রবিবার, ৪ জুন, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ২১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
শুভ্রারানী চন্দ
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গীপাড়ায় এক মাহেন্দ্রক্ষণে জন্ম নেন শেখ মুজিবুর রহমান। গ্রামবাসীর কাছে পরিচিত ছিলেন খোকা নামে। ছোট বয়সেই তিনি ছিলেন সকলের নয়নের মনি। মানুষকে ভালোবাসার এবং মানুষের ভালোবাসা পাবার এক ঈর্ষণীয় ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা ছিল তাঁর। ছাত্রজীবন অর্থাৎ স্কুলজীবন থেকেই তাঁর ভেতরে নেতৃত্বের গুণাবলি দৃশ্যমান হয়। সত্য ও ন্যায়ের পথে তাঁর ছিল দৃপ্ত পদচারণা। দাবি আদায়ের সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন অকুতোভয় এ মহামানব। তাঁর সৌম্য চেহারা, বুদ্ধিদীপ্ত আলাপচারিতা সময়োচিত, সাহসী ও বলিষ্ঠ ভূমিকা, জনকল্যাণে নিবেদিত প্রাণ, সাংস্কৃতিক চেতনা ও মূল্যবোধ, অসাম্প্রদায়িক, উদার ও মহৎ চিন্তা, দুর্বল, অসহায় ও নিপীড়িত মানুষের প্রতি গভীর মমতা ও সহানুভূতি, অন্যায়-অত্যাচারের প্রতি আপোষহীন বলিষ্ঠ ও প্রতিবাদী কণ্ঠ, ফুলের মত কোমল মন মানুষকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করেছে চুম্বকের মতো।
তাঁর অসীম সাহস প্রকাশিত হয় স্কুলজীবনে মন্ত্রী মহোদয়ের পথ রুদ্ধ করে স্কুল হোস্টেলের ছাদ মেরামতের দাবি পেশ করার ভেতর দিয়ে। নির্ভিক চিত্তে দৃপ্ত পদক্ষেপ, অসংকোচে অন্যের মঙ্গল ভাবনায় তিনি ঝাঁপিয়ে পড়তেন, অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। তাঁর রক্তে ছিল দেশপ্রেমের এক অমোঘ টান। দেশকে ভালোবেসে দেশের দরিদ্র, নিপীড়িত, শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সব সময় সোচ্চার ছিলেন তিনি। মানুষের প্রতি ছিল তাঁর গভীর মমতা ও ভালোবাসা। দুঃখী মানুষের দুঃখ-দুদর্শার অবসান, ক্ষুধামুক্ত, শোষণহীন যে সুন্দর সমাজ, জাতি ও দেশের স্বপ্ন তিনি দেথতেন তার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে গেছেন তিনি। মানুষের প্রতি ছিল অগাধ বিশ্বাস এবং সে বিশ্বাসই তাঁকে অকালে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে বাধ্য করে। মহান নেতা ছিলেন তিনি। তিনি কূটনীতি বুঝতেন না এবং বুঝতে চাননি। মীরজাফররা তাঁর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে এ দেশকে নেতৃত্বশূন্য করেছিল।
নেতৃত্ব নতুন করে জন্ম নিলেও ওই শূন্য জায়গাটি কোনদিনই পূরণ হবার নয়।
তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল মোহনীয় যাদু। যে কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত প্রতিটি কথা তৈরি করত নতুন নতুন সৃষ্টি, উদ্দীপনা ও দিকনির্দেশনা। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সংগে সম্পৃক্ত হন ঘনিষ্টভাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায়ই তাঁর ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেন নি কখনো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের প্রতি বৈষম্যের প্রতিবাদ করায় তিনিসহ আরো কয়েকজন ছাত্রের ছাত্রত্ব বাতিল করা হলেও অন্যরা মূচলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব ফেরত পেলেও শেখ মুজিব তা করেন নি। এটা ছিল তাঁর জন্য লজ্জাস্কর ও অপমানজনক। ফলে তাঁর লেখাপড়ার পরিসমাপ্তি ঘটে (আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া)। কিন্তু তাঁকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি কোন শাসকের রোষানল। অন্যায় হলেই প্রতিবাদ করেছেন তিনি। তাঁকে দাবিয়ে রাখতে বার বার কারারুদ্ধ করা হয়েছে। জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময়ই তাঁকে জেলে কাটাতে হয়েছে পরিবার-পরিজন ছেড়ে। কিন্তু তাঁর আন্দোলন-সংগ্রাম, মানুষের শৃংখল মুক্তি ও দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্য থেকে তাঁকে বিচ্যুত করতে পারেনি কখনো।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত উঁচুমানের এবং মর্যাদাপূর্ণ মানুষ যাঁর ব্যক্তিত্ব মানুষকে আকৃষ্ট করেছে দেশ কালের সীমানা পেরিয়ে। যাকে ভালোবাসে জাতি-বর্ণ, দেশ-কালপাত্র ভেদে আপামর মানুষ, শুধুমাত্র কিছু কুচক্রী ও ক্ষমতালোভী বর্বর ছাড়া। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় একজন কাম্মিরী সেনা অফিসার বঙ্গবন্ধুকে রাস্তায় হাঁটতে নিষেধ করেন। কারণ তিনি জানতেন, রাস্তার দিকে হাঁটতে গেলে তাঁকে (মুজিব) যে কোন সময় গুলি করে মেরে ফেলে- পালাতে গিয়ে গুলিতে মারা গেছেন বলে চালিয়ে দেয়া হবে এবং এ তথ্যটি বঙ্গবন্ধুকে জানিয়েছিলেন। শাস্তি হয় ওই অফিসারের তথ্য ফাঁস করার দায়ে। অথচ এত প্রত্যয়ী, আত্মবিশ্বাসী এবং দেশদরদী মহান ব্যক্তিকে মৃত্যুবরণ করতে হয় কিছু অকৃতজ্ঞ ও কৃতঘœ পাকিস্তানপ্রেমী ছদ্মবেশী নরপিশাচের হাতে সপরিবারে। তিনি গান শুনতে ভালোবাসতেন। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি, কিংবা ধনধান্য পুষ্পভরা, আমাদের এই বসুন্ধারা- এ ধরনের গান তাঁর খুব প্রিয় ছিল।
ভাষা আন্দোলন ও ছয় দফা আন্দোলনের পথ ধরে আসে ১৯৭১- এর মুক্তির সংগ্রাম। তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে কৃষক-শ্রমিক, ধনী-গরীব নারী-পুরুষ, কিশোর যুবা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি শোষকদের উপর। নিরস্ত্র বাঙালিকে কেউ রুখতে পারেনি। ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের। যে ভাষণের প্রতিটি কথা এখনও মানুষের রক্তে নেশা জাগায়, শিহরণ জাগায়। যে বজ্রকণ্ঠের ঘোষণা বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল সেই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা, বাঙালি সত্ত্বার অস্তিত্বের ঠিকানা দানকারী পৃথিবীর মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ’ নামক স্বাধীন দেশের নির্মাণকারী, স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা ও বাস্তবায়নকারী মহামানবের নিধনকারী পিশাচদের জাতি কোনদিনও ক্ষমা করবে না। বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবারের সদস্যবৃন্দ, আততায়ীর হাতে নিহত তাঁর আত্মীয়-স্বজন ৭১’-এর মুক্তিযুদ্ধে নিহত ৩০ লক্ষ বীর শহিদের অমর আত্মদান যাদের ষড়যন্ত্র, কুশাসন ও ক্ষমতারোহণের ব্যর্থ প্রয়াস তাদের বিচার হলেও তা পূর্ণাঙ্গ নয়। সুতরাং, ষড়যন্ত্রের শেকড় এখনও প্রোথিত রয়েছে বাংলার মাটিতে।
শুধুমাত্র তাই নয়, যে ঐতিহাসিক সংগ্রাম ও কষ্টার্জিত সংগ্রামের ফসল এ স্বাধীন ভূ-খ- বাংলাদেশ তা এখনও শ্বাপদ সঙ্কুল।
বঙ্গবন্ধু একটি আদর্শের নাম। যে আদর্শ লালন করলে মানুষ কখনো কুপথে যায় না, হীন ব্যক্তিস্বার্থকে তুচ্ছ মানে, দেশ, জাতি ও মানুষের কল্যাণে নিজেদের ব্রতী করে, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মূল্যবোধে নিজেদের প্রাণিত করে সে আদর্শ অনেকটাই ক্ষয়িষ্ণু। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সরকারের স্বপ্ন ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে। সে স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য নিঃস্বার্থ মানুষের বড় প্রয়োজন।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা মুখে বললেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। সে আদর্শকে লালন ও ধারণ করে তা বাস্তবায়নের সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলেই তাঁকে সম্মান দেখানো হয়। কিন্তু মুখে আদর্শের বুলি আউড়ে নিজের আখের গোছানোতে ব্যস্ত থাকলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অবমাননাই হয়। এ অধিকার, সাহস কিংবা স্পর্ধা আমাদের কারো থাকা উচিৎ নয়।
বঙ্গবন্ধু নিজের স্বার্থ নয়, জনগণের স্বার্থকে বড় করে দেখতেন বলেই জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, বিলাস-ব্যসন অসঙ্কোচে ত্যাগ করতে পেরেছিলেন।
একটা দেশকে উন্নত করতে হলে প্রথমেই উচিৎ তার শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত করা। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং পাঠ্যপুস্তক নিয়ে নানা তেলেসমাতি কিসের ইঙ্গিত বহন করে তা সহজেই বোধগম্য। তবুও নানা নতুন নতুন উদ্ভাবন, সাফল্য ও উন্নতি আমাদের আশান্বিত করে।
বঙ্গবন্ধুকে নিন্দুক ও শত্রুরা তাদের মত করে ভাবলেও একথা মিথ্যা হয়ে যাবে না যে বঙ্গবন্ধু না থাকলে বাঙালি জাতি একটা স্বাধীন ভূখ- পেতো না। আজ বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ যে মর্যাদা ও সম্মান পাচ্ছে তাঁর রূপকার বঙ্গবন্ধু নিজেই। তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছেন, তাঁর অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করে চলেছেন তাঁরই সুযোগ্য সন্তান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমরা তাঁর সাহসিকতা, দৃঢ়তা, দেশপ্রেম ও যোগ্য নেতৃত্বকে সাধুবাদ জানাই।
বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবন দিয়ে যে চেতনা, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং রাজনৈতিক আদর্শ রেখে গেছেন তাকে সমুন্নত রাখা তাঁর আদর্শের অনুসারী প্রত্যেকটি মানুষের নৈতিক ও পবিত্র দায়িত্ব।
নিজ ধর্মের প্রতি তাঁর বিশ্বাস ও অন্য ধর্মের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা তাঁকে মানুষ হিসেবে আরো মহান ও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে সর্বমহলে।
তাঁর আদর্শ, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, সাহসিকতা, নৈতিকতা, দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম, তাঁকে করেছে বরণীয় ও স্মরণীয়। তাঁর জন্মদিনটিকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি, তাঁর আত্মার শান্তি ও অমরত্ব কামনা করি। ‘রাজনীতির কবি’ বঙ্গবন্ধুর কীর্তি চির অম্লান ও ভাস্বর হয়ে থাক যতদিন পৃথিবীর অস্তিত্ব থাকবে। কীর্তিমান এ মহামানবের ৯৮তম জন্মদিনটি আমাদেরকে উজ্জীবিত করুক নতুন নতুন প্রেরণায়।