রবিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৫ মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
রাবি প্রতিবেদক:
ছাত্র-জনতা গণহত্যায় সমর্থন ও উস্কানি দেওয়াসহ চার অভিযোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুসতাক আহমেদের অপসারণ দাবি করেছে শিক্ষার্থীরা। অন্য তিন অভিযোগ হলো একাডেমিক পরিসরে অনিয়ম-দুর্নীতি, যৌন হয়রানি ও অর্থ কেলেঙ্কারি। এবিষয়ে রোববার (১সেপ্টেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা দেন শিক্ষার্থীরা।অভিযোগের অনুলিপি উপাচার্য দপ্তর ও বিভাগের সভাপতি বরাবরও জমা দেন তারা।
লিখিত অভিযোগপত্রে শিক্ষার্থীরা দাবি করেছেন, জুলাই-আগস্ট মাসে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালীন ড. মুসতাক আহমেদ তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিপক্ষে একের পর এক বিভিন্ন উস্কানিমূলক ও অনৈতিক ভাষায় পোস্ট দিতে থাকেন, যা শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলন দমনে সরকারের পৈশাচিক গণহত্যাকে সমর্থন করে এবং উস্কে দেয়। এছাড়া একাডেমিক পরিসরে নিয়মিত ক্লাস না নেওয়া, ক্লাসে শিক্ষার্থীদের অপমান-অপদস্ত করা, পরীক্ষায় খাতায় অনৈতিক সুবিধা দেওয়া, হুমকি-ধামকি দেওয়া, বিভাগের অর্থ তছরুপ করা, নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হয়রানিমূলক আচরণ করা, টার্গেট করে অপছন্দের শিক্ষার্থীদের কম নম্বর দেওয়াসহ তার নানা অপকর্মে শিক্ষার্থীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
ড. মুসতাকের ছাত্র-জনতার গণহত্যায় সমর্থন ও উস্কানির বিষয়ে শিক্ষার্থীরা লিখেছেন, আন্দোলন চলাকালীন তিনি তার ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেন, ‘যারা নিজেদের রাজাকার-আলবদর দাবী করতে পারে, আমি কে রাজাকার, তুমি কে রাজাকার বুলি আওড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উত্তাপ ছড়াতে পারে, তাকে/তাদেরকে পড়ানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হইনি। আমার পেছনে রাষ্ট্র বিনিয়োগ করেছে, এই পর্যায়ে আসতে।’
এছাড়াও তিনি ১৭ জুলাই ঢাবিসহ সারা দেশে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলাকে সমর্থন ও উস্কে দিয়ে ফেসবুক পোস্টে উল্লসিত হয়ে লিখেন, ‘অপারেশন চলছে। কাটাছেঁড়া। যাকে বলে ব্যবচ্ছেদ। এক একটি কনুই ব্যাংকের (ব্যাঙ) ব্যবচ্ছেদ করে বিভিন্ন অংশ দেখার কাজ চলছে। একটু দূরে থাকুন।’
একাডেমিক পরিসরে ড. মুসতাকের দুর্নীতির বিষয়ে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, একটা সেমিস্টারে ন্যূনতম যে কয়টি ক্লাস নিতে হয়, তিনি তার ধারেকাছেও না গিয়ে সর্বসাকুল্যে পাঁচ থেকে সাতটি ক্লাস নিয়ে কোর্স সমাপ্ত করেন। এটা তার দীর্ঘদিনের অনুসৃত রীতি ও পদ্ধতি। এই ক্লাসগুলোও তিনি রুটিন না মেনে তার দেওয়া নির্ধারিত সময়ে নিয়ে থাকেন। তার নির্ধারিত সময়ে ক্লাস করতে এসেও শিক্ষার্থীদেরকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। দীর্ঘ সময় বসে থাকার পর উনি যে ক্লাস নেন, তার সর্বোচ্চ সময়সীমা ২০ থেকে ২৫ মিনিট। এমনও নজির রয়েছে, শিক্ষার্থীদের ক্লাসে বসিয়ে রেখে উনি চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছেন।
তারা আরও লিখেছেন, ক্লাসে অনিয়মের পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলকভাবে খাতা মূল্যায়নের অভিযোগ রয়েছে। একজন শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ক্লাসের বাইরে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু এর ভিত্তিতে তিনি তার অনুগামী ও মোসাহেব শিক্ষার্থীদের বিশেষ সুবিধা দেন এবং তাদের মাধ্যমে পুরো ব্যাচে নজরদারি চালান। সেই নজরদারি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের খাতা মূল্যায়ন করেন। এতে করে অনেক শিক্ষার্থী তার আক্রোশের শিকার হন এবং প্রাপ্য নম্বরের ক্ষেত্রে বঞ্চিতও হন। ক্লাসে তিনি হরহামেশাই বলেন, ‘পরীক্ষার নম্বর খাতায় থাকে না, মাথায় থাকে’। এটা তার বিখ্যাত উক্তি হিসেবে বিভাগে সর্বজন বিদিত।
নারী শিক্ষার্থীদের হয়রানি করার বিষয়ে তারা দাবি করেন, ড. মুসতাক বিভাগের নারী শিক্ষার্থীদের অপ্রয়োজনে রাতবিরাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ) মেসেজ করেন। যা সেই শিক্ষার্থীদের জন্য বিব্রতকর।
বিভাগের ফান্ড থেকে অর্থ আত্মসাৎের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের দাবি, তাদের কাছে সুস্পষ্ট তথ্য আছে, মুসতাক আহমেদ বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব (৫ মে ২০২১-৪ মে ২০২৪) পালনের সময় বিভাগের বিভিন্ন তহবিল থেকে ৯ লক্ষ ৮১ হাজার টাকা তছরুপ করেছেন। বিভাগের সভাপতি পরিবর্তন হওয়ার পর তার এই অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি ধরা পড়ে। বিষয়টি অবগত করে নতুন সভাপতি রেজিস্ট্রার বরাবর চিঠি পাঠিয়েছেন বলেও তারা অবগত হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তিনি এ টাকা বিভাগের তহবিলে জমা দিবেন মর্মে অঙ্গীকার করে বিষয়টি ফয়সালা করলেও এখনো সম্পূর্ণ টাকা ফেরত দেননি। তার মানে তিনি ভয়াবহ আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা পরিপন্থী ও আইনবহির্ভূত।
এছাড়া এক অছাত্রকে ছাত্রলীগের নেতা বানাতে ড. মুসতাক আহমেদের বিরুদ্ধে সহযোগিতা করার অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। লিখিত অভিযোগে তারা লিখেছেন, ২০২৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বিভাগের সান্ধ্য মাস্টার্স প্রোগ্রামের জরুরি সভায় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী আসাদুল্লাহ হিল গালিবের ভর্তি বাতিলের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পরেও ড. মুসতাক আহমেদ তৎকালীন বিভাগীয় সভাপতি হিসেবে তাকে ছাত্রলীগের সম্মেলনের ঠিক আগের দিন ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩-এ পেছনের তারিখ (২৪ আগস্ট ২০২৩) দেখিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে ছাত্রত্বের প্রত্যয়নপত্র প্রদান করেন। এবং অছাত্র ও চিহ্নিত সন্ত্রাসীকে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদ পাইয়ে দিতে সহায়তা করেন। সভাপতি থাকাকালীন তার ক্ষমতার এই অপব্যবহার গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে অধ্যাপক মুসতাক আহমেদের মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।