রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ৯ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
আবু সালেহ সায়াদাত
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা। পুরান ঢাকার একটি চায়ের দোকানে কয়েকজন যুবকের জটলা। কেউ বসে চা খাচ্ছেন, কেউ দাঁড়িয়ে টিভিতে বিপিএলের ম্যাচ দেখছেন। চলছে খেলা নিয়ে আলোচনা-বিশ্লেষণ। চায়ের দোকানটিতে উপস্থিত কয়েক যুবকের মধ্যে একধরনের অস্থিরতাও লক্ষ্য করা গেলো। খেলা নিয়ে বার বার মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন তারা।
এদের একজন বলছিলেন, ‘কুমিল্লার পক্ষে কত?। ৩:১! আমার ৫ হাজার?’ আরেকজন বলছিলেন, ঢাকায় ২ হাজার। জুনায়েদ দুই উইকেট নিতে পারবে না। ৫০০ টাকা লাগাও।
এসব কথোপকথন শুনে মনে কৌতূহল জাগলো। পাশে বসা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবির হোসেন (ছদ্মনাম)। তার কাছে জানতে চাইলাম, ব্যাপার কী? তিনি বললেন, ‘এটা প্রতিদিনের বিষয়। প্রতিদিনই লাখ লাখ টাকার বাজি হয় চলে এই দোকানের বেঞ্চে বসে।’
শুরু পুরান ঢাকায় নয়, রাজধানীর পাড়া-মহল্লাসহ সারাদেশ এমনকি গ্রামগঞ্জেও চলছে ক্রিকেট নিয়ে জমজমাট জুয়ার আসর। বিপিএল, আইপিএল, বিশ্বকাপ, ওয়ানডে, এমনকি দেশ-বিদেশের টেস্ট খেলা ঘিরেও চলে বাজিকরদের রমরমা জুয়া। ‘ক্রিকেট বাজি’ নামক এই জুয়ায় প্রতি বলেই চলে বাজি। যেখানে জড়িয়ে পড়েছেন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, যুবক ও ব্যবসায়ীসহ অনেকেই।
কোন দল জিতবে, কোন খেলোয়াড় কত রান করবে? কত ওভারে কত রান হবে, পাওয়ার প্লে-তে কত রান আসবে, অমুক ক্রিকেটার হাফ সেঞ্চুরি না কি সেঞ্চুরি করবে, টসে কোন দল জিতবে, কোন খেলোয়াড় কত উইকেট নেবে? বাজি চলে এসব নিয়েই।
সরেজমিনে পুরান ঢাকার বংশালের মকিমবাজারে গিয়ে চোখে পড়লো প্রকাশ্যে বিপিএল নিয়ে জুয়ার দৃশ্য। ফোনে রেট জেনে বাজি ধরছেন শাহজাহান (ছদ্মনাম) নামে একজন। এ বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে বলেন, ‘বিরক্ত করবেন না তো, মেজাজ খারাপ আছে, মাত্রই টাকা হারালাম।’
বিপিএলে বাজির নেশায় লাখ টাকা হারিয়ে এই জুয়া খেলার ফাঁদ থেকে বের হয়ে এসেছেন তন্ময় আহমেদ (ছদ্মনাম) নামের আরেকজন। ক্রিকেটের এই সর্বনাশা জুয়া সম্পর্কে কথা বলতে রাজি হলেন তিনি।
বললেন, টিভিতে ক্রিকেট খেলা চলার সময় রাজধানীর পাড়া-মহল্লায় আড্ডায়, সেলুন, ফ্লেক্সিলোড কিংবা চায়ের দোকানে অনেক লোক একসঙ্গে খেলা দেখে। আসলে এর বেশির ভাগই জুয়ার আসর। এ খেলায় ছাত্র, বেকার, ব্যবসায়ী সবাই জড়িত। ১০০ টাকা থেকে শুরু হয়ে একপর্যায়ে চলে হাজার হাজার টাকার জুয়া। ব্যক্তিগত পর্যায়েও জুয়া হয়। আবার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জুয়ার কেনাবেচাও হয়। এ লোভেই নিঃস্ব হচ্ছেন শত শত তরুণ। সুদে টাকা নিয়ে জুয়ায় নামার নজিরও আছে।
কীভাবে এই জুয়া খেলা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেকে এটাকে ‘ইস্টু’ খেলাও বলেন। প্রথম দিকে এই খেলা ছিল কোন দল জিতবে? এটার ওপর বাজি ধরতো সবাই। আস্তে আস্তে ওটার সঙ্গে শুরু হয় কোন খেলোয়াড় কত রান করবে? কত ওভারে কত রান হবে, পাওয়ার প্লে-তে কত রান আসবে, এই ক্রিকেটার হাফ সেঞ্চুরি না কি সেঞ্চুরি করবে, মোট রান কত হবে, টসে কোন দল জিতবে?- এসব নিয়ে’
একটি উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, যেমন ধরুন ভারত-পাকিস্তান খেলার দর ধরা হয় সমান। অর্থাৎ এক হাজার টাকা জুয়ায় জিতলে দুই হাজার টাকা পাওয়া যাবে। আবার ভারত-ওয়েস্টইন্ডিজের খেলার দর ১০:১৫। অর্থাৎ ওয়েস্টইন্ডিজের পক্ষে যারা এক হাজার টাকা বাজি ধরেছিলেন, জিতলে তারা আড়াই হাজার টাকা পাবেন। ভালো দলের সঙ্গে খারাপ দলের খেলা হলে দরকষাকষিটা হয় ভিন্নভাবে। যেমন অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আয়ারল্যান্ডের খেলা হলে বাজির দর হয় ১:৩। অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে ১০০ আর আয়ারল্যান্ডের পক্ষে ৩০০ টাকা।
সরেজমিনে অনুসন্ধানের সময় প্রতিবেদকের আচরণে সন্দেহ করেন এক জুয়াড়ি। দৃষ্টি আড়াল করতে ৫০০ টাকাকে ৫ আর ১০০০ টাকাকে ১০ টাকা সংকেত হিসেবে পর্যায়ক্রমে জুয়ার অঙ্ক নির্ধারণ করেন। খেলা শেষে এজেন্ট তার সুবিধাজনক স্থান ও সময়ে পরাজিত জুয়াড়ির কাছ থেকে টাকা নিয়ে জয়ী জুয়াড়ির কাছে হস্তান্তর করেন। এজেন্টরা জয়ী জুয়াড়ির কাছ থেকে টাকা হস্তান্তরের বিনিময়ে কমিশন পান বলেও জানান তিনি।
সমাজের সচেতন ব্যক্তিরা মনে করছেন, দেশে চলছে ক্রিকেট নিয়ে বাজিকরদের বাজে (জুয়া) খেলা। অনেক ক্রিকেট জুয়াড়ি জুয়ার টাকা জোগাতে চুরি ও ছিনতাইয়ের মতো বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-েও জড়িয়ে পড়ছে। এছাড়া স্কুল-কলেজের কোমলমতি ছাত্ররা বিপথগামী হচ্ছে। একইসঙ্গে জুয়ায় হার-জিতকে কেন্দ্র করে পারিবারিক ও সামাজিক অস্থিরতা দিন দিন বাড়ছে।
তবে সর্বনাশা এই খেলাটি বন্ধ করতে ইতোমধ্যে নজরদারি শুরু করেছে পুলিশ। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) ইব্রাহিম খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিপিএল ম্যাচকে কেন্দ্র করে জুয়াড়িরা জুয়ায় যাতে না বসে সেজন্য নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশনা রয়েছে। নিয়মিত টহলও চলছে।’-খবরটি জানোনিউজ থেকে নেওয়া হয়েছে।