গড়ে তুলি প্রকৃতির সাথে মিতালী

আপডেট: জুন ৪, ২০২৪, ১২:০৮ পূর্বাহ্ণ

ড. রুমি শাইলা শারমিন


আমাদের মনটা যখন বিষন্নতায় ছেয়ে যায় তখন আমরা প্রকৃতির কাছে ছুটে যাই। প্রকৃতির বিশালতায়, নির্মলতায় আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। প্রকৃতির অকৃত্রিম উদারতায় আমরা ফিরে পাই অনাবিল শান্তি। কিন্তু ভাবার বিষয়- এই প্রকৃতি আর পরিবেশকে আমরা কতটুকু রক্ষা করতে পারছি, কতটুকু ভালবাসি! প্রকৃতিকে নিঃস্ব করে আমরা নিচ্ছি দু’হাত ভরে। এভাবে প্রকৃতিকে নিঃস্ব করলে যে আমরাই একদিন নিঃশেষ হয়ে যাব!

আমাদের জীবন ধারণ আর জীবনকে সাজিয়ে তুলতে নিরবিচ্ছিন্ন জোগানদার হলো প্রাকৃতিক উপাদান। খাবার, ফলমূল থেকে শুরু করে ওষুধ,পানীয়, কাপড়, বাড়ি-ঘর, আসবাবপত্র, নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য সকল কিছু নির্মাণের উপাদান প্রকৃতি থেকে আসে। অথচ দুঃখজনক, আমরা মানুষ এতটাই অসচেতন যে, জীবনকে আরো বেশি বেশি উপভোগ করতে ও সাজাতে গিয়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশ বিরোধী কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ছি! ফলে আজ বিপন্ন পরিবেশ। আজ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, প্রবাল প্রাচীর, জলাভূমি ধ্বংসের মুখে, নদী আর সাগর তীব্র দূষণের কবলে।

নদী,পুকুর ভরাট করে, প্রাকৃতিক বনাঞ্চল উজার করে, গড়ে উঠছে আবাদি ভূমি, ঘটছে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ। পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, আর্সেনিক দূষণ, মাটিদূষণ আরো জটিল করে তুলছে আমাদের পরিবেশ ও প্রকৃতিকে। পরিবেশ বাঁচাতে হলে এবং আমাদের বাঁচতে হলে প্রথমতঃ অক্সিজেন প্রয়োজন। এই অক্সিজেনের যোগান দেয় গাছপালা। কোটি কোটি মানুষের শ্বাস নেয়ার জন্য অক্সিজেন জোগান দেয়া, জীবন-জীবিকার উপায় সৃষ্টি, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবস্থা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সহায়ক ভূমিকা পালনে গাছপালা রোপন ও সংরক্ষণ জরুরি।

বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস অথবা বাংলাদেশে আঘাত হানা বড় বড় সাইক্লোনের সময় সুন্দরবন এবং উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল লাখো মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে তা আমরা দেখেছি।

আসুন, সচেতন হই। আমরা নিজ নিজ উদ্যোগে অথবা সমষ্টিগত উদ্যোগে পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে পারি। বাড়ি-ঘর সহ আশেপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্নতার দিকে মনোযোগী হতে পারি।
গাছেরও প্রাণ আছে জগদীশচন্দ্র বসু দিয়ে গেছেন প্রমাণ। তবে দোলা লাগুক প্রাণে প্রাণে। আসুন গাছ লাগাই। গড়ে তুলি এক টুকরো বাগান। প্রাণের সাথে যুক্ত হোক প্রাণ। সবুজ সতেজ গাছপালায় ভরে উঠুক গৃহকোণ, ছাদ, চিলেকোঠা, আঙিনা কিংবা পথের ধার। শাকসবজির বাগান আর রংবেরঙের ফুলের ফলের গাছে সুশোভিত হোক পরিবেশ। গাছে গাছে ভিড় জমুক পাখ-পাখালির।

আসুক অতিথি পাখিরাও। সেখানে প্রজাপতি ঘাসফড়িঙের দেখা মিলবে, শুনতে পাবেন মৌমাছির গুঞ্জরণ। বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ব্যবহারের সময় একটু খেয়াল রাখতে হবে যেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যবহার না হয়। গড়ে তুলি মিতব্যায়িতা। আমরা দেখে থাকি যেখানে সেখানে প্লাস্টিক, পলি ব্যাগের যথেচ্ছ ব্যবহার। এই ব্যবহার সীমিত করা ভীষণ প্রয়োজন। অন্যদিকে কাগজের ব্যাগ তৈরিতেও উজাড় হয় বনভূমি। তাই কাগজের ব্যবহারও কমিয়ে আনতে হবে।

ছাদ, বাগান এবং আশপাশের ব্যবহৃত রাস্তা-ঘাটে যাতে ময়লা আবর্জনার স্তূপ না হয় বা জলাবদ্ধতা না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। যানবাহনের কালো ধোঁয়ার থেকে দূষণমুক্ত করতে প্রাকৃতিক পরিবেশ সুন্দর রাখতে যতটা সম্ভব বাইসাইকেল ব্যবহার করতে হবে। প্রকৃতি ও পরিবেশ বাঁচানো মানে শুধু গাছ-পালা, পানি, বাতাস-ই নয়, প্রাণীদেরও সংরক্ষণ করা। ব্যালকনিতে বা ছাদে পাখিদের জন্য পানি ও খাবার রাখতে পারি। আশেপাশে কুকুরদের, বিড়ালদের খাবার দেয়া যেতে পারে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আমরা ইতোমধ্যে এ ধরনের মানবিক কাজগুলো দেখে প্রাণিত হয়েছি। এগুলো সবই প্রকৃতিকে ভাল রাখার প্রাথমিক পদক্ষেপ। আশার কথা যে- বন্যপ্রাণী বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানো ও সংরক্ষণের জন্য জাতীয় উদ্যান, বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ, বোটানিক্যাল পার্ক (উদ্ভিদ), জুওলজিক্যাল পার্ক (প্রাণী), বন্যপ্রাণী সাফারি, ক্রাইও-সংরক্ষণ ইত্যাদি রয়েছে।

আসলে আমাদের ভেতরের মানবিক মূল্যবোধ আর শৈল্পিক অনুভবকে জাগিয়ে তোলার অনুপ্রেরণাও এই প্রকৃতি। আসুন, অপরূপ প্রকৃতির ঝর্নাধারা, সুবিশাল জলরাশি, সবুজ বন বনানীর সাথে গড়ে তুলি একাত্মতা। পাখ-পাখালি আর পশু-প্রাণীর প্রতি গড়ে উঠুক মমত্ববোধ। আমরাও যেন হতে পারি প্রকৃতির মত শান্ত, নিবিড়, নিঃস্বার্থ। রচিত হোক মানুষ ও প্রকৃতির মিতালী।
লেখক : কবি, কলামিস্ট.প্রফেশনাল সাইকোলজিস্ট