কুনিও হোশি হত্যায় ৫ জঙ্গির ফাঁসির রায়

আপডেট: মার্চ ১, ২০১৭, ১:০২ পূর্বাহ্ণ

সোনার দেশ ডেস্ক
জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে হত্যার দায়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি দল জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) পাঁচ জঙ্গির ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত।
মঙ্গলবার রংপুরের বিশেষ জজ নরেশচন্দ্র সরকার দুই বছর আগের চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। মামলার এক আসামিকে খালাস দিয়েছেন তিনি।
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার সারাই ইউনিয়নের আলুটারি গ্রামে ২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর গুলি করে হত্যা করা হয় ৬৬ বছর বয়সি জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে।
ঢাকায় ইতালীয় নাগরিক চেজারে তাভেল্লা হতাকাণ্ডের পাঁচ দিনের মাথায় একই কায়দায় রংপুরে জাপানি নাগরিক হত্যার ওই ঘটনা সে সময় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও আলোড়ন তোলে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য এবং অর্থনীতিকে পঙ্গু করার লক্ষ্য নিয়ে ওই হত্যাকাণ্ড চালানো হয়।
মামলার অভিযোগপত্রে আট আসামির নাম থাকলেও তাদের দুজন আগেই পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। বাকি ছয় আসামির মধ্েয পাঁচজন রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
রায়ে জেএমবির রংপুর অঞ্চলের কমান্ডার মাসুদ রানা ওরফে মামুন ওরফে মন্ত্রী (৩৩), ওই জঙ্গি সংগঠনের সদস্য ইছাহাক আলী (৩৪), লিটন মিয়া ওরফে রফিক (৩২), সাখাওয়াত হোসেন (৩০) এবং পলাতক আহসান উল্লাহ আনসারী ওরফে বিপ্লবের (২৪) ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আদালত। হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় আরেক আসামি আবু সাঈদকে (২৮) বিচারক খালাস দিয়েছেন।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন রথীশচন্দ্র ভৌমিক বাবুসোনা। অন্যদিকে আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী আবুল হোসেন।
রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রথীশচন্দ্র ভৌমিক বলেন, “আদালত বলেছে, তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সাঈদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। এ কারণে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে। আমরা নথিপত্র পর্যালোচনা করে পরে আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।”
এই রায় ঘিরে সোমবার রাত থেকেই রংপুর জজ আদালত এলাকায় কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। মঙ্গলবার সকাল থেকে আদালতের সবগুলো ফটকে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন থাকতে দেখা যায়। আইনজীবী ও সংবাদকর্মী ছাড়া অন্য কাউকে রায়ের আগে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি।
বিচারের ১৬ মাস
আলুটারি গ্রামে দুই একর জমি ইজারা নিয়ে কুনিও যে ঘাসের আবাদ করেছিলেন, মুন্নাফ নামের এক ব্যক্তির রিকশায় চড়ে প্রতিদিন সকালে সেই খামার দেখভাল করতে যেতেন তিনি। ২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর সেখানে যাওয়ার পথেই তিনি খুন হন।
ওই দিনই কাউনিয়া থানার তৎকালীন ওসি রেজাউল করিম বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ঘটনার পরপর আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস এর দায় স্বীকার করলেও সরকার তা নাকচ করে।
প্রথম দিকে পুলিশের তদন্ত স্থনীয় এক বিএনপি নেতাকে ঘিরে আবর্তিত হলেও পরে তাতে জঙ্গিদের যোগাযোগ পান তদন্তকারীরা।
প্রায় নয় মাস তদন্তের পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউনিয়া থানার ওসি আব্দুল কাদের জিলানী গতবছর ৩ জুলাই রংপুরের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দেন। সেখানে জেএমবির আট জঙ্গিকে আসামি করে প্রাথমিক সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার ছয়জনকে অব্যাহতি দেয়ার আবেদন করা হয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, কুনিও হোশিকে লক্ষ্য করে পর পর তিনটি গুলি করেন জেএমবির আঞ্চলিক কমান্ডার মাসুদ রানা। মোটর সাইকেলে তারা তিনজন ছিলেন। গুলি করার পর মোটর সাইকেলে করে তারা পালিয়ে যান। ঘটনাস্থলেই মারা যান ৬৬ বছর বয়সী কুনিও।
অভিযোগপত্রে নাম না আসায় কুনিওর ব্যবসায়িক সহযোগী হুমায়ুন কবির হীরা, রংপুর মহানগর বিএনপির সদস্য রাশেদ-উন-নবী খান বিপ্লব, রংপুর মহানগর যুবদলের সদস্য রাজীব হাসান সুমন ওরফে মেরিল সুমন, নওশাদ হোসেন রুবেল ওরফে ব্ল্যাক রুবেল, বিজয় দাশ এবং রংপুর নগরীর শালবন মিস্ত্রিপাড়ার কাজল চন্দ্র বর্মণ ওরফে ভরসা কাজল অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পান।
হাকিম আদালত থেকে মামলাটি বিশেষ জজ আদালতে স্থানান্তরের পর ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর বিচারক অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আসামিদের বিচার শুরু করেন বিচারক নরেশ চন্দ্র সরকার।
চলতি বছর ৪ জানুয়ারি সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর পর রাষ্ট্রপক্ষে ৫৭ জনের মধ্যে ৫৫ জনের সাক্ষ্য শোনে আদালত। আসামি মাসুদ রানা ও সাদ্দাম হোসেনের গুলিতে কুনিও মারা যান বলে তদন্ত কর্মকর্তা কাউনিয়া থানর ওসি আব্দুল কাদের জিলানী তার সাক্ষ্যে বলেন।
অন্যদিকে আসামি সাখাওয়াত হোসেন ওরফে রাহুলের পক্ষে তার গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার হলদিয়াবাড়ি ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য আব্দুল মজিদ মণ্ডল সাফাই সাক্ষ্য দেন।
১৪ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্য ও জেরা শেষে রোববার এক দিনেই আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক শোনে আদালত। এরপর বিচারক রায়ের দিন ঠিক করে দেন।
আরও মামলা আসামিদের বিরুদ্ধে
কুনিও হোশি হত্যা মামলায় ফাঁসির রায় পাওয়া পলাতক বিপ্লব রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। গত বছরের জানুয়ারি থেকে তিনি অনুপস্থিত বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ইব্রাহীম কবীর জানিয়েছেন।
বিপ্লবের বাড়ি কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার মকর রাজমাল্লী এলাকায়। রংপুরে বাহাই নেতা রুহুল আমীন হত্যাচেষ্টা মামলারও অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি তিনি।
মৃত্যুদণ্ডের রায় পাওয়া বাকি চার আসামি মাসুদ রানা, ইছাহাক আলী, লিটন মিয়া ও সাখাওয়াত এবং খালাস পাওয়া সাঈদও রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায় মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যা ও হাই নেতা হত্যাচেষ্টা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি।
এ মামলার অভিযোগপত্রে নাম থাকা পলাতক সাদ্দাম হোসেন ওরফে রাহুল চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি রাতে ঢাকার মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় কাউন্টার টেরোরিজম পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।
আর নজরুল ইসলাম ওরফে বাইক নজরুল ওরফে হাসান গত বছরের ২ অগাস্ট ভোরে রাজশাহীতে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান।
রংপুরেই শেষ ঘুম
রংপুর শহরের মুন্সীপাড়ার জাকারিয়া বালা নামে এ ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র ধরে বাংলাদেশে এসে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায় একটি ঘাসের খামার করছিলেন কুনিও হোশি। ওই উপজেলার সারাই ইউনিয়নে আলুটারি কাচু গ্রামের মানুষ তাকে নিপাট ভদ্রলোক বলেই জানত।
২০১১ সাল থেকে রংপুরে যাতায়াত শুরু হলেও ২০১৫ সালের মে মাসের পর মুন্সীপাড়ায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন তিনি । বেশ কিছুদিন থাকায় ভাঙা বাংলায় কথা বলেতেও শিখেছিলেন এই বিদেশি। কারও সাথে দেখা হলে সালাম দিতেন, কেউ সালাম দিলে জবাবও দিতেন।
কুনিও নিহত হওয়ার পর তার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের খবর গণমাধ্যমে আসতে শুরু করে। স্থানীয়রা দাবি করেন ইসলাম গ্রহণ করে কুনিও ‘গোলাম মো. কিবরিয়া’ নাম নিয়েছিলেন। বাড়ির পাশের মসজিদে তাকে শুক্রবার জুমার নামাজ এবং মুন্সিপাড়া কবরস্থান মাঠে ঈদের নামাজ পড়তে দেখার কথাও তারা বলেন।
মুন্সিপাড়া কাদেরিয়া জামে মসজিদের ইমাম সিদ্দিক হোসেনের ভাষ্য, তার কাছেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন ওই জাপানি। স্থানীয় বাসিন্দাদের বেশ কয়েকজনের সামনেই তা হয়েছিল। স্থানীয়দের কাছে একটি ছবিও পাওয়া যায়, যাতে কুনিওকে মসজিদে টুপি পড়ে আরও অনেকের মাঝে বসে থাকতে দেখা যায়।
কুনিও খুন হওয়ার পর জাপান দূতাবাসের কর্মকর্তারা রংপুর ঘুরে গেলেও লাশ হস্তান্তর ও শেষকৃত্যের বিষয়টি ঝুলে থাকে ধর্ম বদলের কারণে। পরে রংপুরের মেয়র শরফউদ্দিন আহম্মেদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেখানেই কুনিও হোশির শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করে জাপান কর্তৃপক্ষ।
হত্যাকাণ্ডের দশ দিনের মাথায় ব্যাপক গোপনীয়তার মধ্যে ২০১৫ সালের ১২ অক্টোবর গভীর রাতে মুন্সীপাড়া কবরস্থানে মুসলিম রীতি অনুযায়ী দাফন করা হয় জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে।- বিডিনিউজ