কেঁচো সার উৎপাদনে সফল গোমস্তাপুরের আলীম

আপডেট: এপ্রিল ১১, ২০২৫, ১১:২৪ অপরাহ্ণ

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি:


চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার চাঁইপাড়া গ্রামের কৃষি উদ্যোক্তা আব্দুল আলীম কৃষি খাতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ কেঁচো সার ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনে মাত্র ৭ মাসে ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন তিনি। বর্তমানে আব্দুল আলীমের উৎপাদন কেন্দ্র থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ মনের বেশি কেঁচো সার বাজারজাত করা হয়।

বিশেষ প্রজাতির কেঁচো ব্যবহার করে উদ্ভিদ বা প্রাণির বর্জ্য ও দেহাবশেষকে প্রক্রিয়াজাতকরণের পর যে সার পাওয়া যায় সেটাই মূলত কেঁচো সার বা ভার্মি কম্পোস্ট নামে পরিচিত। কৃষকদের কাছে এটি পরিবেশবান্ধব সার নামেও পরিচিত। যা জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ায় কেঁচো সার ব্যবহারে দিন দিন আগ্রহী হয়ে উঠছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার প্রান্তিক কৃষকরা। আবার অনেকেই কৃষি অফিসের সহায়তা নিয়ে বাড়িতেই বাণিজ্যিকভাবে এ সার উৎপাদন করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আব্দুল আলীমের বাড়ির পাশে ভার্মি কম্পোস্ট প্রজেক্টে, পরিত্যক্ত জায়গাজুড়ে প্রায় ১২ চেম্বার, ১২ টি বড় বড় পাত্র ও সিমেন্টের তৈরি ১০০ ফুট লম্বা হাউস নিয়ে তৈরি করেছেন ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন কেন্দ্র। প্রথমে গোবর সংরক্ষণ করে টিনের চালায় রাখা হয়েছে। তারপর সেই গোবর হালকা শুকিয়ে রিং বা হাউসে দিয়ে কয়েক দিন রাখার পরই তাতে কেঁচো দিয়ে ২৫ থেকে ৩০ দিনেই উৎপাদন হয় ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার। এরপর সেটি বাজারজাত করতে বাছাই করে প্যাকেটজাত করা হয়। অন্যদিকে কেঁচো সার উপদান কেন্দ্রে কাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন নারী সহ অনন্যরা।

কুয়েত প্রবাসে থাকাকালীন, তার নিজের গ্রামের কথা চিন্তা করেন তিনি। দেশের গ্রামে এসে কয়েকটি গরু কিনে খামার করেন, পরে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ আল ফুয়াদের পরামর্শে গোমস্তাপুর উপজেলা কৃষি অফিস থেকে এস এ সিপি, রেন্স প্রল্পের অর্থায়নে ১২ চেম্বার ও প্রয়োজনীয় কেঁচোসহ সকল উপকরণ নিয়ে এই প্রোজেক্ট শুরু করেন। এরপর উপজেলা কৃষি কর্মকতা কৃষিবিদ তানভীর আহমেদ সরকারের, দিকনির্দেশনা ও নিজের পরিশ্রমের ফলে মাত্র ৬ মাসে ব্যাপক সফলতা পান এই উদ্যোক্তা।

বর্তমানে আব্দুল আলিমের এ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকার ভার্মি কম্পোস্ট সার বাজারজাত করা হয়। তাছাড়া বাজারে ব্যাপক চাহিদাও রয়েছে পরিবেশবান্ধব এ সারের।
আব্দুল আলীম, বলেন, শাকসবজির ফেলে দেওয়া অংশ, অর্ধপচা গোবর একসঙ্গে মিশিয়ে সেখানে কেঁচো ছেড়ে দেওয়া হয়। কেঁচো সেসব ময়লা খেয়ে মলত্যাগ করে পচিয়ে ফেলে ও বংশবিস্তার করতে থাকে। কেঁচোর পচিয়ে ফেলা দ্রব্যই মূলত জৈব সারে পরিণত হয়। প্রতি কেজি ১০-১২ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। অন্যদিকে এই জৈব সার উৎপাদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কেঁচো প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা দরে।

তিনি আরো বলেন, কেঁচো এভাবে ভাগ্য বদলে দিতে পারে, তা আমার আগে জানা ছিল না। চাষ করেই বুঝতে পারছি, কেঁচো ও কেঁচো থেকে পাওয়া জৈব সার বিক্রি করে লাখ টাকা আয় করা যায়। আবার কেঁচো সারে উৎপাদিত জৈব কৃষি পণ্যের দামও অনেক বেশি। আমি ৭ মাসে প্রায় ৪ লাখ টাকার জৈব সার বিক্রি করেছি ।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরের আম চাষিরা এখন রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহার করছে’ জৈব পদ্ধতিতে আম চাষ করতে চাষিদের উৎসাহিত করছে । আর চাঁপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্র অঞ্চলের জৈব পদ্ধতিতে আম চাষে খরচ কম ও লাভ বেশি হয় বলে’ এই পদ্ধতি জনপ্রিয়তাও পাচ্ছে।

আম চাষি আব্দুর সামাদ হাবিব বলেন, আব্দুল আলিম একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা আমার নিজস্ব ১২ বিঘা আম বাগানে আগে আমি রাসায়নিক সার ব্যবহার করতাম’ পরে আমি জানতে পারলাম আমার এলাকায় জৈব সার উপদান হচ্ছে,, আমি আব্দুল আলিমের সাথে যোগাযোগ করে তার কাছ থেকে জৈব সার কিনে আমার ব্যবহার করি। জৈব সার মাটির গুণগত মান উন্নত করে’ মাটিতে জৈব পদার্থ যোগ করে” রাসায়নিক দূষণ থেকে মাটি ও পরিবেশ রক্ষা করে। মাটির উর্বরতা দীর্ঘ সময়ের জন্য বজায় রাখে’ উৎপাদন বৃদ্ধি ও ফসলের পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি করে এবং উৎপাদন বাড়ায়।

উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ আল ফুয়াদ বলেন, সবজি চাষে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে জৈব সারে প্রাধান্য দিয়ে যদি সবজি উৎপাদন করা হয়, তাহলে একদিকে যেমন সবজিগুলো বিষমুক্ত ও নিরাপদ থাকে, অপরদিকে মাটির গুণাবলিও অনেক বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া আব্দুল আলিমের ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনে শুরু থেকে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে সার্বিক সহযোগিতা করা হয়েছে। এই ধরনের উদ্যোক্তা তৈরিতে আরও নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

গোমস্তাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ তানভীর আহমেদ সরকার বলেন, আব্দুল আলীম তিনি বানিজ্যিক ভাবে ভার্মি কম্পোস্ট’ কেঁচো সার উতপাদন করছেন, এবং বাণিজ্যিক ভাবে বিক্রয় করছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা যেহেতু আমের রাজধানী এখানে প্রচুর পরিমাণে আম বাগান রয়েছে। ‘বিশেষ করে কাটিমন জাতের আম এই আমটি বারোমাসে উৎপাদন হয়’। আগে বেশিরভাগ কৃষকরা রাসায়নিক সার ব্যবহার করত ‘এখন আব্দুল আলিমের কেঁচো সার মাধ্যমে অনেক কৃষক রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সারের প্রতি ঝুঁকছেন’ জৈব সার ব্যবহার করে কৃষকরা উপকারিতা বুঝতে পারছেন। আমরা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে কৃষকে সার্ভিক সহায়তা ও পরামর্শ দিচ্ছি এবং এস এ সি পি রেন্স প্রল্পের অর্থায়নে নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান করছি।

তিনি আরো বলেন ‘ভার্মি কম্পোস্ট’ অর্থাৎ এ কেঁচো সারের বিশেষত্ব হলো এটি হিউমাস সমৃদ্ধ জৈব সার। এটি মাটির উর্বরতা ও গাছের বৃদ্ধিসহ ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং মাটির লবণাক্ততা কমায়। এছাড়া এই সার মাটির পানি ধারণক্ষমতা বাড়ায় এবং এটি রাসায়নিক বিষমুক্ত। এ জৈব সার ব্যবহারে ফসলের উৎপাদন খরচও অনেক কম হয়।
পরিবেশবান্ধব এ জৈব সার অর্থাৎ কেঁচো সার উৎপাদনে দিন দিন এগিয়ে আসছেন’ উদ্যোক্তারা ‘ এটি কৃষি খাতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সেই সঙ্গে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করতে পারবে কৃষকরা। এতে দেশের কৃষি উৎপাদনের স্বার্থে এ সারের ব্যাপক প্রসার ঘটাবে এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।