রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ৯ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
রাজিউদ্দীন আহ্মাদ
আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি ঠান্ডা যে সব এলাকায় পড়ে তাদের মাধ্যে রাজশাহী একটাÑ সেখানে আমার বাড়ি। আমি অবশ্য ছোটবেলা থেকেই অন্যদের চেয়ে ঠান্ডা একটু বেশিই সহ্য করতে পারতাম। ছোট বেলায় আমার আব্বা আমাকে আদর করে কখনও কখনও মহিষের সক্সেগ তুলনা করতেন। সেই আমি প্রথমবারের মতো শীতে কাবু হয়ে পড়েছিলাম পেশোয়ারেÑ তখন আমার বয়স ২৫। বাংলাদেশের শীত যে কোনো শীতই নয় তা প্রথম অনুভব করেছিলাম। পেশোয়ারে সেদিন তাপমাত্রা নেমেছিল শুন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসে। শীতের অনেক পোষাক-আসাক পরা থাকলেও আমার কাছে মনে হচ্ছিল সমস্ত কাপড়-চোপড় আর চামড়া ভেদ করে শীত গিয়ে পৌঁছাচ্ছিল হাড়ের মধ্যে Ñ তুষারপাত হচ্ছিল না। তুষারপাত বা আগে তুষারপাত হওয়ার কারণে বরফ জমে থাকা কখনও দেখি নি Ñ কেবল সিনেমায় দেখেছি আর ভেবেছি, কী মজা! Ñ তাই তুষারপাত দেখার শখ! সেই শীত ও তুষারপাত দুটোই দেখলাম কানাডাতে এসে। পৃথিবীর আরও বহু দেশে তুষারপাত হয়, কিন্তু সে সমস্ত দেশে আমার যাওয়া হয় নি।
যদিও আবহাওয়া বিষয়ক অনেক তথ্যই আমার জানা আছে কিন্তু তুষারপাত নিয়ে গভীরভাবে কখনও চিন্তা করি নি। জানতাম যে, তাপমাত্রা হিমাক্সেকর ১০/১৫ ডিগ্রি নিচে না নামলে তুষারপাত হয় না। তা ছাড়া, কেবল তাপমাত্রাই নয় তার সক্সেগ আরও অন্যান্য বিষয় মিললেই তবে তুষারপাত সম্ভব। সে বিষয়গুলোর মধ্যে আপেক্ষিক আর্দ্রতা (ধারণ ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ) অন্যতম প্রধান; সক্সেগ, বাতাসের গতি-প্রকৃতি, পূর্বের দিনের আবহাওয়া এমন আরও নানান বিষয় জড়িত। কানাডায় আসার পরে তুষারপাত নিয়ে কিছু চিন্তা-ভাবনা করি, কিছু তথ্যও জানতে পারি। জানতে পারি পূর্বের জানাগুলো পুরোপুরি ঠিক না হলেও একেবারেই ভ্রান্ত নয়। দেখেছি, মাইনাস দু-চার ডিগ্রিতেও কখনও কখনও তুষারপাত হয়, আবার মাইনাস দশ ডিগ্রিতে তুষারপাত হয় না। তার মানে তুষারপাতের জন্য অন্যান্য শর্তগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে, এখানে তুষারপাত কেন হয়, আমাদের দেশে কেন হয় না Ñ এ নিয়েও ভাবতে থাকি। যাহোক, এটা অন্য প্রসক্সগ, আমরা দেখবার চেষ্টা করব, অতিরিক্ত ঠান্ডা ও তুষারপাতের কারণে কী কী হতে পারে।
হতে পারে এবং হয় তো অনেক কিছুই! আমাদের দেশে যেমন একাধারে সপ্তাহধরে বৃষ্টি লেগে থাকলে বা গাজল নামলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয় তেমনি এখানে মাঝে-মধ্যেই তুষারপাতের জন্য মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিসহ হয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে তো স্টেট অব ইমার্জেন্সি ঘোষণা দিতে হয়; সেনাদল নামাতে হয় বরফ পরিষ্কার করার জন্য। তুষার ঝড় তো আরও মারাত্মক, এই সময়ে তাপমাত্রা আরও কমে যায়। মাটিও নাকি জমে যায়। এখানে একটা ভবনের ভিত্তি নাকি দিতে হয় ভূপৃষ্ঠ থেকে অন্তত ৭ ফুট নিচে কারণ ৭ ফুট পর্যন্ত মাটি ঠান্ডায় জমে যেতে পারে। আর মাটি জমে গেলে তা ভিত্তির উপরে চাপ সৃষ্টি করবে Ñ তাতে ভিত্তি ভেক্সেগ যেতে পারে।
(এখানে একান্তে একটা কথা বলে রাখি। এদেশের থারমোমিটারে গ-গোল আছে কিনা আমি জানি না, কিন্তু আমার শরিরে যে ঠান্ডা অনুভব করেছি তাতে মনে হয় নি যে যতো তাপ আবহাওয়া অফিস বলেছে তা ঠিক। সবসময়ে মনে হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। আর বেশি ঠান্ডাগুলো (-১০, -১৫ ইত্যাদি) সম্পর্কে তো কোনো পূর্বধারণা নেই, সুতরাং সে সবগুলো অনুধাবনের বাইরে।)
এক ছোট-খাটো তুষার ঝড়ের দিনে গাড়িতে করে ওকভিল থেকে থান্ডার বে রওনা হয়েছি Ñ ১৫/১৬ ঘন্টার ড্রাইভ। সক্সেগ মেয়ে শিখা, ওর মা এবং আরও একজন। তুষার ঝড়ে তুষারপাত দেখা যাচ্ছেÑ তুষার কণাগুলো উড়ে উড়ে বহুদূরে গিয়ে পড়ছে। চারিদিক শুকনাÑ গাড়ির অইপার ব›ধ। রাস্তার বেশি দূর দেখা যাচ্ছে না। ঝড়ের গতিও দৃশ্যমান, কিন্তু রাস্তার পাশের গাছ-পালাগুলো দেখে ঝড়ের কোনো আলামত চোখে পড়ছে না। তারা ¯িথর দাঁড়িয়ে, কোনো প্রকার হেলা-দুলা নেই। এমন কি তার ডাল-পালা বা পাতাগুলোও ¯িথর। বেশ আশ্চর্য হয়ে দেখছি আর চিন্তা করছি তবে কি ঝড়ের তীব্রতা তেমন নেই! কিন্তু গাড়ির জানালা দিয়ে যে তুষারপাত দেখা যাচ্ছে তা দেখে মনে হচ্ছে ঝড়ের গতি নেহায়েত কম নয়।
এ বিষয় নিয়ে কথা বলতেই শিখা বললো, গাছগুলো হয়তো ঠান্ডায় জমে আছে। ভাবলাম, তাই তো, গাছগুলো তো জমে থাকারই কথা! যদি তাই হয়, তবে তারা অত্যন্ত শক্ত ও অনমনীয়, তাদের বাঁকা করা খুব কঠিন। বাতাসের ধাক্কা যদি তারা সহ্য করতে না পারে তবে ভেক্সেগ যাবে কিন্তু বাঁকা হবে না। গাড়ির বাইরে তখন তাপমাত্রা শুন্যের নিচে প্রায় ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর চেয়ে বেশি তাপমাত্রায় (-১৫ ডিগ্রি) আমাদের ডিপফ্রিজের মধ্যে সব কিছু জমে পাথর হয়ে থাকে। কথাটা তাই যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য মনে হলো। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এসে যায়, গাছগুলো এতো শীতে বেঁচে থাকে তো?
ঠান্ডায় জমে থাকা গাছগুলো কিন্তু মরে যায় না। একে উদ্ভিদবিদগণ উদ্ভিদের হাইবারনেশন বলেন কি না জানি না। তবে না বললেও, এ-ও এক ধরনের হাইবারনেশন বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। পুরো শীতকালটা তারা এ রকম জমে থাকে, নড়া-চড়া করে না কিন্তু গ্রীষ্মের একটুখানি ছোঁয়া পেলেই তারা উজ্জীবিত হয়ে উঠে এবং দ্রুত গতিতে কাজ শুরু করে দেয়। মনে হয় যেন, যে সময়টা ঠান্ডায় জমে থেকে নষ্ট হয়েছে সেটা পুষিয়ে নেয়ার একটা প্রচেষ্টা। যে সমস্ত গাছে পাতা নেই তাদের পাতা বেরিয়ে যায় সপ্তাহের মধ্যেই, এমন কি ফুলও ফুটে যায় দশ থেকে পনেরো দিনের মাঝেই। অদ্ভূত এক দ্রুত গতিতে কাজ করতে থাকে এই উদ্ভিদ জগৎ।
হায়বারনেশন অর্ধমৃত অব¯থায় এক ধরনের দীর্ঘ ঘুম। আমাদের দেশে কেবল সাপ-ব্যাঙের মতো ঠান্ডা রক্তের কিছু প্রাণী শীতকালে হাইবারনেশনে যায়। শীতের প্রকপ থেকে বেঁচে থাকার একটা প্রাকৃতিক উপায় এটা। (পাখিরা তো উড়ে অন্য যায়গায় গিয়ে প্রাণ রক্ষা করে; কিন্তু গাছ! তারা তো চলাচল করতে পারে না যে পাখিদের মতো মাইগ্রেট করে প্রাণ রক্ষা করবে!) কিন্তু এ দেশে আরও অনেক প্রাণী হাইবারনেশনে যায়। ভাল্লুক তো হাইবারনেশনের মধ্যেই বাচ্চা প্রসব করে! সাপ, ব্যাঙ, ইদুর এমন কি কাঠবেড়ালিও হাইবারনেশনে চলে যায়। এই হায়বারনেশনের মাঝে অবশ্য প্রকারভেদ আছে। প্রাণীকূলে হায়বারনেশন প্রধানত দুই প্রকারÑ একটাকে বলা হয়…, না থাক, এগুলো এ বিষয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য তোলা থাক।
এ দেশের গাছগুলো খুব মোটাসোটা নয় কিন্তু অত্যন্ত শক্তÑ এগুলোর কাঠ দিয়েই বাড়ি-ঘর বানানো হয়, বেশ মজবুত। এমনিতেই শক্ত তার উপরে ঠান্ডায় জমে থাকা। তাকে আর নড়ানো যায় না। আজকাল বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশে মাছ-মাংস ফ্রিজ্ড অব¯থায় বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। আমাদের দেশের মতো বাজারে টাট্কা মাছ-মাংস পাওয়া যায় এমন দেশের সংখ্যা এখন খুবই কম। কানাডাও তেমনি একটা দেশ। এখানে মাছ-মাংস কিনতে হয় ফ্রিজ্ড, কেটে টুকরো করতে হয় করাত (সাধারণত ইলেকট্রিক করাত) দিয়ে। নরম টিস্যুর মাছ-মাংসের অব¯থা যদি এই হয় তবে শক্ত কাঠ যখন জমে যাবে তখন তার অব¯থা কী হবে তা সহজেই অনুমেয়। আমার ধারণা, হিমায়িত অব¯থায় করাত দিয়েও ওই সমস্ত গাছ কাটা বেশ কষ্টসাধ্য।
আমাদের দেশের সাধারণ গরিব মানুষের মতো এ দেশের গাছ, তা ছোট হোক আর বড় হোক, অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু। ঘাসের কথাই ধরা যাক। এদের উপর ১০/১৫ ফুট বা তারও বেশি উঁচু হয়ে বরফ জমে থাকে মাসের পর মাস, তারপরেও তারা বেঁচে থাকে। বরফ গলে যাওয়ার পরে একটু রোদ পেলেই তারা সবুজ হয়ে যায় দ্রুত গতিতে। বাড়তেও থাকে অকল্পনীয়ভাবে এবং ৩০/৪০ ডিগ্রি (সে) তাপেও সাধারণত তারা পুড়ে যায় না। লতা-গুল্ম, ঝোঁপ-ঝাড়ের মতো গাছগুলোও তাই; শীতের সময় দেখে বুঝবার উপায় থাকে না যে তারা জীবিত, কিন্তু একটু রোদ পেলেই চমৎকার পাতায়-ফুলে ভরে যায়।
অদ্ভূত এই জীব বৈচিত্র এবং প্রকৃতির সক্সেগ তাদের বোঝাপড়া! আমরা অনেক সময় বিস্মিত হই এই ভেবে যে, নদি-নালা বা সমুদ্রের নিচে গাছ কেমন করে হয় বা বেঁচে থাকে! মাছ বা জলজ প্রাণী কেন ডাক্সগায় এলে মারা যায়, বা মানুষ বা ডাক্সগার প্রাণী কেন জলে ডুবে মরে! এরা সবাই তাদের নিজ নিজ পরিবেশের সক্সেগ বাঁচতে শিখেছে প্রাকৃতিক নিয়মে। তারা ওইভাবে বেঁচে থাকতেই অভ্যস্ত। মানুষ বু™িধমান প্রাণী হিসেবে এইগুলি বুঝতে শিখেছে। কল্পনা করতে পেরেছে, বৃহস্পতি বা শনির কোনো উপগ্রহে ভূপৃষ্ঠের নিচে জলের মধ্যে সম্ভাব্য প্রাণীর অস্তিত্ব। সেখানে না আছে আমাদের মতো বাতাস, না আছে আলো।
যাকগে, আমরা বোধহয় আমাদের মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছিলাম। এই শীতের দেশের গাছপালাগুলোর এমন অদ্ভূত বিচিত্র চরিত্র আছে যা আমাদের বিস্মিত করে। এদের গাছগুলোর মধ্যে কিছু গাছ আছে যাদের পাতা শীতেও ঝরে পড়ে নাÑ সবুজ থাকে, এরা চির সবুজ। আবার অধিকাংশ ফুল প্রায় সারা গ্রীষ্ম টিকে থাকে, দীর্ঘজীবি বলা যায়। বিচিত্র রঙের অত্যন্ত সুন্দর সুন্দর ফুল আছে এ দেশেÑ বেশির ভাগই দীর্ঘ দিন ধরে ঠিকে থাকে। এরা জানে যে, গ্রীষ্ম এখানে স্বল্প¯থায়ী সুতরাং সপ্তাহে সপ্তাহে ফোটার অবকাশ নেই, তাই একবার ফুটেই থেকে যায় সারা গ্রীষ্ম।
তুষার বিষয়ে আপেক্ষিক অনুভুতি নিয়ে দুটো কথা বলেই কানাডার শীত নিয়ে কথা বলা আজকের মতো শেষ করব। কানাডার বরফ গরম। বিষয়টা কিছুটা আজব শুনালেও আসলে কিন্তু সত্যি। কারণ, ঠা-া-গরম বিষয়টা হচ্ছে জৈবিক অনুভূতির বিষয়। আমাদের অনুভূতি যখন বাতাসের -১০ বা -১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সক্সেগ যু™ধ করছে তখনও কিন্তু বরফের তাপমাত্রা ০ ডিগ্রি (পানির তাপ শূন্যের নিচে নামে না) অর্থাৎ বাতাসের চেয়ে ১০ বা ১৫ ডিগ্রি উত্তপ্ত! তাই ওই হাত দিয়ে যখন বরফ স্পর্শ করি তখন বরফকে গরম মনে হয়Ñ আরামও পাওয়া যায়। সংখ্যা দিয়ে বিচার করলে উভয়েই ঠা-া কিন্তু অনুভূতি দু ধরনের। এ কারণেই প্রতিবছর কানাডার একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ (বিশেষ করে ছোটরা) ফ্রস্ট বাইটে তাদের অক্সগ নষ্ট করেÑ কেটে ফেলতে বাধ্য হয়। অনেকে গ্যাংরিন হয়ে মারাও যায়।
লেখক : স্থপতি