নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজশাহীতে নাশকতার মামলায় গ্রেফতার আসামিকে ছাড়াতে তদবির করেছেন ওয়ার্কার্স পার্টি এবং আওয়ামী লীগের নেতা। এই জামায়াত নেতার নাম নুরুজ্জামান খান (৫৫)। তিনি মসজিদ মিশন অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষ। তার জন্য তদবির করেছেন রাজশাহী সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা এবং আওয়ামী লীগ নেতা ১২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সরিফুল ইসলাম বাবু। বাবু এর আগে রাসিকের সাবেক প্যানেল মেয়র ছিলেন।
রাজশাহীর মসজিদ মিশন অ্যাকাডেমির (স্কুল অ্যান্ড কলেজ) অধ্যক্ষ জামায়াত নেতা নুরুজ্জামান খানকে (৫৫) ছাড়াতে রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) কমিশনারকে ফজলে হোসেন বাদশা বেশ কয়েকবার ফোন করেন। এমনকি জামায়াত নেতা নুরুজ্জামান খানকে ছাড়াতে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা বাবুর সাক্ষাতের সিডিউলও নিশ্চিত করেন বাদশা। তবে পুলিশ শেষ পর্যন্ত এই আসামিকে ছাড়েনি। তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতা বাবু শিডিউলের সত্যতা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, মসজিদ মিশন অ্যাকাডেমি এর আগে ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে চলতো। ২০২০ সালের পর এই প্রতিষ্ঠানের কমিটি গঠন করা হয়। আমি ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হই। আগে থেকে প্রতিষ্ঠানের অন্তত ১২ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে আগে থেকেই নাশকতার মামলা আছে। অধ্যক্ষ নুরুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলা ছিল না। একটা পুরোনো মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এ জন্য আমি বাদশা ভাইয়ের কাছে গিয়েছিলাম। বাদশা ভাই পুলিশ কমিশনারকে ফোন করে দেখা করার জন্য আমাকে সময় নিয়ে দিয়েছিলেন। অধ্যক্ষ আগে জামায়াতের রাজনীতি করলেও এখন তিনি সংগঠনটির বিরোধিতা করেন। কোন মামলা ও কিসের কারণে অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করেছে তা জানতে মূলত কমিশনারের সাথে বসেছিলেন। এখন আমাকে তদবিরবাজ বানানো হয়েছে।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ছাত্রজীবনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা ছিলেন অধ্যক্ষ নুরুজ্জামান খান। পরে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করেন। এখন তিনি জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন।
নগরীর সাহেববাজার বড় মসজিদসংলগ্ন এলাকায় ১৯৮২ সালে জামায়াতে ইসলামী মসজিদ মিশন একাডেমির (স্কুল অ্যান্ড কলেজ) নামের এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করে। জামায়াত তাদের দলীয় নেতাকর্মীদের এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ করে। প্রতিষ্ঠানটির অন্তত ১২ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে নাশকতার মামলা আছে। এদের মধ্যে দুজন স্বরাষ্ট্র মণন্ত্রালয়ের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। মাঝে মাঝেই এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা গ্রেফতার হন।
গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে নগরীর হড়গ্রাম মুন্সিপাড়া মহল্লার নিজ বাড়ি থেকে নুরুজ্জামানকে গ্রেফতার করে কাশিয়াডাঙ্গা থানা-পুলিশ। এরপর বুধবার তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। গেল বছরের ১৭ নভেম্বর কাশিয়াডাঙ্গা থানায় পুলিশের দায়ের করা একটি নাশকতার মামলায় নুরুজ্জামানকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
মামলার বাদী উপপরিদর্শক (এসআই) শাহ আলী মিয়া এজাহারে উল্লেখ করেন, আগের দিন ১৬ নভেম্বর বিএনপি ও জামায়াতের অবরোধ কর্মসূচি ছিল। এ জন্য বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা সেদিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে নগরীর সায়েরগাছা এলাকায় রাস্তায় অবস্থান নিয়ে মানুষের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছিলেন।
খবর পেয়ে ফোর্স নিয়ে এসআই শাহ আলী মিয়া সেখানে যান। এ সময় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা ওই এলাকায় ফায়ার সার্ভিস অফিস লক্ষ্য করে দুটি ককটেল ছুঁড়ে মারে। একটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়ে অফিসের জানালার কাঁচ ভেঙে যায়। অপর একটি অবিস্ফোরিত ককটেল উদ্ধার করা হয়। অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করা হয়।
এদিকে এই মামলায় অধ্যক্ষ নুরুজ্জামান খানকে গ্রেফতারের পর তাকে ছাড়ানোর জন্য তোড়জোড় শুরু করেন আওয়ামী লীগ নেতা মসজিদ মিশন অ্যাকাডেমির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি সরিফুল ইসলাম বাবু। নুরুজ্জামানকে ছাড়াতে তিনি রাজশাহী-২ (সদর) আসনের সাবেক এমপি ফজলে হোসেন বাদশার কাছে ছুটে যান। এরপর বাদশা আরএমপি কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদারকে বেশ কয়েকবার ফোন করেন। বুধবার বেলা ৩টায় পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তিনি বাবুকে সময়ও নিয়ে দেন।
ফজলে হোসেন বাদশা একটি সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি ওই সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, অধ্যক্ষ কোনো মতাদর্শের মানুষ তা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি বাবু ভালো বলতে পারবেন। আমি পুলিশ কমিশনারকে বলেছিলাম- বিষয়গুলো যেন তার কাছ থেকে শোনা হয়। এ জন্য আমি বাবুকে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাতের একটি সময় নিয়ে দিয়েছিলাম। মসজিদ মিশন অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষ নুরুজ্জামান খান জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করেন কি না তা আমি জানি না।
অথচ ফজলে হোসেন বাদশা সংসদ সদস্য থাকাকালে ২০২০ সালের ১১ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করে মসজিদ মিশন অ্যাকাডেমির নানা অনিয়মের তথ্য তুলে ধরেছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি রাজশাহী মহানগরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বলে দীর্ঘদিন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ও জঙ্গিবাদীরা একে কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এই প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু সংখ্যক শিক্ষক জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুক্ত এবং তাদের বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী জঙ্গি তৎপরতার কারণে বিভিন্ন ফৌজদারি মামলাও রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের ১১ কোটি টাকা লুটপাট করে সরকারবিরোধী কর্মকান্ডে ব্যয় করা হয়েছে।
কাশিয়াডাঙ্গা থানা থেকে নুরুজ্জামানকে আদালতে পাঠানোর সময় পুলিশ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রাথমিক তদন্তে এই আসামি মামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।’
আরএমপি কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার বলেন, নুরুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। আরও তদন্ত চলছে। মামলায় থাকা অভিযোগ এখন বিচারাধীন বিষয়। তবে জামায়াত নেতা নুরুজ্জামানকে ছাড়াতে বাদশার ফোন এবং বাবুর দেখা করার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।