খরতাপের পর রাজশাহী অঞ্চলে বৃষ্টিতে আমের আশীর্বাদ

আপডেট: এপ্রিল ১১, ২০২৫, ১১:০৮ অপরাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি:


কয়েকদিন ধরেই রাজশাহী অঞ্চলে বইছিল খরতাপ। তীব্র রোদের মধ্যে আমের অনেক কড়ালি কিসমিসের মতো শুকিয়ে যাচ্ছিল। গাছের গোড়ায় সেচ দেওয়া হচ্ছিল, আমে স্প্রে করা হচ্ছিল পানি—তবু তা যথেষ্ট ছিল না। এক চিলতে বৃষ্টির জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন আমচাষিরা। অবশেষে সেই প্রতীক্ষিত বৃষ্টি নেমেছে বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) রাতে।
চাষিদের ভাষ্য, এই বৃষ্টির ফলে আমের বোঁটা শক্ত হবে, ঝরে পড়া কমবে। কয়েক দিনের মধ্যেই শুরু হবে আমে ব্যাগিংয়ের কাজ। তার আগে এমন বৃষ্টিতে আমের গায়ে জমে থাকা ধুলোবালি ধুয়ে গেছে। ফলে ব্যাগে ঢোকার পর আম থাকবে ঝকঝকে ও দাগহীন।

রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত ২৩ দশমিক ৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই সময় ঘণ্টায় ২০ নটিক্যাল মাইল গতিতে ঝোড়ো বাতাসও বয়ে যায়। রাজশাহী ছাড়াও আম উৎপাদনকারী জেলা নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জেও বৃষ্টি হয়েছে। ঝড়-বৃষ্টিতে কিছু এলাকায় অল্প কিছু আম ঝরেও পড়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার দুই উপজেলা চাঁপাই সদর ও শিবগঞ্জে গড়ে ৫ মিলিমিটার করে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে কৃষি বিভাগ। জেলার অন্য তিন উপজেলা গোমস্তাপুর, নাচোল ও ভোলাহাটে সামান্য বৃষ্টি হয়েছে। বজ্রসহ বৃষ্টি হলেও ঝড় বা শিলাবৃষ্টি না হওয়ায় কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছেন খরাক্রান্ত জেলাবাসী কৃষকরা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার আমচাষি ইসমাইল খান বললেন, এবার বৃষ্টিপাত কম। কড়ালি ঝরেপড়া রোধে গাছে নিয়মিত সেচ দিতে হচ্ছিল, এতে খরচ বাড়ছিল। এখন আবার খরা না হওয়া পর্যন্ত সেচের দরকার হবে না। এতে চাষিদের উপকার হলো।

আমচাষী ও রফতানিকারক ইসমাইল খান শামীম বলেন, গুটি ঝরার মুখে বৃষ্টির পর কয়েকদিন আর কোনও ফসলে কোনরূপ বালাইনাশক দিতে হবে না। আমের বোঁটা শক্ত হবে। আম ঝরা কমে যাবে। আম বৃদ্ধির হার বাড়বে। আকার-আকৃতি ভাল হবে। প্রকৃতির ক্ষতিকারক পোকামাকড় আক্রমন কমে আসবে। তবে গাছের গোড়ায় সেচের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
কৃষক শফিকুল ইসলাম জানান, চলতি মৌসুমে ব্যাপক মুকুল আসলেও বৃষ্টি না থাকায় ও খরার কারণে ঝরে পড়েছে ব্যাপক। এমন অবস্থায় এই বৃষ্টি অনেক কাজে দিবে। আমের গুটির দ্রুত বৃদ্ধি ঘটবে। ঝরে পড়া রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই বৃষ্টি।

রাজশাহী ম্যাঙ্গো সোসাইটির সভাপতি আনোয়ারুল হক প্রতি মৌসুমে প্রায় ১০ টন রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন করেন। ব্যাগিং প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদিত তার বেশিরভাগ আম রফতানিও হয়। তিনি জানিয়েছেন, আগামী ২০ এপ্রিল থেকে তার বাগানে ব্যাগিং শুরু হবে।

আনোয়ারুল হক বলেন, ‘ব্যাগিংয়ের আগে একটা বৃষ্টি হলে খুব ভালো হয়। আমটা পরিষ্কার হয়ে যায়। পরিষ্কার আম ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলে তাতে আর ধুলোবালি লাগে না, কোনো দাগও হয় না। তাছাড়া বৃষ্টিতে আমের বোঁটাও শক্ত হয়।’ তবে গত ২০ ও ২১ মার্চের বৃষ্টিতে আম্রপালি জাতের কিছু ক্ষতি হয়েছে বলে জানান তিনি। তার ভাষায়, ‘ওই সময় মুকুল ছিল গাছে। সেই মুকুল বৃষ্টির পানিতে পুড়ে গেছে। তবে যেসব মুকুল আগে এসেছিল এবং আম তখন মার্বেল বা নাকফুল আকারে ছিল, সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। অন্য জাতের আমও উপকৃত হয়েছে।’
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আম বৃষ্টি, ঝড়-ঝা-ার মধ্যেই বেড়ে ওঠে। আগের বৃষ্টিতে কিছু ক্ষতি হলেও এবারের বৃষ্টি সোনায় সোহাগা হয়ে গেছে। টানা খরার পর এই বৃষ্টি আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।’

তিনি বলেন, ‘বৃষ্টিপাতের সময় ঝোড়ো হাওয়ায় কিছু আম ঝরে পড়েছে, তবে খরার কারণে সেগুলোর বোঁটা আগে থেকেই দুর্বল ছিল। সামগ্রিকভাবে এবার আমের ঝরেপড়া কমবে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক ড. আজিজুর রহমান বলেন, ‘এই বৃষ্টির জন্য আমরা অপেক্ষা করছিলাম। এবার আমের অনইয়ার। উৎপাদন ভালো হবে বলেই আমরা আশা করছি। বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে।’

এদিকে জেলা কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, জেলায় ৩৭ হাজার ৫০৪ হেক্টর জমির ৮১ লক্ষ ৪৫ হাজার ৪০টি আমগাছের ৯২ শতাংশে মুকুল আসার পর গুটি বেশ বড় হয়েছে। আমের জন্য চলতি মৌসুমের আবহাওয়া শুরু থেকেই যথেষ্ট অনুকুল বলছেন সংশ্লিষ্ট সকলেই। মৌসুমে শীতের তীব্রতা কম থাকায় বেশিরভাগ মুকুল এসেছে আগাম ও সময়মত। চলতি মৌসুমের ডিসেম্বরে জেলার সর্বনি¤œ গড় তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও জানয়ারি থেকে তা ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।

কৃষি বিভাগ আরও জানায়, চলতি বছর হেক্টর প্রতি ১০.৩ মেট্রিক টন হিসেবে ৩ লক্ষ ৮৬ হাজার ২৯০ টন আম উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট অনেকেই আরও বেশি উৎপাদনের ব্যাপারে আশাবাদী। গত মৌসুমে উৎপাদনের লক্ষমাত্রা ছিল সাড়ে ৩ লক্ষ টন ও উৎপাদন হয় ৩ লক্ষ ৪৮ হাজার ২৭৮ টন। গত মৌসুমে ৭৩ থেকে ৭৫ শতাংশ গাছে মুকুল এসেছিল। ২০২৪ সালে ১৩৩ টন আম রফতানি হয়েছে মূলতঃ ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে। এর আগের বছর ২০২৩ সালে হয়েছিল ৩৭৬ টন।

চলতি মৌসুমে নওগাঁর ৩০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির আমবাগান থেকে ৪ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৩৭ হাজার ৫০৪ হেক্টর থেকে ৩ লাখ ৮৬ হাজার মেট্রিক টন এবং রাজশাহীর ১৯ হাজার ৬০০ হেক্টর বাগান থেকে ২ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। গত বছরের তুলনায় এবার ফলন বেশি হবে বলে আশা করছেন আমচাষি, গবেষক এবং কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. ইয়াছিন আলী জানান, হালকা বৃষ্টি হলেও এ সময় তা আম-ধানসহ সকল ফসলের জন্য উপকার বয়ে আনবে। আপাতত আম চাষে বড় সমস্যা নেই।#

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

Exit mobile version