাদের সংবিধানে নারী উন্নয়নমূলক ধারা ও বিধি-বিধান যত কিছুই থাকুক না কেন, যৌন নির্যাতন আইন ও  নারী নির্যাতন দমন আইনসহ যত আইন সবই অর্থহীন হবে। এ আইনটি পাস হলে সমাজে নারীরা নতুন সংকটে পড়বে। এ আইনের বিশেষ পরিস্থিতি’র বিধানটি অপব্যবহার বাড়বে এবং এর সুযোগ নিয়ে বাবা-মা, কাজি, সমাজের সুযোগ সন্ধানীদের দৌরাত্ম বাড়বে। এ আইনের মাধ্যমে সমাজে নারীদের ‘না’ বলার ক্ষেত্র আরো প্রসারিত হবে এবং এভাবে নারীরা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হবেÑ যা নারী ও কন্যা শিশুদের তথা দেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা তৈরি করবে।
সুতরাং, আমরা মনে করি নারী ও কন্যা শিশুদের সাথে দেশের সামগ্রিক ইতিবাচকতা জড়িত। তাই বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত নতুন খসড়া আইনের  বিশেষ পরিস্থিতিতে  অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের বিয়ের বিধানটি বাতিল করা দরকার। যে সর্বোত্তম স্বার্থের কথা বলা হচ্ছে তা প্রকৃত পক্ষেই যাদের বিয়ে হচ্ছে তাদের স্বার্থেই এ আইন হওয়া দরকার। আর শাস্তির ক্ষেত্রে আরও কঠোর হওয়া দরকার বলে আমরা মনে করি। কেননা অল্প বয়স্ক নারীর বিয়ে মানেই তাকে সব অধিকার ও স¦াধীনতা থেকে বঞ্চিত করে একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ করা। যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার নিজস্ব-পরিপার্শ্বিক জীবনকে নষ্ট করবে। তাই বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সামাজিক সমস্যা বলে স্বীকৃত বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে আইনের শিথিলতা দূর করে এটি প্রতিরোধে জনগণ, প্রশাসন ও সরকারসহ সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে বলে আমরা মনে করি।
লেখক: উন্নয়ন ও মানবাধিকার কর্মী।