খাগড়াছড়িতে ৪ জনকে হত্যার প্রতিবাদে রাবিতে মানববন্ধন

আপডেট: ডিসেম্বর ১৮, ২০২৩, ৭:৩৬ অপরাহ্ণ


রাবি প্রতিবেদক:


খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি ছাত্রপরিষদের সাবেক সভাপতি বিপুল চাকমা, বর্তমান সহ-সভাপতি সুনিল ত্রিপুরাসহ চারজনকে হত্যার প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সোমবার (১৮ ডিসেম্বর) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবন সংলগ্ন প্যারিস রোডে ছাত্র-শিক্ষকবৃন্দের ব্যানারে এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, হত্যাকান্ডের মাধ্যমে সরকার পাহাড়ের স্বপ্ন ও নেতৃত্বকে দমন করার চেষ্টা করছে। গত ১১ ডিসেম্বরে ঘটনাটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটা খুবই পরিকল্পিত এবং সংঘবদ্ধভাবে সংঘটিত অপরাধ। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এরকম অপরাধ সংঘটিত হওয়া সম্ভব না। পাহাড় থেকে সেনা শাসন প্রত্যাহার করতে হবে। শান্তিচুক্তির দফাগুলো প্রত্যেকটা সুনির্দিষ্টভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি, পাহাড়িদের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে। পাহাড় থেকে অনুপ্রবেশকারীদের সরিয়ে ফেলতে হবে।

এ সময় ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধ কর’, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বন্ধ কর’, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ কর’, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বন্ধ কর’, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে সেনা শাসন তুলে নাও’, ‘পানছড়িতে চার হত্যাকন্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কর’ সহ বিভিন্ন দাবি সংবলিত প্লাকার্ড হাতে প্রতিবাদ জানানো হয়।

মানববন্ধনে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের পক্ষ থেকে শামিম ত্রিপুরা বলেন, আমরা পাহাড় বা সমতলের যারাই কোনো সংগ্রামে লিপ্ত হচ্ছি, শোষিত মানুষের কথা বলছি, তাদের উপরে সরকার কোনোনা কোনোভাবে দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। গত নভেম্বরের দিকে আমরা দেখেছি, মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করার কারণে দুইজন গার্মেন্টস শ্রমিককে হত্যা করা হয়েছে। এটা শ্রমিক শ্রেণীকে ভয় দেখানোর জন্য করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় গত ১১ ডিসেম্বর সরকার সেনাবাহিনী দিয়ে খাগড়াছড়ির পানছড়ির অনিল পাড়ায় আমাদের পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ৪ জন নেতাকে হত্যা করেছে।

তিনি আরও বলেন, হত্যাকান্ডের মাধ্যমে তারা পাহাড়ের স্বপ্ন ও নেতৃত্বকে দমন করার চেষ্টা করেছে। এঘটনায় আমরা আমাদের সহযোদ্ধাদের হারিয়েছি। এই হারানোর কারণে আমরা থেমে থাকবোনা। আমরা রাজপথ ছাড়বোনা। নিহত সহযোদ্ধাদের নীতি-আদর্শ ও সংগ্রামী চেতনা আমরা ধারণ করে এগিয়ে যাবো। একই সাথে আমরা প্রত্যাশা রাখবো, পাহাড় ও সমতলে লড়াই হবে সমানতালে। হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও শাস্তির দাবি আমি জনগনের কাছেই দিলাম।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আজকে আমরা খুবই মর্মাহত অবস্থায় এখানে দাড়িয়েছি। গত ১১ ডিসেম্বরে পাহাড়ে সংঘটিত মর্মান্তিক ঘটনাটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটা খুবই পরিকল্পিত এবং সংঘবদ্ধভাবে সংঘটিত অপরাধ। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এরকম অপরাধ সংঘটিত হওয়া সম্ভব না, এটা শুধু আমরা জানিনা, এটা বোধহয় যেকোনো সাধারণ মানুষই বুঝতে পারবে।

বাংলা বিভাগের অধ্যাপক একেএম মাসুদ রেজা ওরফে সৌভিক রেজা বলেন, ১৯৯৭ সালের পাহাড়ের শান্তি চুক্তির সঙ্গে আমরা বর্তমান ফিলিস্তিন যুদ্ধের একটা অদ্ভুত মিল দেখতে পায়। আপনারা খেয়াল করবেন, অসলো শান্তি চুক্তির পরে মাহমুদ আব্বাসের ফাতাহ গ্রুপকে প্রায় নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হয়েছে। হামাস এবং ইসলামিক জিহাদ লড়াই করে যাচ্ছে এবং জীবন তারাই দিচ্ছে। ৯৭ সালে পাহাড়ের শান্তি হওয়ার পরে শন্তু লারমার জনসংহতি সংঘ কার্যত নিষ্ক্রিয়। ১৯৯৮ সালে ইউপিডিএফের জন্ম। শুরু থেকেই বর্তমান স্বৈরাচারী, ফ্যাসিস্ট ও তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকার নিয়মিত তাদের উপরে হামলা করে যাচ্ছে। এটাতে তথাকথিত ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধের নাম দিয়ে এই কাজগুলো তারাই মদদ দিয়ে যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, ইউপিডিএফের দাবি হলো পাহাড়ে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া। খুবই ন্যায্য দাবি। তারা শান্তি চুক্তির বাস্তবায়নও চেয়েছিল। কিন্তু দেখবেন, শন্তু লারমা ঈদের খুতবার মত শান্তি চুক্তির দিবস আসলেই বছরে একবার কান্নাকাটি করে বলেন যে, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন হলোনা। কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করেননা। আমাদের ছায়ানট যেমন প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে একটা খুতবা পাঠ করেন, কিন্তু কোনো লড়াই নাই। খেয়াল করবেন, লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছে যারা, তাদের প্রতি কিন্তু এই সরকারের প্রথম থেকেই একটা বিদ্বেষমূলক দমন-পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখবো যে, ইউপিডিএফকে কখনো ভাগ করছে, কখনো ইউপিডিএফের নেতাকর্মীদের গুম করছে, কখনো জেলে নিচ্ছে, কখনোবা হত্যা করা হচ্ছে।

১১ ডিসেম্বরের হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, এই ঘটনার পিছনে সরকারের মদদ ছাড়া এরকম চারজন জনপ্রিয় নেতাকে হত্যা করা সম্ভব না। কাজেই আমরা যেমন প্যালেস্টাইনে ইসরায়েলের অপশাসনের বিরুদ্ধে, তেমনি পাহাড়ে ন্যায্য অধিকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানায়। আমরাও মনে করি, পাহাড় থেকে সেনা শাসন প্রত্যাহার করতে হবে। শান্তিচুক্তির দফাগুলো প্রত্যেকটা সুনির্দিষ্টভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি, পাহাড়িদের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে। পাহাড় থেকে অনুপ্রবেশকারীদের সরিয়ে ফেলতে হবে। আমরা জানি, সরকার আমাদের দাবি বাস্তবায়ন করবেনা। আমরা আমাদের বিচার জনগনের কাছে দিতে এসেছি। জনগণ জানুক, আমরা সমতলে যেমন নিষ্পেষিত হচ্ছি, পাহাড়িরা তার চেয়ে বেশি নিষ্পেষিত হচ্ছে। পাহাড়ী ও সমতলের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সক্রিয়ভাবে মুক্তি লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজি মামুন হায়দার রানা বলেন, যে বিষয় নিয়ে আমরা আজ এখানে দাঁড়িয়েছি, এটা আর পাহাড় কিংবা সমতলের বিষয় নয়। এটা এখন সারা বাংলাদেশের বিষয়। এখানে (সমতলে) যেমন মাইক্রোবাস বা মোটরসাইকেলে করে তুলে নিয়ে যায়, মুখোশধারীরা পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে ফেলে, পাহাড়েও তাই চলছে। সেটা আরও দীর্ঘদিন ধরে। জনসংহতি থেকে তৈরি ইউপিডিএফকে গণতান্ত্রিক -লিবারেল ইত্যাদি নামে অসংখ্যভাগে ভাগ করা হয়েছে। ভাই ভাইয়ের দ্বন্দ্ব চলছে সেখানে। এগুলো কোনোটাই রাষ্ট্রীয় মদদ ছাড়া সংঘটিত হওয়া সম্ভব নয়।

তিনি আরও বলেন, পাহাড় নিয়ে যেমন আতংক তৈরি করা হয়, আবার একই পাহাড়ে রিসোর্ট বানিয়ে অনেক কিছু করা হয়। কোটি কোটি টাকা আনা হয় ইকোলজি ঠিক করার নামে। আবার পাহাড় কেটে রিসোর্ট বানিয়ে সেখানে লাখ লাখ মানুষকে নিয়ে গিয়ে সেগুলোকে (পাহাড়গুলোকে) নষ্ট করা হয়। আমরা ভয়ংকর দ্বন্দ্বের মধ্যে আছি। রাষ্ট্রযন্ত্র প্রত্যেকদিন সেগুলোকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। তারই বিরুদ্ধে যে মানুষগুলো বিভিন্ন সময়ে দাঁড়িয়েছিল, স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেছিল, তাদের মধ্য থেকে চারজনকে গত ১১ ডিসেম্বর হত্যা করা হয়েছে নির্মমভাবে। সেই হত্যার বিচার এখানে দাঁড়িয়ে চেয়ে কোনো লাভ আছে কিনা আমি জানিনা। কিন্তু বিচার চাওয়া অব্যাহত রাখতে হবে। পাহাড়ে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে।

মানববন্ধনে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সাংগঠনিক-সম্পাদক শাহরিয়ারের আলিফের সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য দেন ইতিহাস বিভাগের সহকারী-অধ্যাপক গোলাম সারওয়ার সুজন, নাট্যকলা বিভাগের সহযোগী-অধ্যাপক কাজি শুসমিন আফসানা, নাগরিক ছাত্র ঐক্যের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মেহেদী হাসান, রাবি শাখা ছাত্র গণমঞ্চের আহ্বায়ক নাসিম আহমেদ, বিপ্লবী ছাত্রযুব আন্দোলনের আহ্বায়ক তারেক আশরাফ, ছাত্র ফেডারেশনের আহ্বায়ক রায়হান আলী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের আহ্বায়ক ফুয়াদ রাতুল, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের পক্ষ থেকে শামিম ত্রিপুরা। এসময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের প্রায় অর্ধশত শিক্ষক-শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।

এরআগে, বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতিসহ ৪ জনকে হত্যার প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মশাল মিছিল করেছিল ক্যাম্পাসের প্রগতিশীল বাম ছাত্র সংগঠনগুলো এবং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সদস্যরা।

প্রসঙ্গত, গত ১১ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ির পানছড়িতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) চার নেতা-কর্মী হত্যার শিকার হয়।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ